হঠাৎ আমার লেখাপত্রের এমন ইংরেজি শিরোনাম কেন দিলাম, তাই নিয়ে বন্ধুরা ধন্দে পড়তে পারেন। আসলে কয়েক পর্বে যে লেখাটা লিখতে বসেছি, এর চেয়ে উপযুক্ত নাম তার শিরোভূষণ হতে পারত না কিছুতেই। বাংলায় ঠিক ভাবটি ফোটাতে পারছিলাম না মোটে — অগত্যা ইংরেজি।
তবে নামে যখন কিছু আসে যায় না, তখন শিরোনামেও যাবে আসবে না আশা রাখছি।
আমার ডাক্তারি পড়তে আসাটা একটা দুর্ঘটনা। সব ধাপগুলো ডিঙিয়ে একদিন ফাইনাল এমবিবিএস পাশ করে যাওয়াটা আরও বড় অঘটন। এই না-ভালবাসার পাঠক্রমকে অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারিনি কোনোদিনই। আমার সহপাঠী বন্ধুবান্ধব যখন চিকিৎসাবিদ্যার সরোবরে জলচর জীবেদের মতো স্বচ্ছন্দ বিচরণ করছে, আমি তখন ভীরু চোখে কূলে বসে পা ভেজাচ্ছি — জলে নামার ইচ্ছে এবং সাহস কোনোটাই ছিল না আমার।
তবু কেমন করে যেন তরে গেলাম শেষ পরীক্ষাটাতেও। মনে পড়ে, ভয়ের চোটে কলেজ অফিসের দেওয়ালে টাঙানো রেজাল্টের দিকে তাকাতে পারছি না, বাবা জোর করে আমার চিবুক ধরে সেই দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে — “চেয়ে দ্যাখ বাপি, ঐ তো তোর রোলনম্বর জ্বলজ্বল করছে — তাকা, চোখ খুলে তাকা, পাশ করে গেছিস তুই! ইউ আর এ ডক্টর নাউ”—
তিরিশ বছর আগের সেই অবিশ্বাস্য স্বপ্নিল বিকেলকে পিছনে ফেলে এসেছি বহুদিন — নতুন ডাক্তার হওয়ার, মায়ের অদম্য আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করে অসম্ভবকে সম্ভব করার সদ্যমুকুলিত গর্ব, ‘পাতি এমবিবিএস’-এর ফ্যাকাসে রাবার স্ট্যাম্পের নিচে মুখ লুকিয়েছে লজ্জায়।
কিন্তু শেষ কলেজি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যখন হয়েই গেলাম, অদৃশ্য স্টার্টার যখন শূন্যে ছুঁড়েই দিলেন গুলিটা, তখন নির্ভুলভাবে জেনে গেলাম দৌড়োতে আমাকে হবেই। যতই গোলমেলে লাগুক ট্র্যাক, দু’পাশ দিয়ে হুশ হুশ করে আমাকে ছাড়িয়ে অনেক, অনেক এগিয়ে যাক সহপাঠী বন্ধুরা, ব্যথায় টাটিয়ে উঠুক অনিচ্ছুক পা দুটো, ছুটে যেতেই হবে আমাকে। ছুঁতে হবে ফিনিশিং লাইন। যদি সবার শেষেও ছুঁই, তবুও।
অভিমন্যুরা কোনোকালেই ফেরার পথ চিনে রাখে না — কেন কে জানে!
তবে আমি তো হোঁচট খেতে খেতে, জিরিয়ে নিয়ে থামতে থামতে ছুটেছি, আমার কাঁধের নকশিকাঁথার ঝুলিতে ডিগ্রি ডিপ্লোমা তাই জমেনি কিছুই — জমেছে অনেক অভিজ্ঞতা। তেমন কাজের নয়, তবে ফেলেও দিতে পারি না প্রাণে ধরে। সেই আটপৌরে, মায়াবী অভিজ্ঞতার স্মৃতি মাঝে মাঝে চোখে অকারণ অশ্রু এনে দেয়, আবার কখনো গ্রীষ্মের একলা সন্ধেবেলায়,কেজো বর্তমানের পাথুরে মেঝেয় ভাললাগার শীতলপাটি বুনে রাখে আমার জন্য – আমি গা ঢেলে দিই আরামে। বন্ধ চোখের পর্দায় পুরোনো রংচটা দিনেরা খেলা করে আপন মনে।
ইন্টার্নশিপ শেষ হবার পরে আমাদের বাধ্যতামূলক হাউসস্টাফশিপ করতে হতো এক বছরের জন্য — তার মেয়াদ বাড়ানোটা ছিল ঐচ্ছিক।
সচরাচর ফাইনাল এমবিবিএসে যে বিষয়ে নম্বর বেশি রয়েছে, সেই বিষয়েই হাউসস্টাফশিপ করতে চাইত ছাত্ররা। ব্যতিক্রম ছিল না এমন নয়, তবে তা ছিল নগণ্য।
মা চেয়েছিল আমি গাইনেকলজিতে হাউসস্টাফশিপ নিই, কারণ শেষ পরীক্ষায় ঐ একটি বিষয়ে আমার নম্বর মোটামুটি ভদ্রস্থ ছিল। তাছাড়া, আমার পুরোনোপন্থী মা ভেবেছিল, মেয়ে ডাক্তার তো গাইনি হওয়াই স্বাভাবিক — পসার জমাতে সুবিধে হবে।
আমার ইচ্ছের সঙ্গে মায়ের ধারণা মোটেই মিলল না। আমি পেডিয়াট্রিকস অর্থাৎ শিশুচিকিৎসায় হাউসস্টাফশিপ করব বলে দরখাস্ত লিখে ফেললাম। ফাইনাল এমবিবিএসে পেডিয়াট্রিক্স জেনারেল মেডিসিনের অন্তর্গত ছিল, আলাদা বিষয় হিসেবে পরীক্ষা দিতে হতো না। আর জেনারেল মেডিসিনে আমার প্রাপ্ত নম্বর ছিল শিক্ষকদের ভাষায় যাকে বলে — “পুওর মার্কস”!
মা সব শুনে মন্তব্য করল, ”চিরকালের গাড়ল”!
বাবা ফিসফিস করে বললো — “সেকেন্ড চয়েস গাইনি দিয়েছিস তো? না হলে তোর মা কিন্তু খুব ক্ষেপে যাবে, বলে দিলাম।”
পেডিয়াট্রিকসে সাকুল্যে দশটি সিট ছিল হাউসস্টাফশিপে। যেদিন ফাইনাল লিস্ট বেরোলো, সেদিন দেখলাম, আমার ন’জন উজ্জ্বল সহপাঠীর সঙ্গে, দশম ব্যক্তি হিসেবে নেহাৎই কান ঘেঁষে, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের শিশু চিকিৎসার আঙিনায় চুপিসাড়ে ঢুকে পড়েছি আমি। অপাংক্তেয়র মতো, অনধিকারীর মতো, ভিনগ্রহের জীবের মতো।
(ক্রমশ)