১৭ এপ্রিল, ২০২৫ নারী দিবস উদযাপন মঞ্চ ও অভয়া মঞ্চের যৌথ উদ্যোগে নারী দিবস উদযাপন মঞ্চের পঞ্চম লিসনিং সার্কল অনুষ্ঠিত হল রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে অ্যাসোসিয়েশান অফ হেল্থ সার্ভিস ডক্টরস এর অফিসে। দু’জন সরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত প্রবীণ নার্স তাঁদের পেশাগত দাবি দাওয়া এবং তাঁদের কাজের ও আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন একটি ঘরোয়া আলোচনা চক্রে।
এই অনুষ্ঠানে দুজন বক্তার একজন ‘নার্সেস ইউনিটি’ সংগঠনের ভাস্বতী মুখোপাধ্যায়, যিনি পিজি হাসপাতালের অধীনে একটি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত। অন্যজন সুব্রতা সরকার, যিনি দীর্ঘ দিন নার্সিং শিক্ষকতা করেছেন, আর জি কর নার্সিং কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ২০১৭ সালে শুরু করেন নার্সিং নেটওয়ার্ক অব ইন্ডিয়া, উদ্দেশ্য ‘কেয়ার ফর দ্য কেয়ারগিভার্স’।
নারী দিবস উদযাপন মঞ্চ ‘মেয়েদের শ্রমের মুল্য, নারী শ্রমিকের মর্যাদা’ নামক একটি দাবিপত্র প্রকাশ করেছিল আগেই। গত ৮ মার্চ রামমোহন লাইব্রেরি রায়া দেবনাথ মেমোরিয়াল হলে নারী দিবস উদযাপন মঞ্চ আয়োজিত অনুষ্ঠানে অভয়া মঞ্চ এবং জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস এর অন্যতম কনভেনর ডঃ পুণ্যব্রত গুণ হাসপাতালে নার্সদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। ১৭ এপ্রিলের অনুষ্ঠানে সুব্রতা সরকার এবং ভাস্বতী মুখোপাধ্যায়ের আলোচনা নার্সিং পেশায় যুক্ত মহিলাদের সুবিধা অসুবিধা এবং দাবিগুলিকে যথাযথ ভাবে তুলে ধরে।
ভাস্বতী মুখোপাধ্যায় বলেন আমাদের দেশে নার্সদের কাজের কোনও স্বীকৃতি নেই বরং নানা ভাবে নার্সদের কাজকে উপেক্ষা ও অবহেলা করা হয়। ডাক্তাররা তাঁদের কাজের জন্য বিখ্যাত হন কিন্তু কোন বিখ্যাত নার্সের কথা শোনা যায় না। আমাদের দেশে কোন ফ্লরেন্স নাইটিংগেল বা তাঁর সমতুল্য নার্স কখনো পাওয়া যাবে না কারণ এখানে নার্সদের কাজের মর্যাদা দেওয়া হয় না। ক্রিটিকাল রোগী ভাল হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে নার্সদের অবদান স্বীকার করা হয় না। কভিডের সময়, জুনিয়র চিকিৎসকদের ধর্মঘটের সময় সিনিয়র চিকিৎসকরা প্রশংসিত হয়েছেন যখন কোন স্বীকৃতি ছাড়াই নার্সরা সামনের সারির সৈনিকের মত অক্লান্ত পরিশ্রম করে হাসপাতালকে স্বাভাবিক রেখেছেন।
নার্সদের পে স্কেল নিয়ে চরম বৈষম্য চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। জি এন এম নার্সরা সরকারি চাকরিতে গ্রেড টু কর্মী। নার্স ছাড়া অন্য সব সরকারি গ্রেড টু কর্মীদের স্কেল ১২, হাসপাতালে নন মেডিক্যাল সুপার সেন্ট্রাল স্কেল অনুযায়ী পান স্কেল ১৪, সেখানে নার্সরা রয়ে গিয়েছেন ৯ স্কেল-এ। নার্সদের দাবি, অন্তত ১২ করতে হবে তাঁদের স্কেল।
ভাস্বতী মুখোপাধ্যায় বলেন এই নিয়ে হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘ আইনি লড়াই চলছে নার্সেস ইউনিটি সংগঠনের নেতৃত্বে।
সরকারি ক্ষেত্রে নার্সদের নিয়োগ কার্যত বন্ধ। ইন্ডিয়ান নার্সিং কাউন্সিলের (INC) সুপারিশ অনুযায়ী রোগী এবং নার্সের অনুপাত হওয়া উচিত স্পেশাল ইউনিটে ১:১ এবং জেনারাল ইউনিটে ৫:১। এখন কলকাতার সরকারি হাসপাতালে স্পেশাল ইউনিটে ৫:১ এবং জেনারাল ইউনিটে ৩০/৩৫:১। কোন প্রান্তিক অঞ্চলে এই অনুপাত ৬০/৭০ :১। এই অমানুষিক কাজের চাপ থাকা সত্ত্বেও নার্সদের ডেটা এন্ট্রির কাজেও পুরোদমে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে নার্সদের আসল কাজ অর্থাৎ রোগীর শুশ্রূষা গুরুতর ভাবে ব্যাহত হচ্ছে শুধু তাই নয়, রোগীর সঙ্গে নার্সের প্রতি মুহূর্তে দেখাসাক্ষাৎ কথোপকথনের মাধ্যমে যে গভীর মানসিক যোগাযোগ তৈরি হয় সেই যোগাযোগটাও সম্পূর্ণ হারিয়ে যাচ্ছে।
