ছোট্ট “এলি” এক প্রতিবাদী চরিত্র। এখন সে তাঁর মিষ্টি টিন এজের পরিসরে। আরও যখন ছোট ছিল ,তখন থেকেই সে পৃথিবীর পরিবেশ নিয়ে ভাবছে। শুধু ভাবছে না, হাতে কলমে কাজ করতে শুরু করেছে। অনেক অনেক বড়োদের ছাপিয়ে নিজের ভাবনার কথা বিশ্বসভায় পৌঁছে দিতে হাজির হয়েছে নানান পরিবেশ সম্মেলনে। কেনিয়াবাসী এই ছোট্ট মেয়েটিকে, তাঁর দেশ সবচেয়ে কমবয়সী “পরিবেশ রাষ্ট্রদূত” হিসেবে মনোনীত করেছে। আজ আমরা এলিয়ান্নের মুখ থেকে তাঁর মনকথা শুনবো।
তোমাদের সকলকে স্বাগত জানাই আমার মাতৃভূমি কেনিয়ায়। আমি হলাম এলিয়ান্নে ওয়াঙজিকু চিলিস্টান গিথে। নামটা কি খুব লম্বা হয়ে গেছে? বেশ তাহলে তোমরা বরং…… তোমরা বরং আমাকে এলি বলেই ডেকো। কি ? এবার পছন্দ হলো? আসলে আমাদের দেশে,মানে কেনিয়ায় এভাবেই অনেক অনেক ব্যক্তিগত তথ্যকে নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। খোঁজ নিয়ে দেখো তোমাদের দেশেও এমন রীতি প্রচলিত আছে বা ছিল বহু রাজ্যের মানুষের মধ্যে।
আমাদের কেনিয়া দেশটা খুব সুন্দর। অবশ্য আমরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের দেশকে সবথেকে ভালোবাসি , আমিও তাই। আমাদের কেনিয়াতেই রয়েছে পৃথিবীর দু দুটো বিখ্যাত ন্যাশনাল পার্ক – সারেঙ্গিটি এবং মাসাইমারা। এদের নাম নিশ্চয়ই তোমরা শুনেছো, কেউ কেউ হয়তো এসেছো আমার দেশে বেড়াতে – খুব কাছ থেকে হাতী, সিংহ, গণ্ডার, লেপার্ড,বুনো মহিষের দলবলকে চাক্ষুষ করতে। তোমাদের দেখবে বলে অপেক্ষা করে আছে আরও অনেকে। আছে মাসাইদের মতো প্রাণবন্ত মানুষেরা, আছে মিঠা সোয়াহিলি ভাষা। আর আছি আমি – তোমাদের এলি।
নিজের মুখে নিজের কথা গড়গড়িয়ে বলা আমার ধাতে সয় না। তাছাড়া আমার মতো চোদ্দ বছরের একটা কিশোরী মেয়ে নিজের ঢাক নিজেই পেটাচ্ছে এমন দৃশ্য নিশ্চয়ই তোমরা মেনে নিতে চাইবে না। আসলে হয়েছে কি , আমার দুই বন্ধুর মতো আমিও আমাদের পরিবেশ নিয়ে একটু রুখে দাঁড়াতে চেয়েছি । অনেকটাই হয়তো গ্রেটা থুনবার্গ আর লিসিপ্রিয়া কাঞ্জুজাম এর মতো। এঁদের নাম শুনেছো তো? লিসিপ্রিয়া তো তোমাদের দেশের মণিপুরের মেয়ে। আসলে কি জানো, পৃথিবীর এই সময়ের রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে পরিবেশ রক্ষার আকুতি খুব কম। তাঁরা বড়ো বড়ো সভায় হাজির হন, এই করা উচিত,ওই করা উচিত বলে অনেক অনেক গালভরা কথা বলেন, কিন্তু যখন সেই প্রতিশ্রুতি পালনের সময় আসে তখন তাঁদের দেওয়া অঙ্গীকারের কথা বেমালুম ভুলে যান। তোমরা অনেকেই হয়তো জানো, এই মুহূর্তে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে COP 29 সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নানান দেশের প্রতিনিধিরা সেখানে সমবেত হয়েছেন পৃথিবীর ক্রমশই বিপন্ন হয়ে যাওয়া জলবায়ুর পরিবর্তন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেই বিষয়ে আলোচনার জন্য। এখনও পর্যন্ত এই বিষয়ে যতটা অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে তা মোটেই যথেষ্ট নয়। সবাই পাশ কাটিয়ে সরে যেতে চাইছে যেন। কেবলই কথার পাহাড় জমছে , প্রস্তাবের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে,উন্নত দেশ বলে যারা পরিচিত তাঁরা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ওপর সব দায় চাপিয়ে নিজেদের নির্দোষ বলে প্রমাণ করতে চাইছে, যেমনটা আগেও করেছে। এই বিষয়টা আর মেনে নেওয়া যায় না। আমি ছোট হতে পারি তবে আমি আমার প্রতিবাদ খুব বড়ো করেই পাঠিয়ে দিয়েছি দুনিয়ার তাবৎ রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে। ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে আমি পারিনা আর তাই আমি সবার উদ্দেশ্যে একটি মাত্র কথাই বলেছি , “Action!” এখন আমরা কাজ চাই, সত্যিকারের কাজ। “Action!” আরও আরও জোশ চাই। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে আমার একটাই আবেদন এবং দাবি।আর তা হলো – “Try harder, try harder , try harder.” রাষ্ট্রনায়কদের কাছে আমার একটাই আবেদন – “আমাদের একটাই পৃথিবী । তাই এঁকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের। চেষ্টা চলছে তবে তাকে আরও জোরদার ও অর্থবহ করতে হবে আমাদের। মনে রাখবেন আমাদের হাতে সময় কিন্তু মোটেই নেই। পৃথিবী আজ এক প্রান্তসীমায় এসে পৌঁছেছে।
আজারবাইজান আসার আগে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষজনের একটাই দাবি ছিল – পৃথিবীর প্রাকৃতিক কার্বন সিঙ্ক বনাঞ্চল ও সমুদ্র দুইই আজ গভীর দূষণের কবলে পড়েছে। এরফলে কেবল প্রাকৃতিক সিঙ্কের ওপর ভরসা করে বসে থাকলে চলবে না, চাই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ। টাকা দেবার প্রশ্নে সব বড় দেশই পিছিয়ে গেছে। এটাও একধরণের “ইন এ্যাকশন”- নিষ্ক্রিয়তা, পলায়নপরতা। আমি এর বিরুদ্ধেই গর্জে উঠতে চাই। তোমরা হয়তো বলবে আমার একার প্রতিবাদে কী হবে? আমি বলবো নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং বা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এর মতো স্মরণীয় ব্যক্তিত্বরা একাই পথে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। আমিও তাঁদের মতো কিছু করতে চাই। অন্তত পথে তো নামি। আওয়াজ তো তুলি। কেউ না কেউ তো পাশে এসে দাঁড়াবে। এই বিশ্বাস নিয়েই যে আমাদের পথচলা, মানুষের পথচলা। আচ্ছা, তোমরা আমাদের দেশের মানে কেনিয়ার বিখ্যাত প্রতিবাদী পরিবেশবিদ “ওয়াঙ্গারি ম্যাথাইয়ের” নাম শুনেছো? শোননি, না না এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমি কিন্তু তোমাদের দেশের দুই বিখ্যাত মানুষের নাম জানি , তাঁদের কাজকর্মের কথা জানি। এঁরা কে কে জানতে চাইছো? আন্দাজ করো দেখি! ঠিক ধরেছো। প্রথম জন হলেন তোমাদের এই বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথ টেগোর আর দ্বিতীয়জন হলেন গান্ধী, দ্যা গ্রেট ইন্ডিয়ান লিডার এণ্ড সোশ্যাল রিফর্মার। উনিতো আফ্রিকা থেকেই তাঁর প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন, তাইনা? আর টেগোর এর সেই বিখ্যাত পোয়েট্রি – যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে। If no one responds to your call, move alone O dear move alone.
