স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশের ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের প্রধান কর্মসূচিগুলির দিকে চোখ বোলালেই লেখাটির শিরোনামের তাৎপর্য বুঝতে পারবেন।
- ১৯৪৭ – ১৯৫৩: সামগ্রিক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি
[সেইসময় সাড়ে সাত কোটি ম্যালেরিয়া রোগী এবং বছরে আট লক্ষ মৃত্যু হিসাব করা হয়েছিল।]
- ১৯৫৩: জাতীয় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (NMCP)
- ১৯৫৮: জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূলকরণ কর্মসূচি (NMEP)
[১৯৬৫তে সরকারি ঘোষণায় দেশে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা এক লক্ষে নেমে আসে। অন্যদিকে কর্মসূচিকে শিথিল করে দেওয়া, বড় বাঁধ দিয়ে বড় জলাধার, খাল, বিভিন্ন নির্মাণের ফলে ঐ সমস্ত স্থির জলের আধারগুলি মশার প্রজননের মুক্তাঞ্চল হয়ে যায়। ১৯৭০ থেকে রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৬৫ লক্ষ হয়ে যায়।]
- ১৯৭১: Urban Malaria Scheme.
- ১৯৭৭: Modified Plan of Operation
- ১৯৯৭ : Enhanced Malaria Control Project (EMCP)
[বিশ্ব ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রিত। এরপর থেকে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য পশ্চিমের দাতা সংস্থাগুলি জাতীয় কর্মসূচিগুলিতে যুক্ত থাকে।]
- ১৯৯৯: জাতীয় ম্যালেরিয়া বিরোধী কর্মসূচি (NAMP)
- ২০০২: জাতীয় পতঙ্গবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (NVBDCP)
- ২০০৫: সহযোগী আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার প্রবর্তিত Intensified Malaria Control Project (IMCP)
- ২০০৫: NVBDCP জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের (NRHM) অন্তর্ভুক্ত হয়।
[একে একে কর্মসূচিতে Rapid Diagnostic পরীক্ষা, ACT ওষুধ, পতঙ্গঘাতী রসায়ন মাখানো LLIN মশারি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়।]
- ২০০৮: জাতীয় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প (NMC Project)
- ২০১০ ও ২০১৩: নিউ ড্রাগ পলিসি ২০১০ ও ২০১৩ তৈরি করা হল
- ২০১৬: National Strategic Plan for Malaria Elimination in India
- ২০১৭-২০২২: National Strategic Plan for Malaria Elimination in India (NSPME)
- ২০২২-২০৩০: NSPME কর্মসূচির সম্প্রসারণ।
এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) Roll Back Malaria, MDG, SDG প্রভৃতি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কর্মসূচির উল্লেখই করলাম না।
কেন ম্যালেরিয়া এত ভয়ঙ্কর?
ম্যালেরিয়া বাহক (Vector) অ্যানোফিলিস মশা ২ মিলিগ্রাম ওজনের একটি ক্ষুদ্র সন্ধিপদী পতঙ্গ (Arthropod Insect) যা প্রকৃতির মধ্যে প্রায় ২৩ কোটি বছর ধরে রয়েছে এবং সামান্য স্থির জলে বা বৃষ্টি জমা জলে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। ম্যালেরিয়ার পরজীবী (Parasite) জীবাণু (Protozoa) খুব ক্ষুদ্রাকৃতি এবং মানুষ ও মশার দেহে চক্রাকারে থেকে যায়। সংক্রমিত মশার একটি কামড়েই ম্যালেরিয়া হতে পারে এবং দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসা না করলে ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়া মস্তিষ্কের মারণ ম্যালেরিয়া (Cerebral & Malignant Malaria) হয়ে মৃত্যু ঘটায়। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম চিকিৎসা, অসমাপ্ত চিকিৎসা এবং আংশিক ও অযৌক্তিক ওষুধ প্রয়োগের ফলে সহনশীল ম্যালেরিয়া (Common Drug Resistant Malaria) প্রজাতির জীবাণু জন্মলাভ করে, যা প্রচলিত চিকিৎসায় সাড়ে না, মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়।
ম্যালেরিয়া রোগী
WHO-র একটি হিসাবে ২০২০তে বিশ্বের ৮৫টি প্রাদুর্ভাব প্রবণ (Endemic) দেশে ২৪ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত এবং ৬ লক্ষ ১৭ হাজার মানুষের ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হয়েছে। ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় (Tropical and Subtropical) অঞ্চলে বিশেষত আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এক ভয়াবহ ম্যালেরিয়া মহামারি (Epidemic) চলছে যাতে বেশি আক্রান্ত শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী, অপুষ্ট, অপ্রতিরোধী (Immuno Compromised) ব্যক্তিরা এবং জনজাতি, পরিযায়ী শ্রমিক ও ভ্রমণকারীরা।
ম্যালেরিয়া সাধারণত মা থেকে সন্তানে সংক্রমিত হয় না, কিন্তু সংক্রমিত রক্ত সঞ্চালন (Blood Transfusion) বা কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষাগারে দুর্ঘটনাবশত সংক্রমিত রক্তের খোঁচাতে (prick) হতে পারে। ম্যালেরিয়ার সাধারণ সংক্রমণ পথ (Portal of entry) সংক্রমিত স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার কামড়। পরিসংখ্যান কমিয়ে দেখানোর অভিযোগের মধ্যেও ভারতে দেখা গেছে ২২ শতাংশ অধিবাসী উচ্চ সংক্রামক এলাকায় (এক হাজার জনসংখ্যায় একের বেশির রোগী) বাস করেন এবং ৯১ শতাংশ রোগী ও ৯৯ শতাংশ মৃত্যু উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি এবং ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ ও কর্ণাটক ১৭টি রাজ্যে ঘটে। নভেম্বর ২০২০ অবধি পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে ভারতে দুই লক্ষ রোগী যার মধ্যে ৪৬ শতাংশ ফ্যালসিপেরাম আক্রান্ত।
মহামারিবিদ্যার (Epidemiology) দিক থেকে ভারতে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবকে কোন কোন বিশেষজ্ঞ জনজাতি ম্যালেরিয়া (Tribal Malaria), অরণ্যের ম্যালেরিয়া (Forest Malaria), শহরের ম্যালেরিয়া (Urban Malaria), বন্যাজনিত ম্যালেরিয়া (Flood related Malaria) প্রভৃতি ভাগে ভাগ করেছেন।
ম্যালেরিয়ার জীবাণু, প্রজাতি ও তাদের জীবনচক্র
ম্যালেরিয়ার জীবাণু অনেক রকমের আছে। তারমধ্যে আমাদের দেশে মূলত দেখা যায় চার রকমের ম্যালেরিয়ার জীবাণু। (১) প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম, (২) প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স, (৩) প্লাসমোডিয়াম ওভেল ও (৪) প্লাসমোডিয়াম ম্যালেরি। এর মধ্যে আমাদের দেশে ও রাজ্যে প্রথম দু’ধরনেরই ম্যালেরিয়া সাধারণত দেখা যায়। তাই আমরা ঐ দুটি প্রজাতির জীবাণু সংক্রান্ত আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবো।
