ফেসবুক খুলে বসে আছি। নিউজফিডে একের পর এক রঙীন বন্ধু ফ্যাশন প্যারেডের মতো আসছে আর যাচ্ছে, আসছে আর যাচ্ছে। বেশ ভালো লাগছে দেখতে। এইসব ছোট ছোট আনন্দই তো জীবনের আসল সঞ্চয়, নইলে লাইফে আছে’টা কি বলুন তো? করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে জানি, কিন্তু ভ্যাক্সিন যখন এসেই গেছে তখন আর ভয় কি রে পাগল! ওই যে একটু দূরেই আবছা মতো দেখতে পাচ্ছেন? ওটা কি বলুন তো? আরে বাবা ওটা হার্ড ইমিউনিটি গো, হার্ড ইমিউনিটি! দেখতে দেখতে ব্যাটা নাগালের মধ্যে চলে আসবে, তখন আর আমাদের পায় কে? কোভিড আমার পুত, করোনা আমার ঝি …. হিঃ হিঃ হিঃ!
বাই দ্য ওয়ে, আমাদের দেশে ফর্টিফাইভ প্লাস এজ গ্রুপের যে জনসংখ্যাটা আছে সেটা টোটাল পপুলেশনের কতটুকু জানেন? মাত্র তিরিশ শতাংশের আশেপাশে। অর্থাৎ যাদের টার্গেট করা হয়েছে তাদের সবাইকে যদি ভ্যাক্সিনেশনের আওতায় আনা যায় তাহলে বড়জোর তিরিশ শতাংশ হবে। এদিকে কোভিডের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি পেতে হলে কত পার্সেন্ট কভারেজ দরকার বলতে পারবেন? সঠিক ফিগারটা কেউই বলতে পারছে না, তবে সেটা কোন মতেই সত্তর পার্সেন্টের কম নয় এটুকু শিয়োর! তার উপর যে রেটে ভ্যাক্সিনেশন চলছে তাতে টার্গেট পপুলেশন কতদিনে কভার করা যাবে সেটাও এই মুহূর্তে অনিশ্চিত। আর সব শেষে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো করোনার নিত্যনতুন মিউট্যান্ট স্ট্রেন তো আছেই!
তাহলে শেষমেষ কি খাড়াইলো? হার্ড ইমিউনিটির গল্প আপাতত ভুলে যান। জাস্ট ভুলে যান!
এবার আপনি বলবেন “সে না হয় ভুলে গেলাম, কিন্তু আপনি মশাই এত লোক ছেড়ে আমার পিছনে কাঠি করছেন কেন? আমি দোল না খেললেই করোনা চলে যাবে? ওদিকে শালা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সভায় ভিড় বাড়ানোর জন্য সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক, ইত্যাদির গুষ্টির ইয়ে মেরে দিচ্ছে তার বেলা কিছু নয়, আর আমি একটু ফূর্তি করলেই দোষ? মাইরি সেলুকাস, ফুটুন তো!”
অত্যন্ত ন্যায্য কথা! বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে একফোঁটা দোষ দিচ্ছি না। ইন ফ্যাক্ট কাউকেই দোষ দিচ্ছি না। সত্যিই তো, এই ভোটের বাজারে চারিদিকে যা চলছে তাতে আপনাকে কাউন্টার করার মতো যুক্তি আমার কাছে নেই। সেই মূর্খামিও করবো না, শুধু বিগত কয়েক মাসে আমার দেখা অজস্র ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা শেয়ার করছি।
গত বছরের কথা। সম্ভবত জুলাইয়ের শেষদিক বা অগস্ট মাস হবে। একই পরিবারের তিনজন সদস্য একই সাথে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। মা, বাবা, ছেলে। গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা মা দুজনেই পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাশের কাছেপিঠে। ছেলের বয়স তেইশ।
পজিটিভ রিপোর্ট আসার পর প্রথমদিকে সবাই হোম আইসোলেশনেই ছিলেন, কিন্তু আস্তে আস্তে সিম্পটমস্ বাড়তে থাকায় আমি আর রিস্ক নিলাম না। তিনজনকেই কোভিড অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে আমাদেরই জেলার একটা কোভিড হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম ভর্তির জন্য। তখন প্রতিটা হাসপাতালেই বেডের ক্রাইসিস চলছে, তবে ভাগ্য ভালো সেখানে কিছু জেনারেল বেড তখন খালি ছিল। আইসিইউ অবশ্য ফুল, কিন্তু আপাতত জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি তো হোক ! আইসিইউ দরকার হলে তখন দেখা যাবে’খন।
ভর্তি হওয়ার পর হাসপাতালে খবর নিয়ে জানলাম তিনজনেরই অক্সিজেন স্যাচুরেশন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ কম। ছেলেটার সবচেয়ে কম, মোটামুটি পঁচাত্তর-আশির মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। বাপ-মায়ের স্যাচুরেশন আরেকটু বেশি হলেও বিপদসীমার কাছেই। তিনজনকে কোভিড প্রটোকল অনুযায়ী ওষুধ-ইঞ্জেকশন এবং হাই-ফ্লো অক্সিজেনে রাখা হয়েছে।
পরদিন সকালের কথা। মায়ের অবস্থা ইতিমধ্যে একটু ইমপ্রুভ করলেও ছেলেটার কন্ডিশন ডিটিরিওরেট করেছে। এক্ষুনি আই সি ইউ-তে ঢোকানো দরকার, এদিকে তখন একটাও বেড খালি নেই। এই অবস্থায় পেশেন্টকে অন্য কোথাও যে শিফট্ করবো সেটাও মুশকিল, তবু খোঁজ নিয়ে দেখলাম যদি কোথাও আইসিইউ পাওয়া যায়। পেলাম না। সব ভর্তি!
