চিরকালই মনে হয়েছে, আমার দেশের মানুষগুলো ভালো| বড্ড সহজ সব মানুষ| নেতার দল ফালতু খোঁচা মারাটা বন্ধ করলে নিজেও ভালো থাকতে পারতাম| পাশের লোকটাকেও আহ্লাদে বাঁচার উপায়গুলো দেখাতে পারতাম| ছোটোমোটো টুকরো টাকরা ঘটনাগুলো এমন ভাবেই আসে আমার কাছে যে বারবার এই কথাটাই বলে ফেলি আমি| সাধারণের মহৎকর্ম বলিয়ে নেয় আমায় দিয়ে| মহার্ঘ মানুষের ঢল আমাকেই যেন কোথায় দামি করে রেখে যায়| কোথাও না কোথাও থেকে গরিমা জুটিয়ে দেয় আমায়|
এইরকমই একটি ঘটনা আজ বলব আপনাদের| আমার যেখানে স্কুল সেই গলিতে একটি বিহারী পরিবার ভাড়া থাকেন| বাবা মা আর তাঁদের একটি চমৎকার মিশুকে বাচ্চা| বাড়িতে আলোহাওয়া কম বলে রোজই দেখি বাচ্চাটা সকালে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোদ খাচ্ছে| রোদ মাখার সময় এমনই এক তৃপ্তি থাকে তার চোখে, না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম তার মাকে| —–তোমার বাচ্চার বুঝি খুব রোদ খাওয়ার শখ?
হাসতে হাসতে মা জবাব দিলেন— হ্যাঁ দিদি| মোটরগাড়ি নয় এরোপ্লেন নয় আমার ছেলেটার একটাই বায়না| দিনের যত সময় রোদ থাকবে ততসময় ও রোদের তাতেই ঘুরে ঘুরে হাঁটবে| ওকে রোদে হাঁটাতে হাঁটাতে বাড়ির কাজকম্ম কিচ্ছু হয় না আমার| বোধহয় মায়ের এই সমস্যা দেখে একদিন দেখি পাড়ার বাঙালি দাদিরা পালা করে হাঁটাচ্ছে বাচ্চাটাকে| কখনো বা সে কোনো ঠাকুমার কাঁখে উঠে বসেছে| কোলের উচ্চতায় রোদ আরো জমছে তার গায়ে| জমিয়ে দিয়ে যাচ্ছে শিশুর “খোকন খোকন মন”টিকে |
খোকন বাঙালি ঠাকুমাদের বলে দাদি| কখনো আবার তার মা শেখান, বল ঠাকুমা| দিব্য নিশ্চিন্তে বাঙালিনীদের কাছে সন্তানটিকে ছেড়ে রেখেছেন মা। খুব আপনজনের কাছে অমূল্য সম্পদ রেখে যেমন মনের মধ্যে যেমন শান্ত ভাব আসে অনেকটা তেমন|
একদিন ঠান্ডা জব্বর| চারপাশের বাড়ির গোটা দুই তিন দাদি ঠাকুমা রাস্তায় মোড়া পেতে বসেছেন| খোকার সেদিন খুব খুব আরাম| মাটিতে পাই রাখতে হচ্ছে না তাকে| একসঙ্গে এতগুলো দাদি পেয়ে দিশাহারা আমার রোদখোকা| আদরের চোটে আদরের পরিমাপ ভুলেছে সে| কোন দাদির কোলে কতক্ষণ থাকবে, কে যে তাকে বেশি রোদ দেবে কিচ্ছুটি বুঝতে পারছে না| চট করে খানিক চটকে নিয়ে কানে কানে তার বললাম, বল খোকা, বল দাদি নম্বর 1, দাদি নম্বর 2, 3, 4,| এমনি করে এগো রে আমার রোদখোকা| সরিস না ভিনদেশির কোল হতে| সন্ধি করে নে দাদি – ঠাকুমায়| থ হয়ে গায়ে তোর থেকেই যাবে রোদ| মিলিয়ে নিস এ মায়ের কথা| দেখিস! দেখিস তুই|
মান্যবরেষু —আপনারা কাদা মাখামাখি করতে লাগুন| একজন অপরজনকে হনুমান বলুন — বাপের ব্যাটা বলুন| আরেকজন কপালে লাল কমলা (exact রঙ বুঝতে পারি না কিনা) টিকা লাগিয়ে হুমকির পর হুমকি দিন — মেরে সব তাড়িয়ে গুজরাট বানাব| বলার সময় স্বনামধন্য অধ্যাপক হয়েও একদম খেয়াল রাখবেন না — ঘরবন্দি শিশু টিভিতে আপনার ভাষণ শুনছে –দেখছে মানুষকে হনুমান বলা যায়! কখনো বা সে শুনছে — তার প্রিয় রবিঠাকুরের গান গাওয়া শিল্পীকে বাপ তুলে গালাগাল দেয়া হচ্ছে| আপনার রাজনৈতিক ক্রোধের বিষয়টি কিন্তু দশ বারো বছরের বাচ্চা কিছু বুঝছে না | কখনো আরেক কাণ্ডজ্ঞানহীন নেতার মানুষ খেদানোর কথা শুনে confused হচ্ছে শিশু — যে দেশে মানুষই থাকবে না, তার খেলার সাথী সেই দাদিঠাকুমারাই থাকবে না সেটা দেশ হবে, না ভূগোলবইয়ে পড়া অচেনা কোনো গ্রহ হয়ে হয়ে যাবে? আর কী হচ্ছে? বলুন — আপনাদের কথাবার্তায় কী হতে পারে এক শিশুর? —ছোট্ট মনটা তার ভয়ে কাদা হচ্ছে|
না না| এতসব একদম ভাববেন না কেমন! কেন ভাববেন? সব উৎসব চালু রেখে কেবল স্কুল বইখাতা বন্ধ রেখে মোবাইল কিংবা টিভিনির্ভর আপনারাই তো করেছেন তাদের! কাজেই আজ আর শিশুর মনের কথা ভেবে একদম বাকসংযম করবেন না| ক্রোধপ্রকাশের অন্য কোনো শালীন ভাষা বা যুক্তি কিচ্ছুই খুঁজবেন না| সামনে কত কাজ আপনাদের —-
আকাশেতে এখনো অনেক রোদ|
চোখ মেলে শিশুকেই দেখে সে|
ঝরবেও নিশ্চয়|
আনন্দিত রোদের খোকন|
সেদিন শিক্ষকের মহোৎসব|
হ্যাঁ –আমি এক শিক্ষক|
★★লেখাটি উৎসর্গ করলাম —-রোদখোকার সেইদিনের সেই খেলুড়ে দাদীদের |
এই ভাষা, এই অসভ্যতা এতো বেশি ছড়িয়ে পড়েছে, যে নিজেকে অসহায় বোধ করছি