সাধারণত রাতে মানুষের রক্ত খাওয়ার সময় সংক্রমিত মশা মানুষের দেহে স্পোরোজয়েট (Sporozoites) নিক্ষেপ করে যা রক্তসংবহন তন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের যকৃতে পৌঁছে যকৃতের কোষগুলিকে সংক্রমিত করে। এখানে যে মেরোজয়েটগুলি (Merozoites) তৈরি হয় তা আবার রক্তসংবহনতন্ত্রে লোহিত কণিকাকে আক্রমণ করে সিজন্ট (Schizonts) তৈরি করে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে রোগের সৃষ্টি করে। এভাবে ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণুদের অযৌন জীবনচক্র (Asexual Cycle) সম্পন্ন হয়। সবশেষে সেক্সুয়াল গ্যামেটোসাইটস (Sexual Gametocytes) তৈরি হয়। যা কোন অসংক্রমিত মশার কামড়ের ফলে সেই মশার দেহে প্রবেশ করে যৌন জীবন চক্র (Sexual Cycle) সম্পন্ন করে। ঐ সংক্রমিত মশা অসংক্রমিত কোন মানুষকে কামড়ালে সে ম্যালেরিয়ায় সংক্রমিত হয়।
সিজন্ট ভেঙ্গে গ্যামেটোসাইটস নির্গতর সময় মানুষের জ্বর শুরু হয়। মানুষের দেহে দুদিন এবং মশার শরীরে সাত থেকে ২০ দিন লাগে জীবাণুর সম্পূর্ণ চক্র সমাপ্ত হতে।
ম্যালেরিয়া থেকে যাওয়া, বারবার হওয়া, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ
ফ্যালসিপেরামের ক্ষেত্রে অনেক সময় অসমাপ্ত (Incomplete) ও অপর্যাপ্ত (Suboptimal) চিকিৎসার জন্য ম্যালেরিয়ার জীবাণু রক্তকণিকার মধ্যে থেকে গিয়ে অসুস্থতা রয়ে যায় (Recrudescence)। আবার ভাইভ্যাক্স ও ওভেল ম্যালেরিয়ার জীবাণুর ক্ষেত্রে যকৃতে নিষ্ক্রিয় লিভার হিপনোজাইটস (Hypnozites) থেকে গিয়ে পরে সক্রিয় হয়ে মাঝে মাঝেই ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা দেয় (Relapse)। কোন কোন প্রাদুর্ভাবপূর্ণ অঞ্চলে বারবার ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ হয়ে কিছুটা প্রতিরোধ (Partial Immunity) গড়ে ওঠে যার ফলে পুনরায় ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ হলেও প্রকোপ কম হয়। কিন্তু ছোট বাচ্চা ও গর্ভবতীরা রোগ থেকে অব্যবহতি পান না।
ম্যালেরিয়ার বাহক অ্যানোফিলিস মশা
আমাদের দেশে অ্যানোফিলিস কিউলিসিফেসিস (Anopheles Culicifacies) মশা ম্যালেরিয়ার প্রধান বাহক। এছাড়াও অ্যানোফিলিস-স্টিফেনশি (A. stephensi) (শহর ও শিল্পাঞ্চলে), ফ্রুভিয়াটিলিস (A. fluviatilis) (পাহাড় অরণ্যে), মিনিমাস (A. minimus) (তরাই, ডুয়ার্সে), ডাইরাস (A. dirus) (উত্তর পূর্বাঞ্চলে), এপিরোটিকাস (A. epiroticus) (আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে) প্রভৃতি প্রজাতি দেখা যায়। সাধারণত স্থির জলে হলেও কেউ কেউ প্রবহমান জলে, নোনা জলে, কেউ কেউ বহুতলের ট্যাঙ্কে ডিম পাড়তে পছন্দ করে। মশাদের জীবনচক্রে ডিম, লার্ভা, পিউপা ও পূর্ণাঙ্গ মশা চারটি স্তর থাকে। লার্ভা স্তরে মশা নিয়ন্ত্রণ সবচাইতে কার্যকর। পুদুচেরিতে ভারত সরকারের পতঙ্গ গবেষণা কেন্দ্র (VCRC) রয়েছে।
অ্যানোফিলিস মশা
