২য় পর্বের পর
ফেরার পথ বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। হাল্কা জোলো হাওয়া বইছে। বাতাসে সোঁদা গন্ধ। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে মনে হয়। মাথা থেকে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে এই রোমান্টিক পরিবেশ উপভোগ করতে করতে ঘরে ফিরল দুজনে।
‘আচ্ছা, এই শহরটার নাম ভালুকপং হল কেন? এখানকার জঙ্গলে কি অনেক ভালুক থাকে?’ কৌতুহলী স্বরে জিজ্ঞাসা করে বিদিশা।
‘এই জঙ্গলে ভালুক থাকে কি না জানি না। তবে আদিবাসী রাজা ভালুকা-র নামে এই শহরের নাম ভালুকপং। দশম শতাব্দীতে সেই রাজা ভালুকার তৈরী একটা দূর্গও আছে এখানে। এখন অবশ্য সবই প্রায় ধ্বংসস্তুপ। মহাভারতেও আছে সেই রাজত্বের কথা।’
চলো না ‘কালকে দূর্গটা দেখে আসি।’
‘যাওয়া যেতে পারে। ব্রেকফাষ্টের পরেই বেরিয়ে পড়ব তাহলে। ওখান থেকে তারপর না হয় যাব টাইগার রিজার্ভে।’
মাঝপথে টিপটিপ করে বৃষ্টি নামল। ওদের সঙ্গে ছাতা নেই। দ্রুত পা চালিয়ে ফিরছিল দুজনে।
রিসর্টে ঢোকার মুখে ম্যানেজার সংগ্রাম বরজাতিয়া-র সাথে দেখা। তার হাতে একটা ষ্টীলের বাঁটের শক্তপোক্ত লম্বা ছাতা।
ছাতাটা দেখিয়ে অরূপ বিদিশাকে বলল, ‘এটাই হল আসল ছাতা। আমাদের ফোল্ডিং ছাতাগুলো কোনো কাজের না।’
সংগ্রাম তেজপুরের মানুষ। ওর স্ত্রী এয়ারফোর্সের স্কুলে পড়ায়। আর ভাইয়ের একটা ট্রাভেল এজেন্সী আছে। ওর ভাইয়ের থেকে গাড়ি নিয়েই অরূপরা তাওয়াং গেছিল। সেই সূত্রে একটু বিশেষ পরিচয় আছে লোকটার সাথে।
‘এত অন্ধকারে নদীর পাড়ে থাকবেন না। সাপ বেরোয় এই সময়ে। ভীষণ বিষাক্ত।’ ম্যানেজার ওদের সতর্ক করে দিল।
রাতের খাবার খেতে ডাইনিং হলে গিয়ে ওরা দেখল বেশ গমগমে ভীড়। অনেক নতুন মুখ। ওরা পরে এসেছে। সুতরাং বেশ কিছুক্ষণ বসতে হবে।
ঠিক উল্টোদিকের কোণার টেবিলে একজন আধা মঙ্গোলয়েড লোক একা বসে আপনমনে মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করছে। বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। চোখমুখে তীব্র কাঠিন্য। একজন বয় এসে তার টেবিলে খাবার দিতে সে ফোন রেখে খাবারে মনযোগ দিল। থালায় দুটো স্যান্ডউইচ। রাতের খাবারে স্যান্ডউইচ! ব্যপারটা অদ্ভূত তো। অরূপ উৎসুক হয়ে লোকটাকে লক্ষ্য করল। লোকটা সামনের প্লেটে রাখা স্যান্ডউইচ দুটোর মধ্যে থেকে একটা তুলে নিয়ে খাওয়ার আগে সেটা খুলে কি একটা দেখল। অনেকটা পানের খিলি খুলে দেখে নেওয়া যে ভেতরে চুন, খয়ের ঠিক মত দেওয়া আছে কিনা। সেরকম, স্যান্ডউইচের ভেতরে কি পুর দেওয়া আছে সেটা দেখছে বোধহয়। ও মা। তা নয় তো। স্যান্ডউইচের মাঝখান থেকে ছোট্ট কি একটা জিনিস বের নিয়ে করে সে পকেটে পুরে ফেলল।
পুরো ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে, অরূপ ভালো করে ব্যাপারটা বুঝতেই পারল না। কিন্তু কিছু একটা অস্বাভাবিক যে ঘটল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সন্ধানী দৃষ্টিতে এদিক-ওদিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল দুটো টেবিল পরেই সেই দীর্ঘদেহী জার্মান ভদ্রলোক আগের লোকটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তার কর্মকান্ড দেখছে।
লোকটা খুব তাড়াতাড়ি প্রায় গপগপ্ করে স্যান্ডউইচ দুটো খেয়েই খাওয়ার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তারপর অরূপের সাথে জার্মান সাহেবের চোখাচোখি হতেই উনি টেবিলে পড়ে থাকা নিজের ফোনের প্রতি অরূপকে ইশারা করলেন। তার মানে, ডাল মে সত্যিই কুছ কালা হ্যায়। কিন্তু স্যান্ডউইচখোর লোকটা কে? আর স্যান্ডউইচের ভিতর কি খুঁজে পেল সে?
