কয়েক মাস আগে হারিয়েছিলাম এক অগ্রজ-কে, ডা স্থবির দাশগুপ্ত। আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ডা নৃপেন ভৌমিক। অল্প কিছুদিন আগে তাঁর ফুসফুসের ক্যান্সার ধরা পড়ে, কয়েকদিন আগে সেরিব্রাল হেম্যারেজ, অচেতন। জ্ঞান ফেরেনি আর। ২৯শে মে, ২০২৪ বিকেল ৩টে ৫মিনিটে তাঁর মৃত্যু ঘোষণা করা হয়।
নৃপেনদা সত্যিকারের অর্থেই আমাদের অগ্রজ ছিলেন সমাজ পরিবর্তনকামী ছাত্র রাজনীতিতেই বলুন বা মাতৃভাষায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের চর্চায়।
১৯৫০ এর ৪ঠা জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা জেলায় জন্ম তাঁর। স্কুলের পড়াশোনা কৃষ্ণনগরে। সিএমএস সেন্ট জন্স হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৬৭ সালে। মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৯ সালে ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্যাজুয়েট মেডিকেল এডুকেশন এন্ড রিসার্চ থেকে শল্য চিকিৎসায় এম এস। সেখান থেকেই স্নায়ু শল্য চিকিৎসায় এমসিএইচ পাস করেন ১৯৮৮ সালে।
বাঙ্গুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি-তে স্নায়ু শল্য চিকিৎসার লেকচারার হিসেবে কাজ করেন কিছুদিন। তারপর সরকারি চাকরি ছেড়ে রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এছাড়াও যুক্ত ছিলেন বেসরকারি উডল্যান্ডস হাসপাতালের সঙ্গে। নৃপেনদার কাছে শোনা–রোগীর চিকিৎসার গুণমানের ব্যাপারে সমঝোতা করতে না পারায় রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান ছাড়েন তিনি। তারপর যুক্ত ছিলেন কেপিসি মেডিকেল কলেজে, স্নায়ু শল্য চিকিৎসার অধ্যাপক হিসেবে।
চিকিৎসক জীবনে নৃপেনদা, প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু যে কাজ করে গেছেন তা সমাজ পরিবর্তনের কাজের পরিপূরক। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে ধোঁয়াশা মুক্ত করে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলা ভাষায় লিখেছেন অনেকগুলি বই।
- স্নায়ুতন্ত্রের রোগ
- চিকিৎসা বিজ্ঞান কোষ
- ভাষা ও মস্তিষ্ক
- কোমরে ব্যথা
- স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্ক
- মাথাব্যথা
- মৃগী রোগ
- বিকল্প চিকিৎসা
- ঘাড়ে ব্যথা
চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাংলা পরিভাষা তৈরি করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ‘চিকিৎসা পরিভাষা অভিধান’ রচনার জন্য তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার পান। তাঁর সম্পাদনায় বড় একটি কাজ চিকিৎসা বিজ্ঞান কোষ, British Medical Association-এর A to Z Medical Encyclopedia-র মত এই গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা বিজ্ঞান কোষ। একই ধরনের গ্রন্থ ‘ডাক্তারি অভিধান’ প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ থেকে।
এছাড়া তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থঃ
- বাংলার শব্দ কথা
- দুই বঙ্গের স্থাননাম