কি অপূর্ব সুন্দর কথা! তোমরা এই গানটা সবাই জানো? তাহলে এসো না! সবাই মিলে এক সাথে গলা ছেড়ে এই গানটা গেয়ে উঠি। এই গানটা গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলে মনে নতুন উৎসাহের স্রোত বয়ে যায়। আমি যখন প্রথম ওয়াঙ্গারির কথা শুনি, তাঁর লেখা পড়ি, তখন রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম যে আমাকেও তাঁর মতো কিছু একটা করতে হবে। আমার কেনিয়াকে, সুন্দরী অপরূপা কেনিয়াকে আবার তাঁর গৌরবের আসন ফিরিয়ে দিতে হবে। ওয়াঙ্গারির বিখ্যাত ‘দ্যা গ্রীন বেল্ট মুভমেন্টের’ একমাত্র লক্ষ্যই ছিল আমাদের হারিয়ে যাওয়া সবুজকে ফিরিয়ে আনা। ওয়াঙ্গারি বুঝতে পেরেছিলেন যে মানুষের টেকসই যাপনের মূল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে পৃথিবীর পরিবেশের সুস্থিতির ওপর। আমরা তাকে নষ্ট করেছি , আমাদেরই তাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। ওয়াঙ্গারি চেয়েছিলেন কেনিয়ায় মহিলাদের এই আন্দোলনের প্রথম সারিতে ঠাঁই করে দিতে ,কারণ একজন লড়াকু মহিলা হিসেবে তিনি জানতেন সামাজিক , অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক জাগরণের জন্য মহিলাদের এগিয়ে আসাটা কত জরুরি। তাঁকে কেনিয়ার লোকজন কি বলে ডাকে জানো? আমরা তাঁকে ডাকি বৃক্ষমাতা বা Mother of Trees নামে। গাছকে জড়িয়ে ধরে যেমন অনেক অনেক জীবন বেঁচে থাকে , মা কে আগলে ধরেই যে সমৃদ্ধ হয় এক একটা পরিবার। পাশাপাশি অপচয় কমিয়ে সম্পদের পুনর্ব্যবহার এবং প্লাস্টিক বর্জ্যের নিয়ন্ত্রণেও তিনি সরব থেকেছেন আমৃত্যু। ২০০৬ সালে তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। ওয়াঙ্গারি ম্যাথাইয়ের স্বপ্ন এখনও পূর্ণতা পায়নি। আর তাই আমরা আজ প্রতিবাদে সামিল হয়েছি। বৃক্ষমাতা ওয়াঙ্গারির মতো আমিও যে চাই পৃথিবীর সুরক্ষা, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণিদের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে।
অনেক ছোট বেলা থেকেই আমি, তোমাদের এই এলি প্রতিবাদে সামিল হয়েছে। প্রতিবাদ বুঝি আমার রক্তে। জানো! যখন আমার বয়স মাত্র চার বছর তখনই আমার স্কুল প্রজেক্টে আমি আমার মায়ের সাহায্য নিয়ে আমার তিন হিরোকে বেছে নিয়েছিলাম। স্কুলের মিস্ আমার কাজ দেখে খুশি হয়ে বলেছিলেন – utafika mbali mpenzi wangu – You will go far my dear. মিসের ঐ কথাটা আজও আমাকে যেন তাড়িয়ে ফেরে। কোনো লোক দেখানো প্রতিবাদ নয়, আমি আমার অন্তরের প্রেরণা থেকে কাজ করতে চাই। আমি আমার দেশের সব মা আর বোনকে বলি , “তোমাদের ঘরের গৃহস্থালি ব্যস্ততা আর পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে অন্তত একটা করে গাছ লাগাও আর তার যত্ন কোরো। ওয়াঙ্গারি যে আমাদের এই কথাই শিখিয়েছেন।”