তন্ময় হয়ে ভাবছিল অরূপ। মোবাইল থেকে একটা পিং করে আওয়াজ হতে ওর সম্বিত ফিরল । ‘ম্যাক্স মায়ারস্ গ্যালাক্সি ট্যাব গিভিং পেয়ারিং রিকোয়েষ্ট’ এই মেসেজটা মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল। স্নায়ু অত্যন্ত সজাগ হয়ে উঠল অরূপের। বিপদ খুব কাছে এসে গেলে এইরকম হয় ওর। মাথাটা তখন বরফের মত ঠান্ডা হয়ে যায়, আর দ্রুত চিন্তা করার ক্ষমতা আসে।
তার মানে, ম্যাক্স মায়ার ব্লু-টুথের মাধ্যমে কিছু পাঠাতে চায়। এখানে অন্যভাবে পাঠানোর উপায় নেই। কারণ, এখানে কয়েকদিন যাবৎ মোবাইলে কোনো নেটওয়ার্ক নেই। এই ডাইনিং হলের ভেতর ভদ্রলোক ওর কাছাকাছি এসে দেখা করতেও বোধহয় চাইছেন না। পেয়ারিং রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করল অরূপ। তারপর একটা ভিডিও এল ম্যাক্স মায়ারের ফোন থেকে।
ভিডিওটা চালু করল সে। আরে, এ তো একটু আগেই ঘটে যাওয়া ঘটনাটা! জার্মান ভদ্রলোক রেকর্ড করতে পেরেছে তা হলে। থেমে থেমে, ভিডিওতে ‘ফ্রেম বাই ফ্রেম’ দেখতে লাগল লোকটাকে। লোকটার গলায় ডানদিকে একটা নীল রঙের একটা ছোট উল্কি আঁকা। উল্কিটা ভালো করে লক্ষ করতেই অরূপের ভ্রু কুঁচকে গেল। লোকটা একটা কালো মত ছোট্ট জিনিস খুঁজে পেল স্যান্ডউইচের ভেতর থেকে। জিনিসটা কি- এই কৌতুহল তখন চেপে বসেছে অরূপের মাথায়। ভিডিওটা থামিয়ে ওই ফ্রেমের স্ক্রিনশট নিয়ে সেটা জুম করতেই ব্যপারটা পরিষ্কার হল। কালো মত আয়তাকার জিনিসটা একটা মেমরি কার্ড। একটু পরেই সেটা পকেট থেকে ওয়ালেটে চালান করে দিয়েছিল লোকটা। অরূপ জুম করা ছবিটা বিদিশাকে দেখাতেই সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।
বেশ রাত হয়েছে। বাইরে আবার বৃষ্টি নেমেছে। সঙ্গে হালকা হাওয়া। ডাইনিং হল থেকে নামতেই সংগ্রাম মাথায় ছাতা ধরে ওদের কটেজে পৌঁছে দিল।
(চলবে)