ম্যালেরিয়ার মশারা সাধারণ ১৫০০ মিটার উচ্চতার মধ্যে ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে। বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী পর্যায়ে যখন জল জমার বিষয়টি থাকে তখন (জুলাই থেকে নভেম্বর) ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি হয়। ২০-৩০° সেলসিয়াস উষ্ণতায় ৬০ শতাংশ আদ্রতায় মশার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বিশ্বজুড়ে উষ্ণায়নের (Global Warming) কারণে মশা ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ হয়েই চলেছে। বেশি বৃষ্টি ও বন্যায় প্রথমে মশাদের প্রজনন স্থান ধুয়ে গেলেও পরে জমা জলে প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। মশাদের খাদ্যের ক্ষেত্রে পছন্দ অপছন্দের বিষয় আছে। কোন মশা মানুষের রক্ত খায় (Anthropophilic), কোন মশা কেবল পশুদের রক্ত খায় (Zoophilic)। আবার কোন ক্ষেত্রে পশু ও মানুষ উভয়ের রক্ত খেতে পারে।
ম্যালেরিয়া রোগের প্রধান উপসর্গ ও লক্ষণ
প্রধান উপসর্গ (Symptoms) প্রধান লক্ষণ (Signs)
(১) মাথা ব্যাথা (১) শরীরের উষ্ণতা বৃদ্ধি
(২) গা ব্যাথা (২) রক্তাল্পতা
(৩) দুর্বলতা (৩) জণ্ডিস
(৪) ঠাণ্ডা লাগা (৪) প্লীহার বৃদ্ধি
(৫) কাঁপুনি দিয়ে প্রবল জ্বর (প্রথমে মাঝে মাঝে আসে, (৫) যকৃতের বৃদ্ধি নিজে থেকে ঘাম দিয়ে ছাড়ে। ঠিকমত চিকিৎসা শুরু না হলে দু-তিন দিন পর থেকে টানা জ্বর শুরু হয়।)
(৬) গ্রন্থিগুলিতে ব্যাথা (৬) লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া
(৭) কাশি (৭) দেহে লালচে দাগ
(৮) বুকে ও পেটে ব্যাথা
(৯) ক্ষুধামান্দ্য
(১০) বমি ভাব
(১১) বমি
(১২) ডায়রিয়া
সেরিব্রাল বা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া রোগের প্রধান উপসর্গ ও লক্ষণ
(Cerebral or Malignant Malaria)
উপসর্গ (Symptoms) লক্ষণ (Signs)
(১) প্রবল জ্বর (১) প্রবল রক্তাল্পতা
(২) খিচুনি বা কনভালসন (২) কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে ক্ষতি
(৩) অজ্ঞান হয়ে পড়া (৩) ফুসফুসে জল
(৪) কোমা বা আচ্ছন্ন হয়ে পড়া (৪) রক্তচাপ কমে যাওয়া
(৫) শ্বাসকষ্ট হতে পারে (৫) শরীরের শর্করা কমে যাওয়া
(৬) শক ও দেহস্থ প্রধান অঙ্গগুলি বিকল হয়ে যাওয়া (৬) নিউমোনিয়া
(৭) জন্ডিস (৭) কালো মূত্র হতে পারে
(৮) প্লিহা ও যকৃতের বৃদ্ধি ও ব্যাথা (৮) মেটাবলিক এসিডোসিসের লক্ষণ
(৯) রক্তক্ষরণ
প্রবল জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে দেখাতে হবে। ঠিকমত চিকিৎসা না হলে বা দেরিতে চিকিৎসা শুরু হলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা ও নির্ধারণ
সারা দেশে এখন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, এএনএম ও আশা কর্মী স্তরে এবং সমস্ত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কোন জ্বরের রোগী পেলে ডাবল অ্যান্টিজেন Rapid Diagnostic Kit (RDK) দিয়ে ম্যালেরিয়ার Rapid Diagnostic Test (RDT) করা হয় এবং দ্রুত ফ্যালসিপেরম, ভাইভ্যাক্স বা কিছু ক্ষেত্রে দুরকম সংক্রমণ (Mixed infection) চিহ্নিত করা (Diagnosed) যায়।
একই সাথে ব্লাড স্লাইড টেনে নিকটস্থ ল্যবেরটরিতে একদিনের মধ্যে মাইক্রোসকপি পরীক্ষা করে ম্যালেরিয়া নির্ণয় (Confirmed) করার কথা। ম্যালেরিয়া স্লাইডে সংক্রমণের স্তর, ধরন ও ব্যাপকতা বোঝা যায়।
