আজ একটি চুড়ান্ত যাচ্ছেতাই লেভেলের ভাট বকতে ইচ্ছে করছে। আশেপাশের লোকজন ভোট এবং ভোট সম্পর্কিত ভাট নিয়ে মাথা প্রায় খেয়ে নিল। রাস্তাঘাটে, ফেসবুকে- কোথায় নেই!! পক্ষ বিপক্ষ নিরপেক্ষ, শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে এই উৎসব নিয়ে বিশাল বিশাল বক্তব্য, নানান মুনির নানান মত, নানা কেচ্ছা কাহিনী শুনতে শুনতে প্রায় পাগল হবার জোগাড়!!
আর নেতারা তো এসবের মাল মশলা সাপ্লাই দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে! ফুরাচ্ছে না! মানে সেই জোর করে মুলো খাইয়ে দিলে যা হয় আর কি!!
যাকগে, যার যা ইচ্ছে করুক। আমি বরং একটু খানি ডাক্তারি নিয়ে গল্প করি। যে যাই বলুক, এটি ছাড়া তো তেমন কিছু জানি ও না। তেমন কিছুতে আগ্রহ ও পাই না।
এ গল্পটি ১৯৩৮ সালের! মানে আজ থেকে প্রায় তিরাশি বছর আগেকার।
ব্রিটেনের একজন নাট্যাকার ছিলেন প্যাট্রিক হ্যামিল্টন। তিনি হঠাৎ একটি নাটক লিখে বসলেন। ব্রিটেন বলেই হয়তো তখনকার দিনে অদ্ভুত সব জিনিস নিয়ে নাট্যকাররা ভাবতেন! এখানে পুরো নাটক তো আর লেখা যাবে না। সংক্ষেপে গল্পটা বলি।
স্বামী স্ত্রী থাকেন একসঙ্গে। স্ত্রী প্রায় নির্বিবাদী। স্বামীই তার ধ্যান জ্ঞান। হয়তো মৌলিক চাহিদা তথা অন্যান্য সব চাহিদা মেটানোর জন্য একমাত্র স্বামীর উপর নির্ভরশীল ছিলেন। আবেগ অনুভূতি চাওয়া পাওয়া- সব স্বামীকে ঘিরে। এহেন স্ত্রী আজকাল-কার দিনেও দুষ্প্রাপ্য নয়। অস্বাভাবিকও নয়।
উল্টোদিকে স্বামীটি চুড়ান্ত ধূর্ত, অপরাধী। অবশ্যই ভাষণে ও অভিনয়ে ছিল চুড়ান্ত পারদর্শিতা! নিরীহ স্ত্রীকে বশে রাখা তাঁর এক চুটকির কাজ!
এহেন স্বামীরত্নটি একজন মহিলাকে খুন করেন।এবং সেই মহিলার বাড়িতেই নিরীহ এই স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন। খুনের উদ্দেশ্য- ওই বাড়িতে সেই মহিলার লুকানো ধনসম্পত্তি হাতানো।
কিন্ত স্ত্রী যতই নিরীহ হোক, স্বামীর এহেন অপরাধ কোনকালেই কেউ মানে না। আর বেশি নিরীহ হলে এই ভয় আরো বেশি। বলা যায় না কি থেকে কি করে বসবে।
স্বামী সেটি বুঝতে পারে। অথচ, জোর করে বলে মানতে বাধ্যও করা যাবে না।
স্বামী পড়লো মহা ঝামেলায়! বউ সঙ্গে থাকলে সেই লুকানো সম্পত্তির খোঁজ করা যায় না। আবার এতো ভালো বউকে অকারণে তাড়ানোও যায় না!! ধূর্ত স্বামীদের নিরীহ গোবেচারা স্বামীসোহাগী স্ত্রী হলে এ এক মহা সমস্যা। না ডিভোর্স দিতে পারে, না সহ্য করতে পারে।
স্বামীদেবতাটি শুরু করলো মগজের খেলা। খেলাটি অদ্ভুত ।
তখনকার দিনে ব্রিটেনে গ্যাস লাইট জ্বলতো ঘরে ঘরে। তার একটা চাবি থাকতো, যা দিয়ে গ্যাসের কম বেশি করে আলোর পরিমাণ ঠিক করা যেত।আমাদের দেশেও নাকি ছিল এমন গ্যাস বাতি।
তো স্বামীটি কি করলো? আসছি সে গল্পে।
প্রথমতঃ স্ত্রীর মনে এটা ওটা নিয়ে কনফিউশন তৈরি করতে শুরু করলো। যেমন ধরা যাক, বাইরে কোকিল ডাকছে। স্বামী বললো- আরে ওটা তো ডাহুক! ধরা যাক, তরকারিতে ঝাল নুন বেশি হলো। স্বামী বললো- আরে এতো মিষ্টি, খেতে পারছি না!ধরা যাক, ঘরের সোফাটা ডান থেকে বাম দিকে ঘুরিয়ে রেখে দিয়ে বললো, এটা অনেক দিন ধরেই এমন আছে!! তুমি দেখোনি?
