মেডিকেল কলেজ কোলকাতার নতুন প্রথমবর্ষের ছাত্রছাত্রীদের orientation programme-এ কলেজ অথোরিটির তত্বাবধানে অবৈজ্ঞানিক, পশ্চাদমূখী চরক শপথ পাঠ করানোর প্রতিবাদে MCDSA-র প্রেস বিবৃতি
গতকাল মেডিকেল কলেজ কলকাতার প্রথম বর্ষের প্রথম ক্লাস শুরু হওয়া উপলক্ষে কর্তৃপক্ষের তত্বাবধানে White Coat Ceremony-র সাথে সাথেই ‘চরক শপথ’ পাঠ করানো হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের। এই শপথ পাঠ নাকি হয়েছে NMC-র নির্দেশে।
কী আছে এই শপথে?
1. শপথবাক্য শুরুই হচ্ছে শপথগ্রহণকারীকে ‘দ্বিজ’ হিসেবে নির্দিষ্ট করে। ‘দ্বিজ’ শব্দের অর্থকে ‘দ্বিতীয়বার জন্ম নেওয়া’ অর্থাৎ ‘শিক্ষিত’ হিসেবে বর্ণনা করে জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলেই ‘দ্বিজ’ বলে ফুটনোট দিলেও তার সামাজিক অভিঘাত লুপ্ত হয়ে যায় না। শব্দটির ব্যবহার প্রধানত ব্রাহ্মণদের বোঝাতে, শিক্ষার উপরে ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য বোঝাতে। শপথে সেই শব্দের ব্যবহারও সেই ব্রাহ্মণ-আধিপত্যের অন্ধকার যুগের চিহ্নবাহী।
2. শপথ নেওয়া হচ্ছে ‘পবিত্র অগ্নি’-র সামনে – যুক্তিবাদী বিজ্ঞানের বদলে হঠাৎই অগ্নির পবিত্রতা কোথা থেকে আসে, সেটা যেমন প্রশ্নসাপেক্ষ, তেমনই এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সরকারি কলেজে ধর্মীয় শপথই পাঠ করানো হচ্ছে।
3. শপথের মূল বাক্যেও মেডিক্যাল এথিক্সের বদলে গুরুত্ব পাচ্ছে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবন, ‘গুরু’-র প্রতি ভক্তি এবং আনুগত্য।
4. রোগিনীদের সম্পর্কে পুরুষ চিকিৎসকদের কর্তব্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে চিকিৎসা হবে কেবলমাত্র স্বামী বা নিকটাত্মীয়ের উপস্থিতিতে।
ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ধর্মই হলো যুক্তি-বুদ্ধির উপরে প্রশ্নহীন আনুগত্যকে তুলে ধরা, অতীতের ঐতিহ্য বা জাতির গৌরবের ধ্বজা তুলে সকল প্রগতির বিরুদ্ধে রক্ষণশীলতার পাঁচিল খাড়া করা। কর্তৃপক্ষর চাপিয়ে দেওয়া চরক শপথেও সেই ফ্যাসিবাদের পদধ্বনিই স্পষ্ট।
আমরা, মেডিকেল কলেজ ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন, একটি প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসেবে এই জাতিবিদ্বেষী, লিঙ্গবিদ্বেষী, যুক্তিবিমুখ এবং ধর্মীয় প্রভাবযুক্ত চরক শপথ পাঠের তীব্র বিরোধিতা করছি। যে মেডিকেল কলেজ কলকাতা যুক্তি ও প্রগতির পীঠস্থান, সেখানে এই পশ্চাদপথযাত্রী শপথ কোনোমতেই মেনে নেওয়া সম্ভব না। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটানোর দাবি জানাচ্ছি। এই ঘটনাকে সরকারি স্বীকৃতি দিলে, সে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা কলেজ কর্তৃপক্ষই হোক, আমরা বৃহত্তর আন্দোলনের পথে যেতে বাধ্য হবো।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের প্রেস বিজ্ঞপ্তি
২৩.০২.২০২২
মেডিক্যাল কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের চরক শপথ পাঠ করানো হয়েছে। এই শপথ গত কয়েকদিন ধরে বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছে। এর মধ্যে এই বিতর্কিত পদক্ষেপ একটি অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক উস্কে দেবার আরেকটি প্রচেষ্টা। বিশেষ করে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের দ্বারা যাদের এখনো নিজেদের স্বাধীন গোষ্ঠীবদ্ধ মতামত এখনো তৈরি হয় নি। হিপোক্রেটিস ও চরক নিজেদের স্বমহিমায় আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর বিরাট অবদান রেখেছেন।ডাক্তারদের শপথবাক্যের প্রয়োজনীয়তা, অতিপ্রাচীন হিপোক্রেটিক বা চরকের বক্তব্যের আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে ভূমিকা নিয়ে আলোচনা কাম্য ও স্বাগত। কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রের এই দুজন বিরোধহীন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ত্বের মধ্যে কল্পিত বিতর্ক সৃষ্টির প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। ভয়াবহ কোভিড অতিমারীতে সরকারের হাসপাতালের বেডের, ওষুধ, অক্সিজেনের অভাব, সামনের সারিতে কোভিড শহীদ স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্ষতিপূরণের বিষয় থেকে মুখ ঘোরাতেই এই রাজনৈতিক বিতর্ক। কোয়াকারি, মিক্সোপ্যাথি, স্বাস্থ্যে ও মেডিক্যাল শিক্ষাতে অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারিকরন আজকের দিনে অনেক বেশি চিন্তার বিষয়।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের তরফে করোনাকাল ও এই কঠিন সময়ে মানুষের জীবনের, জীবিকার, স্বাস্থ্যের প্রয়োজন কে পেছনে ফেলে অযাচিত বিতর্ক সৃষ্টির এই প্রচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে।
ডা: রাজীব পান্ডে
ডা: শোভন দাস
ডা: পুণ্যব্রত গুণ
(ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম)