১.
মাস্ক জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে ওঠার পর আর কার কতখানি ভালো হয়েছে জানি না, আমার অনেকগুলো লাভ হয়েছে।
আমার সাংঘাতিক অ্যালার্জিক রাইনাইটিসের ধাত। সামান্য ধুলোবালি নাকে ঢুকলেই ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শুরু হয়ে যায়। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর নাকে ঠান্ডা বাতাস ঢুকলে তো আর কথাই নেই। সারাদিন ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে’। সাথে মাথা ধরে ভার। সে যে কী কষ্ট যার হয় সেই বোঝে। ‘ওই তো সামান্য হাঁচিসর্দি’ বলে বাঁকাচোখে তাকাবেন না প্লিজ। শরীরের কলকব্জাগুলো আমার এমনিতে বেশ ভালো। অ্যালার্জিক রাইনাইটিস আর আইবিএস ছাড়া সেরকম কোনও সমস্যা নেই। ছোটোখাটো চোট-আঘাত তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই। কাজের জায়গাতেও শরীর খারাপের জন্য ডা. সৌম্য ডিউটিতে যায় নি এরকম উদাহরণ খুব কম। সেই আমি, অ্যালার্জিক রাইনাইটিসে দস্তুরমত নাজেহাল হতাম। মাস্কে নাকমুখ ঢাকা থাকায় সে সমস্যা অনেকখানি কমেছে। ন্যাজাল-স্প্রে বা অ্যালার্জি কমানোর ওষুধপত্র প্রায় লাগছে না বললেই চলে। এমনিতেও মাস্কের সুরক্ষায় সামগ্রিকভাবে সাধারণ ভাইরাল সর্দি-কাশি অনেক কমে গেছে বলেই আমার ধারণা।
আরও একটা বড় সুবিধে হয়েছে। অপরিচিত মানুষ বা পরিবেশে আমার অস্বস্তি হয়। দুটো কথা বলার পর তিন নম্বর কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলি। অথচ বিভিন্ন কাজের সুবাদে পরিচিতির বহর বড় কম নয়। হঠাৎ কেউ চিনে ফেললে দাঁত বের করে ভেবলে তাকিয়ে থাকি। পালাতে চাই। মাস্ক এসে সেই প্রয়োজনীয় আড়ালটা দিয়েছে। সব মিলিয়ে, কোভিড চলে যাওয়ার পরেও মাস্ক আমার রোজকার পোশাক হতে যাচ্ছে।
২.
ভুলিনি। কিচ্ছু ভুলিনি।
তখন সদ্য কোভিডকাল শুরু হয়েছে। বাজারে মাস্ক অপ্রতুল। কীভাবে রোগের বিরুদ্ধে লড়া যায় কেউ জানে না। অসুস্থ হ’লে কোথায়, কীভাবে চিকিৎসা হবে সে নিয়ে ধোঁয়াশা। সঙ্গে অপরিসীম আতঙ্ক। বেশিরভাগ চেম্বারেই দু-ফুট দূরত্ব বজায় রেখে বসার মতো জায়গা নেই। ফলে চেম্বারগুলোই কোভিডের ছোট ছোট উপকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারতো। এরকম অবস্থায় ছোটোখাটো চেম্বারের ডাক্তাররা রোগী দেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাথে সাথে বিষোদগার শুরু হয়ে যায়। এতদিন যে প্রাইভেট প্র্যাক্টিশনাররা শুধুমাত্র ‘কসাই’ ছিলেন এবার তাঁরাই ‘কসাইখানা’ বন্ধের অভিযোগে বিদ্ধ হলেন।
কিছুদিন পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হ’ল। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে পিপিই-র অসহ্য কষ্ট নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা লড়াই শুরু করলেন। বাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা আমাদের সহনাগরিকরা স্বাস্থ্যকর্মীদের পাড়ায় ঢুকতে বাধা দিলেন। সোজাসাপটা বক্তব্য ছিল, স্বাস্থ্যকর্মীরা হাসপাতালে নোংরা ঘেঁটে আসে। কাজেই তারা পাড়ায় রোগ ছড়াবে। ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন পেটে খাবার নেই, গলায় জল নেই। তারপরও বাড়ি ফিরতে না পারার মানসিক যন্ত্রণা। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আমাদের বন্ধুস্থানীয় সহনাগরিকরা ছুঁচো গিলতে বাধ্য হলেন বটে কিন্তু ততদিনে সমাজের মুখোশহীন রূপ আমাদের কাছে পরিষ্কার। রাস্তায়-টেলিফোনে-মেসেজে-হোয়াটসঅ্যাপে ফ্রি মেডিক্যাল অ্যাডভাইসের অনুরোধ এলে আমার সেসব দিন মনে পড়ে যায়। খুব সম্ভবত ভুলবোও না কোনোদিন।
৩.
