জেল থেকে দু’মাস পরে ছাড়া পেয়ে শংকর যখন রাজহরায় পৌঁছল চারদিকে যেন উৎসবের আমেজ। শংকর জেলে ছিল বলে হোলি এবার পালন করা হয় নি। এখন শ্রমিকরা যেন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠল। লাল সবুজ ফাগে রাঙা হয়ে উঠল মানুষের শরীর, মন আর দল্লী রাজহরার মাটি। এখন আন্দোলন চূড়ান্ত গতি পেয়েছে তাই এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এই বছরটা তাদের কর্মসূচী নিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা করতে হবে। আজকাল আশা আর ছেলে মেয়েদের জন্য মাঝে মাঝেই খুব মন কেমন করে।এত কাজের চাপ যে ওদের সময় দিতে পারে না মোটেই। ভিলাইয়ে ওদের নিয়ে যেতে হবে এবার। ছেলে মেয়েদের সুশিক্ষা দেওয়াটাই জরুরী কাজ। সেটায় অবহেলা করা ঠিক নয়। অবশ্য শংকর যেটুকু সময় পায় চেষ্টা করে বাচ্চাদের সঠিক পথ দেখাবার। সব্জি খাওয়া কেন দরকার, টেরিকট টেরিলিন না পরে কেন সুতির জামা পরা দরকার, দেশের জন্য কাজ কেন করতে হবে সময় পেলেই গল্পের ছলে এসব শেখাবার চেষ্টা করে সে। বাচ্চাদের অংক শেখানোর জন্য বিশেষ বিশেষ পদ্ধতি মাথা খাটিয়ে বার করতে ভালই লাগে। এদিকে চারদিকে বাজনার আওয়াজ, বাজি পোড়ানোর শব্দ, শ্রমিকদের উল্লাস, রঙের মাতোয়ারা, বিশাল জমায়েত এসব কেমন যেন শংকরের ব্যক্তিগত জীবন, চাওয়া পাওয়াকে ছাপিয়ে গেল। ভিড়ের উন্মাদনায় তিন চার বার পায়ের জুতো হারিয়ে গেল। এইভাবে তিন চার কিলোমিটার হেঁটে শংকর মঞ্চে এসে পৌঁছল।শ্রমিকদেরকে আগামী পরিকল্পনার কথা বলতে চায় শংকর। জলদ গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে শংকর , “ভাই সকল, আজ সময় এসেছে আমাদের জোর গলায় বলতে হবে, ছত্তিশগড় লুটেরাদের জায়গির নয়, ছত্তিশগড় আমাদের…….”। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল দুই মাস। আন্দোলনের চাপে শংকর জেল থেকে ছাড়া তো পেল কিন্তু দুর্গ জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দিল শংকর ছত্তিশগড়ের পাঁচটি জেলায় তার সংগঠন ও আন্দোলন আছে সেখানে ঢুকতে পারবে না।
শুভ এমন আর এক বড় শ্রমিক আন্দোলনের সাক্ষী। দল্লি-রাজহরা ভারতের একমাত্র বড় লোহা খনি যাকে সরকার পুরোপুরি মেকানাইজড করতে পারেনি। ১৯৭৯ থেকে আন্দোলন করে শ্রমিক ইউনিয়ন জুলাই ইস্পাত প্রকল্পের ম্যানেজমেন্টকে বাধ্য করেছে সেমি-মেকানাইজেশনের প্রস্তাব মেনে নিতে। পূর্ণ মেকানাইজেশন মানে শ্রমিকদের ছাটাই, বিদেশি মেশিনের পেছনে খরচ, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং এলাকার অর্থনীতি বেকারির জন্য বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়া। কিন্তু সেমি মেকানাইজেশনে শ্রমিক ছাটাই হয় না। এক্ষেত্রে মানুষের জন্য যে গুলো বিপদজনক উৎপাদন প্রক্রিয়া সে গুলোর জন্য মেশিন ব্যবহার হয়। উৎপাদন খরচ থাকে কম, এলাকার অর্থনীতি অটুট থাকে। শংকরের এই সেমি মেকানিজমের প্রস্তাব এক অনবদ্য সৃষ্টিশীলতার নিদর্শন।
