পাঁচালি সিরিজ যখন লিখতে শুরু করেছিলাম তখন মনে একটু ক্ষীণ আশা ছিলো। এতো কিছু দুর্নীতি অত্যাচারের কাহিনী বেরিয়ে আসার পর প্রশাসন অন্তত এবার নিজের মুখ রক্ষার জন্য রাজধর্ম পালন করবে। অচিরেই প্রমাণ হলো সে গুড়ে বালি।সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সেই কথাই প্রমাণ করে।
কয়েকদিন আগে যেগুলো বলেছিলাম সেগুলো একটু ঝালিয়ে নেয়া যাক।
১) বর্তমান স্বাস্থ্য দপ্তর যারা চালায় সেটার মানুষের দেয়া নাম নর্থ বেঙ্গল লবি।
২) এই লবির অসীম ক্ষমতা
৩) বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে এই লবির হয়ে কাজ করে একটি লুম্পেন গোষ্ঠী। এদের অনেকেই তথাকথিত জুনিয়র ডাক্তার বা স্টুডেন্ট। কিছু শিক্ষক চিকিৎসকও এটার সঙ্গে জড়িত।
৪) এই লবি যে জায়গাগুলো পুরোপুরি কব্জায় এনেছে সেগুলো হলো স্বাস্থ্য ভবন, মেডিকেল কাউন্সিল, ওয়েস্ট বেঙ্গল হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড এবং কলেজ লেভেলের প্রশাসন।
৫) এই লুম্পেন বাহিনী যে যে অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত তার কয়েকটি হলো তোলাবাজি, মেয়েদের শ্লীলতাহানি, মৃতদেহ পাচার, ওষুধের জালিয়াতি, টেন্ডার দুর্নীতি, গুন্ডামি,হাসপাতালে বর্জ পাচার ইত্যাদি। এগুলো আমার কোনো দাবি নয়। এগুলো মিডিয়াতে বেরিয়েছে। তাই আমরা জেনেছি। এতো অভিযোগের কোনো একটি থাকলেই ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী শাস্তি পাবার কথা। আজ পর্যন্ত কারো কোনো শাস্তি প্রশাসনের তরফে হয়নি। সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে এখনো প্রশাসনিক তদন্ত সুরু করার সাহস স্বাস্থ্য দপ্তরের কোনো কর্তা এখনো দেখাতে পারেনি। কেনো পারেনি সেটা বুঝতে পারলেই সিন্ডিকেটের কারবার পুরোপুরি বোঝা যাবে।
ডিসি সেন্ট্রাল ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিষেশজ্ঞ হিসেবে যখন লাল জামার অভিক দের নাম প্রকাশ্যে আসে তখন কিছুটা সাপে ছুঁচো গেলার স্টাইলে স্বাস্থ্য দপ্তর একটি তদন্ত কমিটি তৈরি করে। সেখানে অভিক দের বিরুদ্ধে মাত্র বত্রিশটি অভিযোগ জমা পড়ে। তার রিপোর্ট আপনারা সমাজ মাধ্যমে পেয়ে গেছেন।
অভিযোগগুলো এমন মারাত্মক যে, তার যেকোনো একটি অভিযোগ থাকলেই তাকে গ্রেফতার করা উচিত। সেরকম কোনো ঘটনা আমরা এখনো চোখে দেখিনি।
এবার আপনাদের একটু খতিয়ে দেখতে বলবো কয়েকদিন আগের একটি মিটিংয়ের বিষয়ে।
জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে নবান্ন সভা ঘরে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী দুই সপ্তাহের বেশি অনশন চলাকালীন একটি মিটিং করেন। সেখানে জুনিয়র ডাক্তাররা যে “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” ব্যাজ পরে গেছিলো সেটা খোলানো হয়। এই ঘটনা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। মিটিংয়ের আগেই যেন বার্তা দেয়া হলো এখানে আর যাই চাও জাস্টিস চেয়ো না।
সেই মিটিং যেহেতু লাইভ স্ট্রিমিং হয়েছে, সেইজন্য পৃথিবীর সবাই দেখে নিয়েছে।
সেই মিটিংয়ের বিশদ আলোচনায় আমরা যাবো না। কয়েকটি পয়েন্ট শুধু এখানে তুলে ধরবো।
আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক মেল চালাচালি করে শেষে ৪৫ মিনিটের জন্য মিটিং করার অনুমতি পায়। যখন অভিযোগ এর পর অভিযোগ জুনিয়র ডাক্তাররা তোলে তখন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী প্রথমেই আপত্তি জানান অভিযুক্তদের নাম করা যাবে না। সে না হয় ঠিক আছে, কিন্তু সেখানেই জানা যায় অভিযুক্তরা মাননীয়ার সঙ্গে আগেই দেখা করে গেছে। আলোচনা করে গেছে। আরো প্রকাশ পায় এই লুম্পেনগুলোর প্রতি ওনার বিশেষ স্নেহ রয়েছে। কার স্নেহ কার প্রতি বর্ষণ হবে সেটা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু এই অন্ধ স্নেহ নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের মিটিং, মিডিয়া জানতে পারে, অফিসিয়াল চিঠি পাঠাতে হয়, মিটিংয়ের লাইভ স্ট্রিমিং হয়। আর লুম্পেনদের সঙ্গে মিটিং গোপন থাকে। কাকপক্ষী টের পায়না। ওদের মেলও লিখতে হয়না। হয়তো একটি ফোনই যথেষ্ট। এই নিয়ে আমি আর কিছু বলবো না। আপনারা নিজেদের বুদ্ধি অনুযায়ী এর বিচার করুন। শুধু একটি প্রশ্ন এখানে রেখে যাই। এই লুম্পেন গোষ্ঠীর সঙ্গে মাননীয়া মন্ত্রীর সম্পর্ক কি একটি মেডিকেল স্টুডেন্ট বা জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর যে সম্পর্ক অফিসিয়ালি থাকার কথা তাই, নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু?