এই নিখুঁত অভিনয়ের সাথে সাথে মিষ্টি মুখে এটাও বলতে ভুললো না – ওহ মাই ডিয়ার বেবি, তোমার মাথায় বোধহয় কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে! ডাক্তার দেখানো দরকার। তুমি কোকিলের ডাক ভুল শুনছো, তুমি খাবারের টেস্ট ভুলে গেছ, তুমি ঘরের জিনিসপত্রের দিকে অব্দি খেয়াল রাখতে পারছো না!!
এবার বেচারী স্ত্রী কিছুতেই বুঝতে পারছে না যে – আসলে কি হচ্ছে! সে কিছু গোলমাল হলেই প্রশ্ন করছে। আর এরকম প্রত্যেকটি সহজ সাধারণ ঘটনায় স্বামী যা বলছে , সেটি যে কেন মিথ্যা হতে যাবে, এটাই সে ভেবে পায় না! অতএব, স্ত্রীর মনে ক্রমশঃ টক ঝাল নুন, কোকিল ডাহুক, চেয়ার টেবিল উল্টো এইসব জিনিস গুলো নিয়ে নিজের এতোদিন কার আত্মবিশ্বাস চুরমার হয়ে যেতে থাকে! সে আয়নায় তাকিয়ে ভাবে, প্রেমে পাগল বুদ্ধিমান স্বামী নিশ্চিত তাঁর মাথার গণ্ডগোলটা ঠিকই বুঝতে পারছে!! হয়তো ভালোর জন্যই জিনিসগুলো ধরিয়ে দিচ্ছে!! ক্রমশঃ সে স্বামীর কথায় বিশ্বাস করতে থাকে।
স্বামীটি এই সুযোগে কি করছে?
একবারে সব উল্টেপাল্টে দিলে ধরা পড়বেই! তাই একটু একটু পাল্টায় স্ত্রীর ধারণা, আর একটু একটু করে ঘরের কোনায় কোনায় তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে খুন হওয়া মহিলার সম্পত্তি!
কিন্ত সমস্যা বাঁধলো গ্যাস লাইট নিয়ে। ওটি জ্বলতে থাকলে তো আর বউয়ের চোখকে ফাঁকি দেয়া যায় না!! হঠাৎ স্বামী একটা আলমারি সরিয়ে দিচ্ছে, এটা সবাই বোঝে! তাই সে প্রতিদিন গ্যাস লাইট জ্বললেই একটু একটু করে আলো কমিয়ে দিতে থাকে। স্ত্রীকে বোঝায়- আলো কমছে না তো! তোমার মাথায় কম আলো নিয়ে কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে! যেমন হচ্ছে – টক ঝাল নুন চেয়ার টেবিল সোফা কোকিলের ডাক ইত্যাদি নিয়ে!!