কেবল ডাক্তারি আর বই লেখা নিয়েই থেকে যেতে পারতেন তিনি। তা না করে গড়ে তুললেন বাংলার প্রথম কমিউনিটি কলেজ। সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের যেসব ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হয় তাদের বৃত্তিমূলক কাজ শিখিয়ে স্বাবলম্বী করার এক উদ্যোগ। ২০১৬ সালে প্রথম ক্যাম্পাস মাদুরদহে। দ্বিতীয় ক্যাম্পাস ্সর্মস্তপুরে। বছরে দুটি করে ব্যাচ (জানুয়ারী ও জুলাই), এক বছরের কোর্স, হাতে কলমে বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ শেখার ব্যবস্থা। এই কমিউনিটি কলেজ থেকে যারা কাজ শিখতে বেরোয় তাদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ বিভিন্ন হাসপাতালে নার্সিং এসিস্টেন্ট হিসেবে নিযুক্ত। তাদের জন্য ম্যানুয়ালও সম্পাদনা করেন নৃপেনদা–‘নার্সিং এর সহজ পাঠ’। উত্তরবঙ্গে আম্বিয়কে তিনি কমিউনিটি কলেজের তৃতীয় শাখা খোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সফল হননি।
আমার থেকে ঠিক দশ বছরের সিনিয়র ছিল নৃপেনদা। প্রথম পরিচয় ১৯ ৮৫ সালে। আমি তখন মেডিকাল কলেজে সার্জারীর হাউসস্টাফ, আমাদের ইউনিটের মেডিকেল অফিসার অমরেশ ব্যানার্জি নৃপেনদার ক্লাসমেট, অমরেশদা নৃপেনদার সঙ্গে দেখা করতে গেছিল। পিজি হাসপাতালের ক্যান্টিনে এক কোণে বসে খাচ্ছিল নৃপেনদা। নৃপেনদা তখন বি আই এন-এ আরএমও। আমার সঙ্গে কথা হয়নি।
লম্বা গল্প ১৯৯৫ সালে। ছত্তিশগড় থেকে পশ্চিমবঙ্গে ফেরার পর নৃপেনদার আরেক সহপাঠী দেবাশীষ বক্সীর সঙ্গে কাজ করি তখন। দেবাশীষদা তার প্রতিষ্ঠান দেখানোর জন্য নৃপেনদাকে আনার দায়িত্ব দিল আমাকে। বেহালা ব্লাইন্ড স্কুলের বিপরীতে অবস্থিত ওর ফ্ল্যাট থেকে গাড়ি চালিয়ে নৃপেনদা এলো মৌরিগ্রামে আমার কাছে ছত্তিশগড়ে আট বছরের গল্প শুনতে শুনতে।
২০০০ সালে অধ্যাপক পীযূষকান্তি সরকারের নেতৃত্বে আমরা যখন ‘অসুখ-বিসুখ’ পত্রিকা বার করার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনকার বৈঠকগুলোতে নৃপেনদা আমাদের সঙ্গে ছিল। পরিভাষা নিয়ে মতপার্থক্য হয়, নৃপেনদা তদ্ভব পরিভাষার পক্ষে ছিল। শেষ অব্দি একসঙ্গে ওই কাজটা করা হয়নি।
একসঙ্গে কাজ চিকিৎসা বিজ্ঞান কোষ রচনর সময়। আমি, জয়ন্ত দাস, সুমিত দাশ, শর্মিষ্ঠা রায্ প্রদীপ সাহা, সোহম সরকার–শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের অনেকেই ছিলাম এই উদ্যোগে।
শুরুর দুবছর ছিলাম দধীচি কমিউনিটি কলেজে শিক্ষক হিসেবেও। শেষ অবধি থাকা হয়নি। তবে ২০২৩ এর ১লা জানুয়ারি দধীচি কমিউনিটি কলেজের সমাবর্তনে বিশেষ অতিথি ছিলাম আমি।
শেষ দেখা এ বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের দিন ডক্টরস’ ডায়লগ-স্বাস্থ্যের বৃত্তে-প্রণতি প্রকাশনীর যৌথ অনুষ্ঠানে। মাতৃভাষায় চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে বলেছিল নৃপেনদা।
আজ নৃপেনদা আমাদের সঙ্গে নেই। কিন্তু যে কাজগুলো সে শুরু করে গেছে সেগুলো এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমরা কি নেব না?
প্রথম লাইনে স্থবির দাশগুপ্ত হয়ে গেছেন “ছবির দাশগুপ্ত “। এত দরদী লেখার সঙ্গে বড় দৃষ্টিকটু লাগছে। ঠিক করে দিন।
ঠিক করে দিলাম, দাদা। দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ধন্যবাদ।