এবার আসি দ্বিতীয় একটি পয়েন্টে। মেডিকেল কলেজগুলোর ভেতর এই থ্রেট সিন্ডিকেট চলছে, এই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জমা পড়েছে। তার ভিত্তিতে মেডিকেল কলেজগুলি তদন্ত কমিটি তৈরি করেছে। এটা কোনো আগ বাড়িয়ে করা কাজ নয়। সারা দেশে মেডিকেল কলেজগুলো চলে ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন এর নির্ধারিত নীতি মোতাবেক। ডাক্তারদের ব্যক্তিগত রেজিস্ট্রেশন এবং মেডিকেল কলেজগুলোর রেজিস্ট্রেশনের নিয়ামক সংস্থা সারা দেশে এই ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন। শিক্ষক এবং ছাত্র ছাত্রীরা এর ফরমান এবং নিয়ম মানতে বাধ্য। এই নিয়মে মেডিকেল কলেজের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য দপ্তর। যার মাথায় থাকে ডাইরেক্টর এবং সেক্রেটারি। কলেজের প্রিন্সিপাল যা কিছু সেটা এই দপ্তরে জানাতে দায়বদ্ধ। অন্য কারুর প্রতি দায়বদ্ধতা ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন এর নিয়মে নেই। মেডিকেল কলেজগুলোতে এন এম সি আর জেনারেল কলেজগুলোতে ইউ জি সি এর নিয়ম শেষ কথা। সেই নিয়ম অনুযায়ী কলেজের স্তরে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেয়া আছে কলেজ কাউন্সিলের ওপর। সেই ক্ষমতাবলে আর জি কর মেডিকেল কলেজে, কলেজ কাউন্সিল তদন্ত করে পঞ্চাশের আশেপাশে স্টুডেন্টের শাস্তির সুপারিশ করে। ওখানের প্রিন্সিপাল সেই রিপোর্ট এবং সুপারিশ নিয়ম মেনে যাদের জানানোর তাদের জানিয়ে দেয়।
মিটিংয়ে এই নিয়ম মোতাবেক কাজ করার জন্য প্রিন্সিপাল স্যার যারা উপস্থিত ছিলেন তারা ধমক খেলেন। আরো জানানো হলো শাস্তি যা দেবার সেটা গর্মেন্ট দেবে। সরকারি দপ্তর চলে লিখিত অর্ডারের ভিত্তিতে। এই যে এন এম সির নিয়ম মোতাবেক যে শাস্তি হবে না, গর্মেন্ট এবার থেকে শাস্তি দেবে সেটা গর্মেন্টের কোনো অর্ডার আমরা এখনো পেলাম না। অর্থাৎ অপরাধীদের শাস্তি দেয়া বিশবাঁও জলে চলে গেলো।
এর আগে দেখেছি এই থ্রেট সিন্ডিকেটের হাত ডাইরেক্টর পর্যন্ত বিস্তৃত। এমনকি ডাইরেক্টর কে হবে সেটাও এই লবি ঠিক করে। এখন দেখলাম এরা এতই ক্ষমতাবান স্বয়ং মন্ত্রীও বাধ্য হচ্ছে প্রকারান্তরে এদের পক্ষ নিতে। এদের ক্ষমতাটা একবার ভাবুন। এর সঙ্গে হয়তো তুলনীয় মুম্বাইয়ের আন্ডার ওয়ার্ল্ড এর কাহিনী।
মিটিংয়ের দুয়েকদিন পরেই এই লুম্পেন এর দল একটি সংগঠন তৈরি করলো। নাম দিলো ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস
অ্যাসসিয়েশনের(WBJDA)। শোনা যাচ্ছে এদের পরামর্শদাতা সন্দীপ ঘোষের মাসতুতো ভাই চৌর্য শিরোমণি জেলখাটা ঘোষ। আশীষ পান্ডে আর সন্দীপ ঘোষ জেলে আছে। নাহলে ওরাও হয়তো এদের প্রেস কনফারেন্স এ থাকতো।
ডাক্তাররা এই বিষয়টা বিলক্ষণ জানে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সততা এবং মানবিকতা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। সেই জন্যেই ডাক্তাররা আর যার পদত্যাগ চেয়ে থাকুক, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ কোনোদিন চায়নি। শুধু সততা এবং মানবিকতা দিয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়না। সেখানে অনেক সময় সিদ্ধান্ত পক্ষপাতদুষ্ট হয়। যেখানে এইরকম ভয়ংকর থ্রেট সিন্ডিকেট বহাল আছে সেখানে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়া খুব কঠিন। ডাক্তারদের আর সাধারণ মানুষের আন্দোলনে যদি কোনোদিন এই থ্রেট সিন্ডিকেটের সাড়ে সর্বনাশ করতে পারে, সেদিন হয়তো দেখবো নিরপেক্ষ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত আবার নেয়া যাচ্ছে। এটা আমাদের আশা শুধু নয়। এটা আমাদের দৃঢ বিশ্বাস।
(চলবে)