কম আলোতে স্বামী খুঁজতে থাকে। সেখানে শব্দ হয়, সে নিজের সাথে কথা বলে। আর স্ত্রীকে বলে- এইগুলো বাস্তব নয়! বিভ্রম।
স্ত্রী ঘরের কোনে বসে ভাবে- তার সত্যিই অসুখ করেছে! সে শব্দ, আলো ও বুঝতে পারছে না আজকাল!!!
একদিন তো স্ত্রীকে সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মানসিক রোগীদের হাসপাতালেই ভর্তি করে দিল! এবং পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি করে তার সম্পত্তিও হাতিয়ে নিল!!!
সুস্থ স্ত্রী বেচারী পড়ে রইলো হাসপাতালে। সব দিনের জন্য!!
**
এই রে, এতোক্ষণ ডাক্তারির গল্প বলবো বলে, অন্য গল্প বলে ফেললাম। যাকগে, এবার সংক্ষেপে বলি।উপরের এই নাটকের নাম থেকেই এসেছে ডাক্তারির একটি শিক্ষা। যাকে সাইকিয়াট্রির ভাষায় বলে গ্যাস লাইটিং এফেক্ট!! মোদ্দা কথা হলো, সুস্থ মানুষকে সাইকোলজিক্যালি ম্যানিপুলেশন করার জন্য একটি মারাত্মক অস্ত্র।
মানে চাইলেই, সুস্থ সবল সুন্দর চিন্তা ভাবনার অধিকারী মানুষকে আস্তে আস্তে তার আত্মবিশ্বাসকে চুরমার করে দিয়ে রিয়েলিটিকে মিথ্যা বা ডিলিউশন বলে চালিয়ে দেয়া যায়!!
এমনকি পুরানো আমলের একটি অর্ধসত্য বা মিথ্যাকেও সত্য বলে চালিয়ে দেয়া যায়!!না, এটি ঠিক গোয়েবলসীয় পদ্ধতি নয়, যেখানে মিথ্যাকেই বারবার বলে প্রতিষ্ঠিত করা হয় সত্য রূপে।
এটি আরো ভয়ানক এই কারণেই যে, এটি যার বা যাদের উপর করা হবে, সেই ভিকটিম কোন ভাবেই বুঝতে পারবে না যে, ভিক্টিমাইজার আসলে আস্তে আস্তে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করছে! বরং মনে হবে, আরে! এতো আমার ভালোর জন্যই সব করছে! তাহলে এর কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনে চলাই আমার একমাত্র কর্তব্য!!
আরো ভয়ানক হয় তখন, যখন ভিকটিম নিজে এই মিথ্যাগুলোকে সত্যি বলে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে!!
এবার এ গল্প থেকে কি পাওয়া গেল?? কাঁচকলা, তাই তো?? দেখা যাক, কাঁচকলা কেমন?
আপনি আমি আজ ভোট উৎসবে মেতেছি। আহা!একের পর এক রাজনৈতিক দলের নেতাদের রঙ্গ তামাশা গালাগালি মিথ্যা ঢপ দেখে যাচ্ছি!! আজব আজব সব দাবী করছেন এক একজন!! আমরা কেউ পছন্দ করছি, কেউ অপছন্দ করছি, কেউ চুপচাপ থাকছি!! ঝগড়া মারামারি করছি। নেতাদের বক্তব্য নিয়ে আমাদের মাতলামি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আমাদেরকেই আর সুস্থ বলা যায় না!!
অথচ, আমরা সেই বেচারী স্ত্রীর মতো বুঝতেই পারছি না যে, এই নেতারা না অশিক্ষিত বোকা হাঁদা উদগাণ্ডু, না এঁদের কোন সৎ উদ্দেশ্য আছে!!! এঁরা সেই স্বামীর মতোই একমাত্র আমাদের কোষাগারের সন্ধানে আছে!!
তার জন্য দরকারে আমাদের মতো জনগণকে অসুস্থ বলে দাগিয়ে দিয়ে একটি অসুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজে ফেলে রাখতেও দ্বিধা বোধ করবে না!!!