ম্যালেরিয়া চিকিৎসা
২০১৩-র ড্রাগ পলিসি অনুযায়ী সারা দেশে একই চিকিৎসা। শুধু উত্তর-পূর্বাঞ্চল ব্যতিক্রম। এই ওষুধগুলি প্রতিটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন রঙের প্যাকেটে পাওয়া যায়। গুরুতর অসুস্থতা, অজ্ঞান রোগী ও রোগের জটিলতার ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করতে হয়।
ক) ভাইভ্যাক্স ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা
১) ট্যাবলেট ক্লোরোকুইন (CQ): ১০ মি.গ্রা. প্রতি কে.জি. ওজনে পরপর দুদিন, তারপর ৫ মি.গ্রা. প্রতি কেজি ওজনে একদিন।
২) ট্যাবলেট প্রাইমাকুইন (PQ) : ০.২৫ মি.গ্রা. প্রতি কে.জি. ওজনে ১৪ দিন। এক বছরের নিচে শিশু, গর্ভবতী মা ও জি৬পিডি অভাবী ব্যক্তিদের প্রাইমাকুইন দেওয়া যায় না। প্রাইমাকুইন খাওয়ানোর সময় নজরদারি রাখতে হয়।
বিভিন্ন বয়সীদের ওষুধের মাত্রা
(CQ ২৫০ মি.গ্রা. ট্যাবলেটে রয়েছে ১৫০ মি.গ্রা. বেস)
খ) ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা
১) আরটেমিসিনিন বেসড কম্বিনেশন থেরাপি (ACT-SP): ট্যাবলেট আরটিসুনেট (AS) ৪ মি.গ্রা. প্রতি কেজি ওজনে তিন দিন এবং সালফাডক্সিন (১.২৫ মি.গ্রা. প্রতি কেজি ওজন) ও পাইরিমেথামিন (P, ১.২৫ মি.গ্রা. প্রতি কেজি ওজন) প্রথম দিন। ACT গর্ভবতীদের প্রথম তিন মাস (1st Trimester) দেওয়া যাবে না।
২) প্রাইমাকুইন (PQ): ০.৭৫ মি.গ্রা. প্রতি কেজি ওজনে দ্বিতীয় দিন।
বিভিন্ন বয়সীদের ওষুধের মাত্রা
উত্তর পূর্বাঞ্চলে জীবাণুর প্রতিরোধ জন্ম নেওয়ায় ACT-SP এর পরিবর্তে Artemether (২০ মি.গ্রা.)+ লুমেফ্যানট্রিন (১২০ মি.গ্রা.) কম্বিনেশন ACT-AL দেওয়া হয়। এটি ৫ বছরের নিচে শিশুদের ও গর্ভবতীদের দেওয়া যায় না।
গ) মিক্সড ইনফেকশনের চিকিৎসা
ফ্যালসিপেরামের তিন দিনের চিকিৎসা এবং ভাইভ্যাক্সের চতুর্থ থেকে ১৪ দিন অবধি প্রাইমাকুইন চিকিৎসা।
ঘ) গর্ভবতী ম্যালেরিয়া রোগীদের চিকিৎসা:
প্রথম তিন মাসের (Trimester) ক্ষেত্রে কুইনিন ১০ মিগ্রা। প্রতি কেজি ওজনে দিনে তিনবার করে সাত দিন।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিন মাসের ক্ষেত্রে ACT-SP / উত্তর পূর্বাঞ্চলের ক্ষেত্রে ACT-AL ।
ম্যালেরিয়ার পরজীবী প্রোটোজোয়ার জীবনচক্র
ঙ) ভ্রমণকারীদের ক্ষেত্রে (Chemoprophylaxis)
ছয় সপ্তাহের কম সময়ের জন্য ম্যালেরিয়া প্রবণ জায়গায় গেলে-ট্যাবলেট ডক্সিসাইক্লিন ১০০ মি.গ্রা. রোজ। আট বছরের নিচে বাচ্চাদের দেওয়া যাবে না। ৮ – ১৫ বছর ১.৫ মি.গ্রা. প্রতি কেজি ওজনে। বেরোনোর দুদিন আগে থেকে খেতে হবে এবং ফেরার পর চার সপ্তাহ।
ছয় সপ্তাহের বেশি যাত্রার ক্ষেত্রে—
ট্যাবলেট মেফ্লোকুইন ২৫০ মি.গ্রা. প্রতি সপ্তাহে। বেরোনোর দু-সপ্তাহ আগে থেকে এবং ফেরার পর চার সপ্তাহ।
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ
এর প্রধানত দুটি অংশ। (এক) মশার নিয়ন্ত্রণ। এই নিয়ে নানারকম গবেষণা চলছে। Integrated Vector Management (IVM) কার্যকর করার চেষ্টা হচ্ছে। মোদ্দা কথা জল জমতে না দেওয়া বা জল জমলে তা পরিষ্কার করা বা বেরিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা (Source Reduction) যাতে মশা বংশবৃদ্ধি না করতে পারে। লার্ভা নিধনের জন্য পরিবেশ বান্ধব Biocidal ব্যবহার করা হয়। জলাশয়ে লার্ভা ধ্বংসকারী গাপ্পি ও গাম্বুসিয়া মাছ ছাড়া হয়। ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকায় বছরে দুবার Indoor Residual Spraying (IRS)-র ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি বছর জুন মাসকে ম্যালেরিয়া মাস (Malaria Month) হিসাবে পালন করা হয় জনচেতনা বাড়ানো এবং যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিন (STM), মেডিকেল কলেজগুলি প্রভৃতিতে ম্যালেরিয়া সহ পতঙ্গবাহিত রোগের উপরে গবেষণাতে জোর দেওয়া প্রয়োজন।
অ্যানোফিলিস মশার বংশবৃদ্ধি
(দুই) ব্যক্তিগত নিরাপত্তা (Personal Protection): ঘরবাড়ি ও তার আশপাশ এবং পল্লীকে পরিচ্ছন্ন ও আলোকিত রাখা। জল জমতে না দেওয়া। ঢাকা (Covered) ফুল হাতা জামা ও ফুল প্যান্ট সুতির পোশাক এবং ঢাকা জুতো ও মোজা পরা। ঘুমোনোর সময় মশারির (Bed Net) মধ্যে ঘুমোনো। ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকায় Long Lasting Impregnated Bed Net (LLIN) অথবা মশা নিবারক রাসায়নিক মাখানো মশারি ব্যবহার করা। এর জন্য স্বাস্থ্য ও সমাজ কর্মীদের মানুষকে ভালোভাবে বোঝাতে হয় (BCC বা Behavioural Change Communication)।
ম্যালেরিয়া টীকাঃ দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের কলম্বিয়ার চিকিৎসা বিজ্ঞানী মানুয়েল এলকিন পাতারো মুরিলো ১৯৮৭ সালে ম্যালেরিয়ার মিশ্র টীকা (Cocktail Vaccine) আবিষ্কার করেন। এখন আফ্রিকা মহাদেশের বারকিনা ফাসো, ঘানা, কেনিয়া এবং মালাউই তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) অনুমোদনে সেরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া এবং অক্সফোর্ড বায়মেডিকাল রিসার্চ সেন্টার প্রস্তুত ৫ মিউ গ্রাম R 21 এবং ৫০ মিউ গ্রাম Matrix M মিশ্র টীকা চার সপ্তাহ বাদ দিয়ে তিন বার এবং এক বছর বাদে একটি বুস্টার ডোজ পাঁচ থেকে ৩৬ মাস বয়সী শিশুদের দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় টীকার ৬৮% থেকে ৭৫% কার্যকারিতা (Efficacy) দাবি করা হচ্ছে। ভারতে এই পরিষেবা উপলব্ধ নয়।
[সূত্র:
- National Drug Policy on Malaria 2013 – Directorate of National Vector Borne Disease Control Programme
- Manual on Integrated Vector Management in India 2022 – National Center for Vector Borne Diseases Control
- Medical Officers’ Handbook for Clinical Management of Dengue & Malaria, 2018 – Department of Health & FW, GOWB
- Davidson’s Principles & Practice of Medicine (24th Edn.)
- Current Medical Diagnosis & Treatment, 2023
- Park’s Textbook of Preventive and Social Medicine – K. Park (27th Edn.)
- Safety and efficacy of malaria vaccine candidate R21/Matrix-M in African Children: a multicentre, double – blind, randomised, phase 3 trial by Mehreen S Datoo et al – The Lancet, Vol 403, February 10, 2014 ]