গোটা একটা দিন এবং একটা বেলা এইভাবেই কাটলো। পরদিন সন্ধ্যায় ছেলেটা শিফট্ হলো আইসিইউ-তে। ভেন্টিলেশনে তিনদিন যুঝবার পর মারা গেল ছেলেটি। তেইশ বছরের তরতাজা একটা দেহ প্লাস্টিকবন্দী হয়ে চলে গেল মর্গে। বাপ-মা কিছুই জানতে পারলেন না। ইচ্ছা করেই তাঁদের জানানো হয়নি ! স্রেফ বাড়ির লোকদের খবর দেওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল এই মুহূর্তে বাবা-মাকে কিছু না জানাতে।
ঘটনা এখানেই শেষ নয় ! ইতিমধ্যে মহিলার অবস্থা অনেকটা ইমপ্রুভ করেছে, কিন্তু তাঁর ডায়াবেটিক স্বামীর দুটো ফুসফুসই ভয়াবহ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। ইনফেকশন কিছুতেই কব্জা করা যাচ্ছে না। আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, রেমডেসেভির ইঞ্জেকশন, স্টেরয়েড এবং সবরকম সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট দিয়েও তাঁকে ফেরানো গেল না। ভদ্রলোক মারা গেলেন।
স্বামীর মারা যাওয়ার খবর অসুস্থ স্ত্রীকে দেওয়া হয়নি। তিনি তখন সবে একটু সুস্থ হচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর এই প্রথম কারো সাহায্য ছাড়া নিজেই স্নান করেছেন। ওয়ার্ডের একজন অ্যাটেন্ডেন্টকে দিয়ে শ্যাম্পু আর সিঁদূরের পাতা কিনে আনিয়েছেন। স্নান সেরে পাশেরমাথায় সিঁদূর পরতে পরতে তিনি বিরক্ত কন্ঠে বেডের রোগীনিকে বললেন – “এরা ওয়ার্ডে আয়না দেয়নি সেটা না হয় ঠিকই আছে, তা বলে বাথরুমেও একটা আয়না রাখবে না? এভাবে সিঁদূর পরা যায় বলো তো?”
এমন অজস্র ঘটনার সাক্ষী থেকেছি আমরা। আপনারা জানেন না! ঈশ্বর করুন যেন কখনও জানতে না হয়। মৃত্যু জিনিসটা আমাদের, অর্থাৎ এইসব ডাক্তার সিস্টার এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের খুব বেশি আলোড়িত করে না, কারণ পেশাগত কারণেই জীবনমৃত্যুর সুক্ষ্ম বিভাজন রেখার চারপাশে আমাদের অবিরত ঘোরাফেরা করতে হয়। কিন্তু কোভিডে মৃত্যুর অভিঘাতটা একেবারেই অন্যরকম, বুঝলেন? নাহ, বুঝবেন না! যার যায় সে বোঝে, আর বুঝি আমরা, যারা সেই অভিঘাতের সাক্ষী থাকি।
দিনের পর দিন এরকম অজস্র অভিঘাতের আঁচে বহু ডাক্তার সিস্টার এবং প্যারামেডিকেল স্টাফ ডিপ্রেশনে চলে গেছে, বিশেষ করে যারা কোভিড হাসপাতালে ডিউটি দিয়েছে তারা। সবে যখন পরিস্থিতিটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে আশা করছিলাম তখনই নতুন করে বিপদটা আবার ঘনিয়ে এলো। মিছিল, জনসভা, রোড-শো, বাস-ট্রাক-ম্যাটাডোরে ব্রয়লার মুরগীর মতো গাদাগাদি লোক তুলে সভার ভিড় বাড়ানো, এসব যত দেখছি ততই কয়েকমাস আগের সেই বিভীষিকাময় দিন-রাত্রিগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
ভোট হবে, রেজাল্ট বেরোবে, কেউ জিতবে, কেউ হারবে, কেউ আবার মুনাফা বুঝে ‘গাঠবানধান’ বাঁধবে, ওদিকে আবার কোনও মায়ের জোয়ান ব্যাটা প্লাস্টিকের ব্যাগে বন্দী হয়ে চলে যাবে হিমঘরে। কত মানুষের মাথার উপর থেকে ছায়া চলে গেছে বিগত কয়েক মাসে! বাবার ছায়া, মায়ের ছায়া, স্বামীর ছায়া, স্ত্রীর ছায়া, সন্তানের ছায়া, অন্যান্য কত আপনজনের ছায়া, তাছাড়া অর্থের ছায়া তো আছেই! আবার বোধহয় সেই সব দিনগুলো ফিরে আসছে।
যাক, কি আর করা যাবে? পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন বলে কথা, সে কি আর সোজা ব্যাপার রে ভাই? এমন একটা মহাযজ্ঞে এটুকু কাঠ-ঘি তো পুড়বেই! এইসব দহনের একটা গালভরা ইংরেজী নাম আছে – “কোল্যাটারাল ড্যামেজ”। বাংলায় বলা যায় সমান্তরাল ক্ষতি। ক্ষতিটা যাদের হবে বুঝবে শুধু তারা, আর বুঝবো আমরা, যারা সেই অভিঘাতের আঁচে প্রতিনিয়ত ঝলসাবো।
আপনি বুঝবেন না। প্রার্থনা করি যেন কখনো বুঝতে না হয়। ভালো থাকুন। খুব ভালো থাকুন। হ্যাপি হোলি টু অল।
২৯/০৩/২০২১
এই লেখাতে কি যে কমেন্ট করব…..?
আবার যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে জানি না আবার কি অপেক্ষা করছে আগামীতে।
শুধু বলি সাবধানে থেকো…