শংকরের সংস্পর্শে এসে শুভ-র জীবন কখন যে এক অন্য গতিপথে বইতে শুরু করেছে তার খবর সে নিজেই জানে না। আদ্যোপান্ত বাঙালি ছেলে হয়ে গড় গড় করে হিন্দি বলতে শিখেছে, শংকরের অনুপ্রেরণায় এবং আন্দোলনেরই প্রয়োজনে লিখতে শিখেছে, কিছুটা ছবি তুলতে, কিছুটা ছবি আঁকতে শিখেছে। শংকরের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করেছে, তর্ক-বিতর্ক করেছে, ঝগড়াও করেছে কখনো-সখনো। ভোর হোক বা গভীর রাত—কখনো তাঁকে রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক আলোচনায় ক্লান্ত হতে দেখেনি শুভ। আলোচনা বা তর্ক-বিতর্ক করার সময় কখনো তিনি বুঝতে দেন নি যে, শুভ তাঁর চেয়ে আঠেরো বছরের ছোট, তত্ত্বজ্ঞান বা অভিজ্ঞতায় শুভ অত্যন্ত নগণ্য। শংকরকে দেখেই শেখা রাজনৈতিক আলোচনায় অহমিকার কোনও স্থান নেই।যুক্তিই সেখানে প্রধান।
১৯৭৯-এ ছাত্র রাজনীতি করা শুরু করার সময় থেকেই শুভ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠনের সদস্য পদে থেকেছে। কিন্তু ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা তে গণতন্ত্রের যে প্রয়োগ হতে দেখেছে তেমনটা কখনও দেখে নি। শংকরের ‘আন্দোলনের সমস্যা’ নামক প্রবন্ধে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা নিয়ে এক ছোট অথচ মূল্যবান আলোচনা করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে সংগঠন চালানোর প্রয়াস এই ছত্তিশ মুক্তি মোর্চার সব সংগঠনগুলিতে লক্ষ্য করেছে শুভ। আন্দোলনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত, সংগঠন সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ের সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে করা হয়। সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার জন্য কেন্দ্রিকতার আশ্রয় নেওয়া হয়। সপ্তাহে একটা দিন বিকেল মুখিয়া মিটিং-এর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। খনি-র প্রতিটা এলাকা, শহরের প্রতিটা মোহল্লা থেকে তিনশো-র বেশি মুখিয়া আসেন এই মিটিং-এ। আলোচ্য বিষয় নিয়ে প্রচুর আলোচনা করা হয়। এই মিটিং গুলোর প্রথম পর্যায়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শংকর থাকে না। তার পিছনেও সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত কাজ করে। শংকরকে দেখে পিছিয়ে থাকা শ্রমিক প্রতিনিধিরা মুখ খুলতে সংকোচ বোধ করেন, তাই ইচ্ছা করেই এই অনুপস্থিতি। এই মিটিং-এ যে সিদ্ধান্ত হয়, তা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। পরের দিন কাজ শুরুর আগে মুখিয়ারা নিজ নিজ এলাকায় সাধারণ শ্রমিকদের নিয়ে মিটিং করে আগের দিনের আলোচনার রিপোর্টিং করেন। সাধারণ শ্রমিকরা আগের দিনের সিদ্ধান্তকে মঞ্জুর করলে তবে সংগঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নয় তো তাঁদের মত নিয়ে আবার মিটিং-এ বসেন মুখিয়ারা। অর্থাৎ সংগঠনের যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে সব শ্রমিকের মতামত গুরুত্ব পায়। আজ পাঁচ বছর ধরে শংকরকে দেখছে শুভ। একজন মানুষ কি নিরবিচ্ছিন্নভাবে
মাকর্সবাদ-লেনিনবাদকে জীবনে, কাজ-কর্মে, প্রতিটি আন্দোলনে প্রয়োগ করে চলেছেন। শুভ আগে যে সব মাকর্সবাদী-লেনিনবাদী নেতা দেখেছে তাদের মতো শংকর কথায় কথায় উদ্ধৃতি আওড়ায় না। শুভ ছত্তিশগড়ে এসেছিল পেশা হিসেবে ডাক্তারি করতে আর তার পাশাপাশি রাজনীতি করবে বলে। রাজনীতি করা বলতে সে বুঝত মিটিং-মিছিল, কিছু অ্যাকশনে অংশ নেওয়া। কিন্তু কখন যেন এক গভীর জীবন বোধ, সমাজ সচেতনতা আর নিরলস নিষ্কাম কর্মের পাঠে শিক্ষিত হয়ে উঠল সে বুঝতেও পারল না। এক দীপের শিখা থেকে আর এক দীপের শিখা জ্বলে ওঠল যেন।