… গাছ হলো মায়ের আঁচল, যা আমাদের সমস্ত পরিস্থিতিতে আগলে রাখে পরম মমতায়। আমি যখন একটা কমলা লেবু অথবা অন্য কোনো ফল খাই তখন তার বীজটা মাটিতে পুঁতে দিই , যাতে আমার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় সেই গাছটি। একটা গাছ থেকে আরও আরও অনেক গাছ। একটা সবুজ পৃথিবীর নির্মাণ যে আমাদেরই করতে হবে। এই ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই ২০১৭ সালে আমি আমার পরিবারের সাহায্য নিয়ে “Children With Nature” নামের সংস্হাটি স্থাপন করি,যার উদ্দেশ্য হলো আমার বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ রক্ষার ভাবনাকে গেঁথে দেওয়া। কিছু হবেনা, না ভেবে, কিছু হবে ভাবতে শুরু করলেই অবস্থার পরিবর্তন হবে,হবেই। আমাদের মধ্যে একটা ইতিবাচক ভাবনার স্রোত বইয়ে দিতে পারলে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও বদল আসবে। এভাবেই আমরা আফ্রিকা মহাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এই পর্যন্ত ১.৩ মিলিয়ন গাছের চারা লাগিয়েছি। এভাবেই বৃটেনের রাজা চার্লস আর বিখ্যাত ফুটবলার ডেভিড বেকহ্যামের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গতবছর দুবাইতে আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলনে ম্যালেরিয়া মুক্ত পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানিয়েছি বিশ্বমঞ্চ থেকে। সমস্যা অনেক। আর তাই অনেক কাজ বাকি আছে। দেখতে দেখতে অনেক কথা বলে ফেললাম। এবার বিদায় নিতে হবে। আমার কথা যদি তোমাদের ভালো লাগে তাহলে তোমরাও কাজে লেগে পড়ো। এই পৃথিবীতো আমাদেরই ,তাই এঁকে প্রাণময় রাখার দায়িত্ব যে আমাদেরই। তাইনা……?
Kwaheri marafiki zangu wapendwa. Tutakutana tena. Goodbye my beloved friends. We will meet again.
**
আজকের ছোট্ট এলি যখন বড়ো হবে তখন পৃথিবী আরও বাসযোগ্য হয়ে উঠবে তাঁর ও তাঁর মতো আরও অগণিত সংখ্যক এলির হাত ধরে। এই বিশ্বাস আমার আছে। এই লেখাটি আগামী প্রজন্মের সবুজ সেনানীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম।
এলির বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক। সুন্দর পৃথিবীর জন্য প্রচেষ্টা জাগ্রত হোক সবার মধ্যে।
এই আশা নিয়েই কলম ধরা, কলমে ধার দেওয়া।
এলি এবং বাকিদের কথা জানতে পেরে খুব ভালো লাগলো।
ছড়িয়ে পড়ুক ওই ছোট্ট মেয়েটার কথা অনেকের মাঝে।
ছোট্ট এলির কাহিনি অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক।এলিকে আমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দেবার জন্য লেখককে অনেক ধন্যবাদ। এমন কাহিনি আরও চাইছি।
এলিরা এগিয়ে এলে এই পৃথিবী আবার প্রাণময় হয়ে উঠবে।
Ashadharon lekha!
ঐ ছয় ছোট্ট মেয়েটাই অসাধারণ। লেখাটা নয়। ছড়িয়ে পড়ুক এলি কথা।
এলির বার্তা ছড়িয়ে পরুক সারা পৃথিবীতে। ভালো লাগলো লেখাটি।
লেখাটা ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
খুব সুন্দর লেখা। আমাদের সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আরও এলির প্রয়োজন, আমাদের জমি ও জল রক্ষার জন্য আমাদের নিজেদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
এলি বয়সে ছোট, কাজে অনেক অনেক বড়ো। ওর বিশ্ব পরিবেশ ভাবনা বড়োদের হার মানাবে।