মেয়েটির বয়স ১৯, ন্যাসোফ্যারিঞ্জিয়াল (নাকের পেছনের অংশের) ক্যান্সারে আক্রান্ত। রেডিয়েশন আর কেমোথেরাপি চিকিৎসা চলছে। সাধারণত এই ক্যান্সারটির সেরে ওঠার হার বেশ ভালো। মেয়েটির সঙ্গে শুরু থেকেই আসেন তার মা এবং একটি বছর তেইশ চব্বিশ এর ছেলে। প্রথমে ভেবেছিলাম বোধহয় দাদা। পরে কথায় কথায় জানতে পারি ছেলেটি মেয়েটির প্রেমিক। আর ক’ মাস পরে বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তার মধ্যে এই বিপত্তি। বিয়ের যোগাড়যন্ত্র এমনকি বেনারসি কেনাও সারা। যাই হোক চিকিৎসা চলছে। ছেলেটি আর মেয়েটির মা নিয়ম করে এসে দেখা করে যান। একদিন সঙ্গে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এলেন। মেয়ের কাকা, পরিচয় দিলেন মেয়ের মা। অনুরোধ করলেন ওনাকে যেন একটু মেয়ের অসুখ সম্পর্কে বিস্তারিত জানাই।এ রকম ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটে, পরিবারের বয়স্ক মানুষ দায়িত্ব পালন করতে চিকিৎসা চলাকালীন এসে ডাক্তারের সাথে কথা বলে যান। তাই অবাক হইনি। ভদ্রলোক প্রথমেই মেয়ের মাকে বাইরে যেতে বললেন। উনি একা কথা বলবেন। প্রথমেই আমার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। আমার নাম কত শুনেছেন এইসব ভনিতা করলেন। তারপর কথা শুরু হলো।
যথাসম্ভব ডিটেইলসে মেয়ের অসুখ, চিকিৎসা, সাইড এফেক্ট, ভালো হওয়ার সম্ভাবনা এইসব বলতে বলতে লক্ষ্য করলাম উনি আলোচনাটাকে নেগেটিভ দিকে চালনা করতে চাইছেন। মানে মৃত্যুর চান্স কতটা, মৃত্যু না হলেও স্বাভাবিক জীবন যাপনের চান্স কতটা, চেহারা খারাপ হয়ে যাবে কিনা এইসব, কিন্তু সেটা ঠিক মেয়েটি সম্পর্কে দুশ্চিন্তা থেকে মনে হচ্ছিল না।
যেমন প্রশ্ন করলেন “এই রোগে তো বাঁচেই না। মোটামুটি কতদিন বাঁচবে মনে হয়।”
“সম্পূর্ণ সুস্থ করার জন্যই তো চিকিৎসা করছি, তাই না। আশা রাখি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।”
একটু বিমর্ষ হয়ে পরের প্রশ্ন “ঠিক হয়ে গেলেও কি আর স্বাভাবিক থাকবে? তার ওপর গলাতে কালো কালো দাগ হয়ে যাচ্ছে, চেহারাও তো খারাপ হয়ে যাবে”
ধৈর্য না হারিয়ে বললাম “কেন স্বাভাবিক হবে না। অবশ্যই হবে, এত চেষ্টা তো ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেবার জন্যই, তাই না? আর কালো দাগগুলো মাসখানেকের মধ্যেই মিলিয়ে যাবে। ওকে ক্যান্সারের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়াই তো আমার চিকিৎসার উদ্দেশ্য। শুধু ক্যান্সার ঠিক করা তো নয়।”
শেষমেষ ভদ্রলোক মুখোশ খুলে ফেললেন। বললেন “দেখুন, এই মেয়েটির সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে আমি তার বাবা। (আচ্ছা, তার মানে যে ছেলেটা সঙ্গে আসে তার বাবা)। আমার ছেলে প্রেম করে বিয়ে ঠিক করেছে আপত্তি করিনি, কিন্তু একটা ক্যান্সার পেশেন্টকে বিয়ে করবে বলে গোঁ ধরে আছে এটা মানতে পারি না। ছেলে কিছুতেই শুনছে না এখন আপনি দয়া করে বলুন এই মেয়েকে বিয়ে করাটা বোকামি, এ ভালো হবে না, আর স্বাভাবিক ভাবে বিয়ে করে থাকতেও পারবে না। আপনি বললে শুনবে।”
রাগে মাথার শিরা দপদপ করছিল। লোকটিকে দুকথা শোনানোর সুযোগ ছাড়িনি।আর প্রথমবার কাউকে আমার রুম থেকে বের করে দিয়েছিলাম।
ক্যান্সার চিকিৎসা করলে সেরে যায়। সুস্থ হয়ে মানুষ স্বাভাবিক জীবনে শুধু ফিরে যান তাই নয় অলিম্পিকে মেডেল থেকে নোবেল প্রাইজ সবকিছুই অর্জন করতে পারেন। এগিয়ে আসুন, ক্যান্সারের ট্যাবু ছুঁড়ে ফেলুন। ক্যান্সার চিকিৎসার পর মানুষের সুস্থ স্বাভাবিক সামাজিক জীবনে ফিরে যাওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে উঠবেন না।