এই পা ঢাক, পা ঢাক বলতে বলতে বড়মা আঁচলটা দিয়ে আমাদের দু ভাইয়ের পা ঢেকে দিল। শান্তির জল পায়ে পড়তে নেই। তারপর আরতির প্রদীপের ওম আঁচলে নিয়ে আমাদের মাথায় ঠেকিয়ে দিত। ছোটবেলা থেকেই আঁচল জড়িয়ে বড় হয়েছি। ঠাকমার সাদা শাড়ি, সরু কালো পাড়, আঁচলে চাবির গোছা। যখন হাঁটত তখন এক সুন্দর আওয়াজ, যেন হ্যামলিনের বাঁশি। আমরা পিছন পিছন ঘুরতাম। যদি একবার আলমারিটা খোলে – খাজানাই খাজানা। তিন, চার থাকে আচার, আমচুর, লেবু লজেন্স। খালি হরলিক্সের বোতলে রাখা খুচরো পয়সা। তখন এত ‘কন্টেনার’ পাওয়া যেত না। খালি শিশিতেই থাকত গুড় থেকে সরষের তেল, হজমি গুলি থেকে আমাদের খেলার কাচের গুলি। বৌদিদি আমাদের মামারবাড়িতে কাজ করতো। মাকেও মানুষ করেছে, আমাকেও। রোজ দুপুরে বৌদিদি বারান্দায় রোদে শুয়ে ‘উমরো ঝুমরো’, ব্রম্মদত্যির গল্প বলত। ভূয়ে শুতে নেই, তাই আঁচলটা ছড়িয়ে দিত। আমি গল্প শুনতে শুনতে আঁচলের ওপরেই ঘুমিয়ে পড়তাম।
ছোটবেলায় আমার একটা বদভ্যাস ছিল মায়ের শাড়ির আঁচল চিবোনো। একবার ট্রেনে যেতে যেতে ভুল করে পাশে বসা অন্য ভদ্রমহিলার আঁচল চিবিয়েছিলাম। কিন্তু মা মা টেস্ট না পাওয়ায় পরে ভুল বুঝতে পারি। আঁচলের সবচেয়ে লোভনীয় অংশ ছিল আচলের খুঁট। তাতে বাঁধা থাকতো সাত রাজার ধন। কেউ বাড়িতে এলে আমরা প্রণাম করে জুল জুল করে ভালো ছেলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম। প্রণামে ভক্তির থেকেও বড় ছিল খুঁট খোলার চাবি। কখন খুঁটটা খুলে ১ টাকা বা ২ টাকা বেরবে। সেটা নিয়েই দৌড় পাড়ার মোড়ের মাথার দোকানে।
উত্তম- সুচিত্রা,ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো বাঙালির আরেকটা তর্কের বিষয় ছিল মায়ের না বউয়ের আঁচল। এই চর্চা বেশি চলতো দুপুরে খাবার পর এঁটো হাতে বসে মা-কাকিমার আড্ডায়। কাশীদা বিয়ের ৬ মাস পর বউকে নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করলো- ও বউয়ের আঁচল ধরা, মেনীমুখো। নকুড়দা বিয়ের পরেও মাইনের টাকাটা মায়ের হাতে তুলে দিত, ও মায়ের আঁচল ধরা। এতই যদি মাতৃভক্তি তাহলে বিয়ে করেছিলিস কেন? কিছুতেই কেউ খুশি হয় না। পাড়ায় কিছু বউদির খুব ঝগড়ায় সুনাম ছিল। ওরা কোমরে আঁচল জড়িয়ে ঝগড়া করতে পারত। বিশুদা প্রতি শনিবার স্বপ্না বৌদিকে নিয়ে সিনেমা বা নাটক দেখতে যেত। বৌদির মাথায় ঘোমটা আর আঁচল গায়ে জড়িয়ে বেরোত। একদিন বৌদির আঁচল গায়ে জড়ানো ছিল না বলে বিশুদা বাড়িতে নাটক করেছিল। আঁচল মানে কর্তৃত্ব!
শাড়ির আঁচল দু রকম হোত। কুঁচি দিয়ে পরা শাড়ি আর আটপৌরে ভাবে পরা। রুমিদিরা কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরতো। যখন আঁচল উড়িয়ে কোচিং ক্লাসে যেত তখন প্রজাপতি প্রজাপতি লাগতো। আর তারপর দেখলাম মিঃ ইন্ডিয়ায় শ্রীদেবীর সেই নীল আঁচল বা মাধুরীর ‘ধক ধক’ এর আঁচল। বুঝলাম আমরা বড় হয়ে গেছি।