(১৬)
আলো আর অন্ধকারের মধ্যে এক নিরন্তর প্রবাহমানতা আছে। অন্ধকারের বুকেই আছে আলোর সম্ভাবনা। মাতৃজঠরের অন্ধকার পেরিয়ে শিশু আলোয় জন্ম নেয়। রাতের অন্ধকার থেকে জন্ম নেয় ভোর। সমাজের অবহেলিত সাধারণ মানুষগুলোর সামগ্রিক অবচেতনার অন্ধকারে তেমনই লুকিয়ে আছে আলোর সম্ভাবনা। নিকষ কালো রাতের গভীরে অস্থির পায়ে পায়চারি করতে থাকে মানুষটা। উঠোনের টিম টিম করা টেমির আলোয় দীর্ঘ ছায়াখানা পেয়ারা গাছের আগল পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দূরে। কে জ্বালাবে দীপ? কে সেই অন্ধকার চিরে বের করে আনবে নব জাতককে?
১৯৮২ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে ইউনিয়ন অফিসের পাশের গ্যারেজে ডিস্পেন্সারি চালু হয়েছিল।এই এক বছর ধরে সকাল বিকেল দু’বেলা পুরোদমে রুগী দেখা চলেছে সেখানে। তার আগে ডাক্তারবাবুদের কাজ ছিল নানা মহল্লায় ঘুরে ঘুরে লোক জড়ো করে স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলা। কিন্তু শুধু বক্তৃতা দিয়ে কি উপযোগীতা বোঝানো যায়? চিকিৎসা পরিষেবা দিতে না পারলে তারা হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা বুঝবে কি করে? যাক এই গ্যারেজ ডিস্পেন্সারি চালু হতে মানুষের মনে বিশ্বাসের ভিত শক্ত হয়েছিল। শঙ্কর জানে এই আদিবাসী জনজাতির চেতনার গতিপথ উর্ধ্ব গামী করতে গেলে তাদের সামগ্রিক বিকাশের পথ সুনিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা এই দুই স্থম্ভ মজবুত না হলে কিছুতেই সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব নয়। বুদ্ধিজীবী ডাক্তারদের এই কাজে পাশে লাগবে, তাঁরা তাঁদের জ্ঞানের আলোয় উদ্দীপ্ত করবেন কৃষক ও শ্রমিকের জীবন। কিন্তু মানুষের মতো মানুষ হওয়ার এই লড়াই তো আসলে এই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের। তাই তাদের বলিষ্ঠ করে গড়ে তুলতে হবে। তারা বুঝে নিক তাদের লড়াই।
শংকর উপলব্ধি করতে পারে বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে কাজ করার কিছু সমস্যা আছে। এঁরা যখন জনগণের কাজ করতে আসেন সেদিন থেকেই বন্দুকের নল দেখতে পান। কারণ মধ্যবর্গীয় এই বুদ্ধিজীবীর দল বিমূর্ত স্তর পেরিয়ে বিভিন্ন সম্ভাবনা ও শাসক শ্রেণীর প্রতিক্রিয়া দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা রাখে। হয়তো তাঁদের শিক্ষা, বুদ্ধি ও দূরদর্শিতার কারণে এটা সম্ভব। কিন্তু শ্রমিকদের সে ক্ষমতা নেই। তারা পুলিশের বন্দুকের নল দেখতে পায় প্রবল সংগ্রামের পর। তারা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায় যা ঘটে তাই বোঝে। তারা বোঝে ভিলাইয়ের হাসপাতালের ডাক্তার তাদের ছুঁতে চায় না, তাই চিকিৎসা পরিষেবা পেতে তারা নিজেদের কামাইয়ের পয়সায় হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। হলও তাই। এই বছর জুন মাস থেকে চালু