আউটডোরে ঘাড় গুঁজে পেশেন্ট দেখে যাচ্ছি। দেড়টা পেরিয়েছে। এখনো রোগী আসার বিরাম নেই।
সুন্দরবন থেকে এসেছে সবুজ নস্কর। থাইরয়েডের রোগী। রোজ ওষুধ খেতে হয়। অথচ কোন বেয়াক্কেলে আজ তিনমাস ওষুধ বন্ধ রেখেছে! পায়ের পেশীর ব্যথাটা বেড়েছে। রক্তের রিপোর্টও তথৈবচ। তেড়ে গালাগালি করলাম।
সবুজের কোঁচকানো জামা পরা, বেঁটেখাটো, হাতের শিরা ওঠা বাবা লজ্জায় মুখ নিচু করে বললো-
– বড় ভুল হইয়ে গ্যাসে ডাক্তারবাবু। বাইরে খাটাখাটনির কাজ করতুম। লক-ডাউনের জন্যি কাজে যেতি পারি নি। হাতে সেরকম পয়সাও সিল নি। দুইটা নদী, তাপ্পর ম্যাজিক ভ্যান, ট্রেনে করি শ্যালদা, তাপ্পর আবার বাস। কী করি আসব বলঅ… ট্রেনও ত বন্দ স্যালঅ…
প্রফেশনাল মুখোশের আড়াল থেকে বলি-
– সে যাই হোক, তুমি ওষুধ বন্ধ করলে কেন? বাইরে থেকে কিনেও তো খাওয়াতে পারতে। জানো, এর জন্য বাচ্চার কত ক্ষতি হ’ল? তোমাকে তো পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে ওষুধ বন্ধ করবে না…
সবুজের বাবা কিছু বলে না। শহরের বড় হাসপাতালের ডাক্তারের সাথে এর চেয়ে বেশি মুখে মুখে কথা বলার অভ্যেস তার নেই। আমি খসখসিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখে চলি। সবুজের বাবা, তুমি জানো না- ডাক্তারের চেয়ারে বসা লোকটাও মুখোশের আড়ালে লজ্জায় মরে যায়। এ পৃথিবীটা তোমার মতো গরীব বাপের বাচ্চার জন্য নয়। পয়সা থাকলে গ্যারাজে দামী বিদেশি গাড়ির পাশে ‘স্বাস্থ্য’ও কিনে রাখা যায়।
নাক-মুখ ঢাকা এন-৯৫ আমার লজ্জাও ঢেকে দেয়। ভাগ্যিস!
৪.
ভোট আসতেই স্বাস্থ্যবীমার ঢক্কানিনাদ শুরু হয়েছে। অনেকে তার চমকে মোহিত হতেও শুরু করেছেন। পরিষ্কার ভাবে জেনে রাখুন, কোনও বীমা দিয়ে জনস্বাস্থ্যের প্রকৃত উন্নতি হয় না। চাই সবার জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সবরকমের সরকারি চিকিৎসা। জিনিসটা খুব অবাস্তব- এরকমও মনে করার কোনও কারণ নেই। পৃথিবীতে ৪১ টি দেশ জনগণের স্বাস্থ্যের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয়।
স্বাস্থ্য মানুষের অধিকার। বীমার চাকচিক্য দিয়ে যারা সেই বুনিয়াদি অধিকার ভুলিয়ে রাখতে চায় তাদেরও মুখ-মুখোশের তফাতটা বুঝে নেওয়া জরুরি।
আপাতত মারীর দেশের নানা রঙের মুখোশের আড়ালে মুখ খুঁজে পাওয়া ভার!
ছবিঃ গুগল