করোনাকালে চিকিৎসা সঙ্কট যত বাড়ছে সাধারণ মানুষের আতঙ্ক ও রাজনৈতিক উত্তাপ তত বাড়ছে। দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা সাত লাখের উপর ও মৃত্যু 21000 ছাড়িয়ে গেছে- আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা তাই স্বাভাবিক। করোনা কিভাবে ছড়ায় তার নানা খুঁটিনাটি নিয়ে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের যাই মতবিরোধ থাকুক না কেন, একটি সর্বজনীন প্রতিরোধের উপায় ইতিমধ্যে সবাই জেনেছেন- মাস্ক, বার বার হাত ধোওয়া ও শারীরিক ব্যবধান। টীকা আবিষ্কার হলে করোনা থেকে মুক্তির পথ প্রশস্ত হবে। যদিও, একথা মনে রাখা দরকার যে, টীকা আবিষ্কার ঘানি থেকে তেল নিষ্কাশনের মত সহজ নয়, এর পথটি জটিল ও মানবদেহে তার প্রয়োগের পথ ও কাঙ্ক্ষিত ফল লাভের পথটি কুসুমাস্তীর্ণ নয়।
প্রশ্ন হলঃ করোনা নিয়ে এই আতঙ্কই কি ভবিতব্য ছিল না, অনতিবিলম্বে করোনা (বা ইত্যাকার মহামারি) যে মারণফাঁসের মত সমাজের শিরদাঁড়া বেয়ে হিমশীতল শৈত্যপ্রবাহের জন্ম দেবে এ কি একান্তই অপ্রত্যাশিত নাকি আমাদের সামাজিক ভাবনা, রাষ্ট্রীয় নীতি ও বিকেবহীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে তার বীজটি উপ্ত ছিল?
দরিদ্র ভারতবর্ষ, নিরন্ন ভারতবর্ষ উৎপাদনের নিরিখে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশগুলির সাথে সমানে টক্কর দিয়ে চলেছে। অথচ, ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা, অপুষ্টি, অনাহার, রক্তাল্পতা ও পাঁচ-বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যু, 18টি মারক রোগের প্রকোপ ও লিঙ্গ বৈষম্যের নিরিখে ভারত একটি পিছিয়ে পড়া দেশ। আরেকটি, ভয়ঙ্কর সমস্যা হল রাষ্ট্রনীতি রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার শিকার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আলমা আটা সম্মেলনে বলেছিলেন যে, রাজনৈতিক উদ্যোগ ও সদিচ্ছা ছাড়া সবার জন্য স্বাস্থ্য সম্ভব নয়। রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও পারস্পরিক বিবাদ সরিয়ে রেখে সব রাজনৈতিক দল যদি “সবার জন্য স্বাস্থ্য” এই মৌলিক দাবীর ব্যাপারে ঐক্যমত অর্জন করতে পারতো তাহলে, এই দেশের রাষ্ট্রীয় পুঁজি ব্যবহার করে অপুষ্টি, অনাহার, অকাল মৃত্যু, লিঙ্গ বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। কিছু মৌলিক ও স্বীকৃত মানবাধিকার আছে যা নিয়ে দরকষাকষি করা যায় না ও সংবিধান-স্বীকৃত জীবনের অধিকারের সাথে যা সংপৃক্ত- স্বাস্থ্য ঠিক তেমন একটি মানবাধিকার।
আমাদের বিধানসভা ও পার্লামেন্টে স্বাস্থ্য নিয়ে বিতর্ক হয় কিন্তু রাষ্ট্রীয় পুঁজি বিনিয়োগ হয় চিকিৎসার জন্য। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা যে আলাদা বিষয় ও বস্তুতঃ চিকিৎসা বৃহৎ স্বাস্থ্যের বাগানে একটি উদ্ভিদ বিশেষ এই ধারণাটি অনেক মহামান্য সাংসদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছেও তেমন স্পষ্ট নয়। বস্তুতঃ স্বাস্থ্য এমন একটি বিষয় যার সাথে মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদার সম্পর্ক আছে।
দেশের জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র অংশ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করান। বেশির ভাগ রোগ হওয়ার আগে প্রতিরোধ করা সম্ভব- তার জন্য একদিকে যেমন গণসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে অন্যদিকে তেমনি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে দেশের প্রতিটি কোণে কোণে সুদক্ষ ও কর্মকুশল কর্মী তৈরী করতে হবে- অবশ্য দেশের সিংহভাগ মানুষের হাসপাতালে ভর্তি হবার দরকার পড়ে না অথচ রাষ্ট্রীয় খরচের সিংহভাগ চিকিৎসার জন্য খরচ হয়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার জন্য স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র 35% খরচ হয়- সেটাও বেশির ভাগটাই মাইনে দিতে খরচ হয়। প্রতিরোধমূলক এই ব্যবস্থার একটি পরিকাঠামো এই রাজ্যে আছে কিন্তু তা ব্যবহার করার পদ্ধতি ও প্রকরণ বেঠিক। গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা মানুষকে বোঝানো হয়নি, অবশেষে বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামে যে যুবক চিকিৎসকের দায়িত্ব সাধারণ মানুষের শিক্ষক ও বন্ধু হিসেবে প্রতিরোধ ও উন্নয়ন (prevention and promotion of health) প্রক্রিয়ার বিস্তার ও প্রসার তা হয়ে ওঠে না। গ্রামের মানুষ তাঁকে কেবল চিকিৎসা করানোর ক্ষুদ্রতর কাজে সীমাবদ্ধ রাখতে চান। চিকিৎসক ও তাঁর প্রশিক্ষণ পর্বে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার খুটিনাটি জেনে আসেন না, জানলেও তা নিয়ে তাঁর আগ্রহ কম, তার যথার্থ কারণ ও আছে।