হয়েছে শহীদ হাসপাতাল। শয্যা সংখ্যা ১৫। শংকরের মাঝে মাঝে মনে হয় এসব সম্ভব হয়েছে হয়তো শ্রমিকরা বিমূর্ত চিন্তা করতে পারে না বলেই। তাদের কাছে সমস্যাটা ছিল খুব কাছের, খুব নিজের। তাই হয়তো তারা পেরেছে আইডল ওয়েজ আদায় করতে। ভারতে দল্লিরাজহরার শ্রমিকরাই প্রথম যারা কাজে গিয়ে যখন মালিক কাজ দিতে পারে নি তখন তাদের ন্যূন্তম মজুরীর আশি শতাংশ আদায় করেছে আইডল ওয়েজ হিসাবে। সেই পয়সা জমিয়ে কেনা হয়েছে হাসপাতাল তৈরির জন্য ইট-পাথর-সিমেন্ট। মাল বইতে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে প্রগতিশীল ট্রাক-ওনার্স অ্যাসোশিয়েশনের লোক জন। হাসপাতালের আসবাবপত্র বানিয়ে দিল শহীদ ইঞ্জিনীয়ানিং সংস্থা। শূন্য থেকে শুরু করে আজ হাসপাতাল গড়ে তোলার এই কাজে শ্রমিকদের যেন নতুন জন্ম হল অন্ধকার থেকে যেন আলোয় উত্তরণ। এখন ঠিক হয়েছে ইউনিয়নের প্রত্যেক সদস্য তাদের এক্ মাসের মাইন্স অ্যালাউন্স আর হাউস রেন্ট অ্যালাউন্স চাঁদা হিসাবে দেবে। এই জমানো পুঁজি দিয়েই কেনা হবে ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি। পরিকল্পনা করা হয়েছে কিছু টাকা দিয়ে কেনা হবে একটা পুরোনো ট্রাক। সেটাকে জলের ট্যাঙ্কার করে খনিতে লাগানো হবে যাতে ডাক্তারদের ভাতার বন্দোবস্ত করা যায়। রোগীদের কাছ থেকেও সামান্য কিছু টাকা খরচ বাবদ নেওয়া হত।
গত বছর কিশোর ভারতী থেকে যে চারাগুলো আনা হয়েছিল সেগুলো ইউনিয়ন অফিসের পিছনের বাগানে লাগানো হয়েছিল। এবছর সেগুলো ফলে ফুলে পল্লবিত হয়েছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ শংকরের পরম শিক্ষক। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ সম্ভব তা যেন এই প্রকৃতি মা-ই শিখিয়েছে তাকে। শংকর তাই মাঝে মাঝেই উধাও হয় জঙ্গলের মাঝে। যখন যেখানে সে যায় সঙ্গে করে সেই অঞ্চলের গাছ নিয়ে এসে রোপন করে এই ছত্তিশগড় ভূমিতে। বস্তার জেলার উত্তরে দুর্গ জেলার দক্ষিণ অংশে ওদের কাজের জায়গা। কিল্লেকোড়া পাহাড় যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে দল্লী, ঝরনদল্লী,রাজহরা, মহামায়া পাহাড়গুলোর মধ্যে দিয়ে বহমান তিন নদী। এই এলাকা লোহার আকরে পূর্ণ। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও এসব অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। সেই জঙ্গলের ধারে ধারে ছিল ছোট ছোট আদিবাসী গ্রাম। তারা ছিল গোঁড় উপজাতির মানুষ। পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তাদের বসবাস। সমস্ত এলাকা নানা পাখির কলতানে, ঝরণার জল তরঙ্গের শব্দে মুখরিত হয়ে থাকত। সেই তালে তাল মেলাতো আদিবাসীদের দলবদ্ধ নাচ আর মাদল সঙ্গীত। এরপর শুরু হল খনির কাজ। একদিন জিয়োলজিকাল সার্ভের লোকজন এল, এল রুশ টেকনিশিয়ানের দল, সঙ্গে ভারতীয় ইঞ্জিনীয়রের দল। ব্লাস্টিং এর শব্দে কেঁপে উঠল সমস্ত বন ভূমি। বারবার