আর একটি উদ্বেগজনক বিষয় হল, পুরুষ সহকর্মী, রোগীর বাড়ির লোক বা পুরুষ ওয়ার্ডে রোগী কখনো নার্সদের প্রতি অশালীন ব্যবহার বা যৌন হেনস্থা করলে নার্সদের অভিযোগ জানানো সহজ হয় না কারণ কোন হাসপাতালেই Internal Complaint Cell কার্যকরী অবস্থায় নেই।
সুব্রতা সরকার নার্সিং প্রশিক্ষণ সম্পর্কে আলোচনা করেন। এই পাঠ্যক্রম সম্পর্কে সচেতনতা ও শ্রদ্ধার অভাব সর্ব স্তরেই। কাজের জগতের সঙ্গে পাঠ্যক্রমের যোগ থাকে না অনেক ক্ষেত্রেই। প্রাইভেট নার্সিং কলেজগুলো প্রচুর অর্থ নিলেও কাজের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। প্রাইভেটে বিএসসি এবং জিএনএম নার্সিং পড়তে এখন ছ’সাত লাখ টাকা থেকে বারো-পনেরো লাখ টাকা লাগে। সরকারি স্কুল-কলেজেও সব মিলিয়ে এক লাখ-দেড় লাখ টাকা লাগে। বহু দরিদ্র পরিবার একটা চাকরির আশায় মেয়েকে নার্সিং পড়তে পাঠায়, জমি বিক্রি করে। নার্স হিসেবে রেজিস্ট্রেশনের জন্য কাজের অভিজ্ঞতা দেখাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের থেকে দালালরা দশ-বারো হাজার টাকা ঘুষ নেয়, যাতে কোনও হাসপাতালে সে ঢুকতে পারে। এই বিষয়ে সরকারের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
সুব্রতা সরকার নার্সদের সম্মানের প্রসঙ্গে বলেন সমাজে সামগ্রিক ধ্যান ধারণার পরিবর্তন না হলে নার্সরা কখনই যথাযথ সম্মান পাবেন না, সব সময়েই তাঁদের চিকিৎসকের অধীন গুরুত্বহীন শ্রেণী হিসাবে দেখা হবে।
এই আলোচনা চক্রে অভয়া মঞ্চের আট জন সদস্য যোগ দেন। অভয়া মঞ্চের তরফে উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে ডঃ শতাব্দী মিত্রের উপস্থিতি আলোচনায় অন্য মাত্রা নিয়ে আসে। প্রান্তিক এলাকায় সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া চিকিৎসকদের সাহায্য এবং প্রশিক্ষণে নার্সরা কত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন এই বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেন ডঃ মিত্র।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উপস্থিত প্রবীণ নারীবাদী শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত জানতে চান অভয়া মঞ্চ নার্সদের সুরক্ষা নিয়ে দাবি পেশ করেছে কি না। অভয়া মঞ্চের সদস্যরা জানান অভয়া মঞ্চের দাবিপত্রে সমস্ত স্বাস্থ্য কর্মীর সুরক্ষা দাবি করা হয়েছে। অভয়া মঞ্চ মনে করে শুধু সিসিটিভি লাগিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না, রোগীর পরিষেবা উন্নত হলে তবেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা সুরক্ষিত থাকবেন। অভয়া মঞ্চের সদস্যরা আরও জানান যে ভবিষ্যতে নার্স এবং সমস্ত স্বাস্থ্য কর্মীদের দাবি দাওয়ার আন্দোলনের সঙ্গে তাঁরা যুক্ত হতে চান এবং এই নিয়ে কথোপকথন চালাতে চান।
এই অনুষ্ঠানে দুজন বক্তা ছাড়া একজন সাংবাদিক, একজন জুনিয়র নার্স, নারী দিবস উদযাপন মঞ্চের নয়জন এবং অভয়া মঞ্চের আটজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
ভবিষ্যতে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত মহিলাদের নিয়ে এই রকম আলোচনা চক্র মহিলাদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে শক্তিশালী করবে।
যথাযথ হয়েছে লেখাটা