একজন প্রতিরোধ বিজ্ঞানীর সম্মান ও প্রাপ্তি নিয়ে সামাজিক ভাবনার মধ্যে চিকিৎসকের অনীহা জড়িয়ে আছে। একজন নব্য চিকিৎসক যদি তাঁর কাজের প্রেরণা ও স্বীকৃতি না পান তাহলে তা নিয়ে আগ্রহ জন্মাবে না। প্রতিরোধ বিজ্ঞানীর কাজে আশু ফললাভ হয় না বলে তাঁর কাজের সামাজিক স্বীকৃতি মেলে না। তাঁর অধীত বিদ্যা ও জ্ঞানের ফলিত প্রয়োগ তখন হবে যখন তৃণমূল স্তরে উন্নয়ন ও সম্পদ বন্টনে তাঁর পরামর্শ গ্রহণযোগ্যতা পাবে। অথচ, গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন মডেলের কোন স্তরে চিকিৎসকের সাহায্য ও সহযোগিতা নেওয়া হয় না। বিডিও সমস্তরের একজন অফিসার হওয়া সত্বেও রাষ্ট্রের কাছে যতটা মূল্যবান প্রতিরোধ চিকিৎসা বিজ্ঞানী যে তার ধারে কাছে নেই তা বলা বাহুল্য। ফলে, চিকিৎসক ও তাঁর এই প্রাথমিক কর্তব্যটি দায়সারা ভাবে নেন, যদিও নিরাময় মূলক চিকিৎসক হিসেবে তাঁদের দায়বদ্ধতা প্রশ্নাতীত– ব্লকের দ্বিতীয় মেডিকেল অফিসারের কাজে যে প্রতিরোধ ও উন্নয়ন মূলক কাজের বর্ণনা আছে তা সোনার পাথরবাটি থেকে যায়, তার বাস্তব প্রয়োগ হয় না।প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মূল ভাবনাটি তাই ব্যর্থ হয়েছে।
দেশে তথা রাজ্যে তাই সঠিক স্বাস্থ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে নি। তুলনামূলক কম আয়ের ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলি বিশেষতঃ কিউবা প্রতিরোধ যোগ্য অসুখ যে দ্রুততার সাথে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে পারে তার একটি কারণ অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত গণচেতনা, যেটি আমাদের দেশে বিরল।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই মডেল রাষ্ট্রের নিজস্ব হতে হবে। তা ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবার জন্য অভিন্ন হতে হবে। না হলে এর প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস তৈরী হবে না। এই ব্যবস্থার শীর্ষে চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে উঠুক কিন্তু মর্যাদার দিক থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও শীর্ষ প্রতিষ্ঠান যেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বরাট থাকতে পারেন তাঁর রাষ্ট্রীয় নিশ্চয়তা দরকার।
আজ করোনা-তীরে সমগ্র দেশবাসী আহত ও আশঙ্কিত। কাল নতুন মহামারি আসতে পারে । সঠিক স্বাস্থ্যাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য একদিকে যেমন প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যে জোর দিতে হবে, তেমনি দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই চেতনা গেঁথে দেবার প্রক্রিয়া প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করতে হবে। স্বাস্থ্যের ন্যূনতম ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক ঐক্যমত গড়ে তোলা দরকার যেন ক্ষমতার হাত বদল হলেও নীতি বদলে না যায়।
এই সব গড়ে তোলা ও তার রক্ষণাবেক্ষণের একটা খরচ অবশ্যই আছে। তবে, রাষ্ট্রীয় পুঁজির খুব সামান্যই এর জন্য খরচ করতে হবে। দেশের মোট উৎপাদনের মাত্র 2.5-3% খরচ করলেই এই ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। এর পরও কিছু টাকা সব মানুষের পকেট থেকে খরচ হতে পারে কিন্তু অসুস্থ হলে অন্ততঃ ঘটিবাটি বিক্রি করতে হবে না, এ নিশ্চয়তা দেওয়া যায়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য ভালো না করতে পারলে রুগ্ন ব্যবস্থার কাঁধে চেপে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যাবে না।
রুগ্ন ও সাধারণ কিছু কথা লিখে খাতা ভর্তি করা হয়েছে