ব্লাস্টিং এর আওয়াজে, বুল ডোজারের আর ডাম্পারের ঘড় ঘড় শব্দে মানবসভ্যতার দানব দাপিয়ে বেড়াতে লাগল সমস্ত অঞ্চল। ছোট বড় অসংখ্য গাছ মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল। নদীর জল লোহার আকরে রক্ত রাঙা হয়ে উঠল। বিনাশের ধ্বংসলীলার ওপর বিকাশের রাজ প্রাসাদ গড়ে উঠল। এই বিকাশ শংকরকে ভাবায়। ভেতর থেকে তার চেতনা আন্দোলিত হয়। জাতির মননে চেতনার উন্মেষ না হতে পারলে এই অসম বিকাশ গ্রাস করবে সমগ্র ভুবন। চিন্তার কালো মেঘ শংকরের মন কে আচ্ছন্ন করে তোলে। এই ক’বছরেই জায়গাটার ভোল বদলে গেছে। সিমেন্ট কারখানা, সার কারখানা, ডিস্টিলারি প্ল্যান্ট……এ সবের ধাক্কায় বাতাসে দুর্গন্ধ, জলে বিষ, মেশিনের শব্দ, আকাশ বাতাস নদীর জল বিষিয়ে উঠল ক্রমে। করাত কল মালিকরা, রাজনন্দ গাঁও, দুর্গ, রায়পুরের বড় ব্যবসায়ীরা আদিবাসী গ্রামের ওপর বড় বড় অট্টালিকা হাঁকিয়ে আয়েশ করছে আর এদিকে আদিবাসী জীবন হয়ে উঠল বিপর্যস্ত, পশু পাখিরা হারাল তাদের অবারিত বিচরণ। এই পৃথিবী শংকরকে ক্লান্ত করে তোলে। এই পৃথিবীতে মানুষ টেলিভিশনে নদী ও সমুদ্র দেখে, বড়ো বড়ো কোম্পানী অফিসে আদিবাসী যুবতীর অর্ধ নগ্ন শরীরের কিংবা জঙ্গলের অয়েলপেন্টিং ঝুলিয়ে নিজেদের বন্য সংস্কৃতির প্রতি টান জাহির করতে চায়। টাইগার হিলের সূর্যোদয়, কিংবা গোয়ায় আরব সাগরের বুকে সূর্যাস্ত দেখতে যায়। এই বনজ জীবনের সঙ্গে সেই কৃত্রিমতার কোনও তুলনা চলে না। একই মানুষের মধ্যে কত ভিন্ন সত্ত্বা থাকে। চেতনার উন্মেষ হলে মানুষ সেই ভিন্ন ভিন্ন সত্ত্বা সম্বন্ধে সচেতন হতে পারে। শংকর জানে তার মধ্যে আছে ভাবুক একটা সত্ত্বা, যেই সত্ত্বা প্রকৃতির কোলে শান্তি খোঁজে। পাখির কলতান, ঝরণার তির তির বয়ে যাওয়ার শব্দ, হরিণের ত্রস্ত ছুটে যাওয়া এই সব তার কবি সত্ত্বাকে ছুঁয়ে যায়। পুরনো ছেড়ে আসা কবিতার খাতাটার জন্য মন কেমন করে ওঠে। আর মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় অনেক দূরে হারিয়ে যাওয়া একটা জীবনের কথা। মনে পরে দামোদরের কথা, সাঁকতোড়িয়ার কথা, কৈশোরের উন্মাদনার কথা। প্রবাহমান জীবনের দাবী মেনে এগিয়ে চলেছে সে। এখন এতগুলো মানুষ তার মুখের দিকে চেয়ে আছে, কখন জানি তাদের একজন হয়ে গেছে সে। সে বিপ্লবী, কিন্তু তার চেতনার পরতে পরতে বিছিয়ে আছে একজন এমন মানুষ যে এই পৃথিবীকে অন্তর দিয়ে ভালবাসে, এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ দীর্ঘ দিন ধরে উপভোগ করতে চায়। এই পৃথিবীর ক্ষয় তাকে ক্লান্ত করে তোলে তার মন ক্লিষ্ট হয়ে ওঠে।
এই সব ভাবনায় ডুবে থেকে খেয়াল করতে পারে নি কখন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা টুপ টাপ করে ঝরে পড়তে লাগল। বড় বড় পা ফেলে সুঁড়ি পথ বেয়ে নামতে লাগল সে। দীর্ঘদেহী মানুষটার পায়ের ছাপ থেকে গেল সোঁদা মাটির বুকে।
ক্রমশঃ…