তাই আশেপাশের বড় বড় নেতাদের দেখে, তাঁদের ক্রমাগত আলো কমিয়ে দেয়া দেখেও, কয়েকটি গালি দিয়ে বা সাপোর্ট করে, ফেসবুকে ইমোজি আর কমেন্ট দিয়ে আমাদের দিন কেটে যায়!! অন্ধকারে।আমরা বোঝার চেষ্টা অব্দি করছি না- ঠিক এভাবেই ছোট্ট ছোট্ট আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ঘটনাগুলোকেও সজ্ঞানে, ধূর্ততার সঙ্গে পাল্টে দেয়া হচ্ছে নেতাদের নিজেদের সুবিধার জন্য!!
আপনি কি ভাবছেন? এঁরা দেশের ক্ষমতা দখল করতে এসেছেন! আমাদের জীবন যাপনের প্রত্যেকটি জিনিসকে এঁরা কন্ট্রোল করতে এসেছেন!!
শিক্ষা দীক্ষা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে আলুর দাম, পটলের দাম, ইতিহাস বিজ্ঞান সমাজনীতি অর্থনীতি- সব কিছুকে নিজেদের সুবিধা মতো আস্তে আস্তে করে কন্ট্রোল করতে এসেছেন এঁরা!! নিজেদের পকেট ভরাতে এসেছেন!
আর আপনি আমি ভাবছি, আরে! এ মালটা তো মহা গাণ্ডু!! অশিক্ষিত!
পাছাটা একটু চেপে বসুন।
আপনি গ্যাস লাইটিং এর শিকার!! আমি গ্যাস লাইটিং এর শিকার!! গোটা সমাজ প্রায় এই অস্ত্রের শিকার!!
আর আপনি ভাবছেন, আমি কোত্থেকে রাজনীতির সাথে ডাক্তারির একটি বিষয় নিয়ে এলাম?
একটু জানুন। এটি রাজনীতি তে মোটেই নতুন নয়!!
পৃথিবীর বহু দেশে বহু বড় বড় নেতারা নিজেদের পথ পরিষ্কার করতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন!!
ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা মনে আছে??এখনো আমাদের সামনেই অনেকে করে চলেছেন!! উদাহরণ দিলে দিন কেটে যাবে। খালি আপনি আর আমি নিরুপদ্রব আমজনতা বলে বসে বসে ভাবছি , আমাদের নিয়ে এইসব উদগাণ্ডুরা এতো ভাবে??
হ্যাঁ ভাবে! আমাদের চেয়ে বেশি ভাবেন!!আর এঁরা অশিক্ষিত মূর্খ নন মোটেই!!
খেয়াল করুন, গ্যাস লাইটিং এফেক্ট দিয়ে
হাজার বছরের পুরনো যুক্তি প্রমাণহীন কথাও এভাবে আপনাকে বিশ্বাস করিয়ে দিচ্ছেন!! শুনতে পান আশেপাশে??
খেয়াল করুন, যেটা শোনানো হচ্ছে দেখানো হচ্ছে, সেটাই শুনছেন, দেখছেন, মানছেন, বিশ্বাস করছেন!!
ওঁদের গাল দিয়ে লাভ নেই! ওঁরা সব জানেন। আপনি গাল দেন, ভোটও দেন!
নিজের গ্যাস লাইটের চাবিটা নিজে ঘোরাতে শিখুন। নজরে রাখুন। না হলে, শেষ পর্যন্ত আপনার হাতের আঙ্গুলে একটু কালির দাগ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না!!!
ধুর কেলো! কি সব লিখছি!!
নেতাদের কি সাইকিয়াট্রিস্ট মনে হলো?? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন! এঁরা অসম্ভব ধূর্ত অপরাধী। না পারেন এহেন কাজ নেই!!
যাকগে, আমাদের ডাক্তারির গল্প আর একদিন বলবো।
ভাই স্মরণকালের মধ্যে এ্যাতো ভালো লেখা পড়িনি । সরকার ( যে’ই আসুক ) তো আপনাকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কারাগারে পাকা বাড়ির ব্যবস্থা করে দেবেন ।