নয় নয় করে নব্বই দশকের এই দ্বিতীয় বছরটাও বিভিন্ন শেষ হতে চলল। শুভ হাসপাতালের কাজে ব্যস্ত এমন সময় ইউনিয়ন অফিস থেকে জরুরী তলব। হাতের কাজ সেরে সেখানে গিয়ে শুনল নিয়োগীজির ফোন এসেছিল। শুভকেও ভিলাই ডেকে পাঠিয়েছে। শংকরের সঙ্গে যাত্রার মজাই আলাদা। যদিও শুভ ঘুরতে বেড়াতে মোটেও পছন্দ করে না। কিন্তু নিয়োগী ডাকলে সে যেন যাত্রাপথের সঙ্গটুকুর জন্য উৎসুক হয়ে পড়ে। সারা রাস্তা শংকরের কাছ থেকে কত যে নতুন দৃষ্টিকোণ দিয়ে সমস্যাকে দেখতে শেখা যায়! এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। সারা রাস্তা নানা পরিকল্পনা করতে করতে চলল ওরা — শংকর, জনকলাল ঠাকুর যিনি ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার সভাপতি এবং ডোন্ডী-লোহারার ভূতপূর্ব বিধায়ক আর শুভ। Update from Chhattisgarh-এর গুণগত মান উন্নত করতে হবে, ছত্তিশগড়ী ভাষা-প্রসারের জন্য ‘লোকসাহিত্য পরিষদ’-এর ‘ছত্তিশগড়ী ভাষা প্রসার সমিতি’ গড়তে হবে, শ্রমিক-কবি ফাগুরাম যাদবের ক্যাসেট বানাতে হবে, আন্দোলনে বিজয়ের পর ভিলাইয়ে হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। এত সব আলোচনা করতে করতে ট্রেনে চলতে থাকল ওরা। চায়ে -চায়ে- গরম চায়ে….. চা নেওয়া হল মাটির খুরিতে। বেশ সুবিধাজনক খুরিগুলি। মুখ ছোট হওয়ায় চা চলকে পড়ে না। শংকরের খুব ভাল লাগল। খুরিটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকল সে। চট করে একটা স্যাম্পেল খুরি পকেটে ঢুকিয়ে নিল ছত্তিশগড়ের কুমোরদের দেখাবার জন্য। দিল্লি যাওয়ার উদ্দেশ্য শ্রমিকদের সমস্যা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরা। শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা নিজেরাই বলুক তাদের কথা।
যাই হোক কাজ মিটে গেলে দিল্লিতে আরও দু’দিনের জন্য থেকে গেল শুভ। কাল জনকজী অন্য সাথীদের নিয়ে রওনা দিয়েছেন ছত্তিশগড়। এই থেকে যাওয়া দীর্ঘায়িত করার সিদ্ধান্ত শংকরের। সেই সুবাদে ভিলাই আন্দোলনের সমর্থক এমন অনেকের সঙ্গে পরিচয় হল শুভ-র। সাংবাদিক এবং শুভাঙ্কাক্ষী পরিবেষ্টিত গুহনিয়োগী এখন প্রদীপের শিখার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন। শুভ ফিরে এল, শংকর থেকে গেল আরও কিছু দিনের জন্য। লেখালেখির কাজ, হসপিটাল এই সব নিয়ে একরকম কাটছে। ফিরে এসেই অলকানন্দাকে বিস্তারিত খবর দিয়ে একটা লম্বা চিঠি লিখল। সেদিন মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, হাসপাতালে ছুটি, সারা সকাল ইউনিয়ন অফিসেই কেটেছে। বিকেলের দিকে কোয়ার্টারে এসে শুভ সবে রাতের রান্নার জোগাড় করবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় রাজনাদগাঁও-এর সংগঠক আনসার এসে খবর দিল—‘ডাক্তারসাব, নিয়োগীজী বুলা রহে হ্যাঁয়’। কি জ্বালাতন! এখন আবার কাজ ফেলে ছুটতে হবে ইউনিয়ন অফিস! একটু বিরক্তভাব নিয়েই শুভ গিয়ে দাঁড়াল নিয়োগীজির সামনে। বিষয়টা হল শংকর ভিলাই যাবে। তার আগে কয়েকটা ফাইল লাগবে সেগুলো শুভকে রেডি করে দিতে হবে। টেলিফোন নাম্বারের লিস্ট, ভিলাই আন্দোলনের ছবি, দিল্লিতে ধরনার বিস্তারিত তথ্য…… এসবের ফাঁকে ফাঁকে চলছে নিয়োগীজির অনর্গল কথা। কত কথা বলে চলেছে সে। তার বইয়ের প্রচ্ছদ কেমন হবে খুঁটিনাটি বিবরণ।Update–এর কোয়ালিটি ভালো করতে হবে, ইলেক্ট্রনিক টাইপরাইটার এনে দেবে শুভ-র যাতে লেখার কাজে সুবিধা হয়। ভোপালে মুখ্যমন্ত্রী পাটওয়া ও শ্রমমন্ত্রী লীলারাম ভোজওয়ানীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের গল্প। শুভ ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে পড়ছে। রান্নাটা সেরে নিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু নিয়োগীজি আজ ছাড়তেই চাইছে না যেন। সন্ধ্যের রাউন্ডের সময় হয়ে যাচ্ছে বলে যত বারই শুভ উঠতে যাচ্ছে শংকর আরও কিছু কথা আছে বলে শুভকে আটকে দিচ্ছে। যেন কিছু বলতে চাইছে সে, শুভ বুঝে উঠতে পারছে না। আপসে আউর কুছ বাত করনী হ্যাঁয়’। এমন সময় এক ঠিকাদারের ম্যানেজার এল কিছু সমস্যা নিয়ে। শুভ জোর করেই উঠে পড়ল। নিয়োগী বললেন—‘যাতে ওয়ক্ত হাসপাতালমেঁ আপসে মিলকর যাউঙ্গা’। রাতে বিছানায় শুয়ে শুভ র কানে বাজতে থাকল শংকরের বলা কথাটা। কই নিয়োগী তো এলেন না!
খবরটা শুনে হতভম্ব শুভ কিছুক্ষণের জন্য পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না। ইতিমধ্যে খবরটা আগুনের শিখার মতো ছড়িয়ে পড়ল ছত্তিশগড়ের বনে, পাহাড়ে, আদিবাসী মানুষের মধ্যে……এক অন্ধকার সকালের মুখোমুখি আপামর খেটে খাওয়া মানুষের দল।
২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ তিন শ্রমিক-সাথীর সঙ্গে মিলে দুর্গের মর্গ-ঘরের টেবিল থেকে শুভ নামিয়ে আনল তাঁর রক্তে ভেজা মরদেহ। মৃত্যুর পর প্রায় নয় ঘণ্টা কেটে গেছে, অথচ তখনও তাঁর পিঠের গুলির ক্ষত থেকে ঝরে পড়ছে তাজা লাল রক্ত। ভেতরে ভেতরে ভঙ্গুর হয়ে যাছে শুভ-র মন। তার নেতা, তার সহযোদ্ধা, তার শিক্ষক শংকর গুহনিয়োগী শহীদ হয়েছেন। বীর কমরেডের মরদেহ ঢেকে দেওয়া হল ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার লাল-সবুজ পতাকা দিয়ে।২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর, প্রায় চব্বিশ ঘন্টা শুভ থাকল শংকরের সঙ্গে। দেশি
পিস্তলের বুলেটের ছ-টা ছররা পিঠ ফুঁড়ে হৃৎপিণ্ডকে ফুটো করে দিয়েছে, অথচ মানুষটার মুখে যন্ত্রণার লেশমাত্র নেই। শুভ তাকিয়ে থাকে শংকরের মৃত মুখের দিকে। তার নেতার মুখে মৃদু একটা হাসির ছোঁওয়া লেগে আছে। যেন এই ঘুম থেকে উঠে বলবে ‘আপকে সাথ জরুরী কুছ বাত থা ডক্টর সাব’। শুভ মরমে মরে যেতে থাকে। কি সেই কথা যা না বলাই রয়ে গেল!
শঙ্কর গুহনিয়োগীর পরিকল্পনাগুলো নিয়ে লিখতে পারেন।