১০ ই অক্টোবর, আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এই বছরের থিমটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। Mental health in an Unequal world. অর্থাৎ অসাম্যের এই পৃথিবীতে মানসিক স্বাস্থ্য!
কোভিড মহামারি ছড়িয়ে পড়ার প্রায় ১৮ মাস পরে ২০২১ সালের ১০ই অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উদযাপিত হচ্ছে, পৃথিবীর সব কটি দেশেই কোভিড মহামারীর প্রভাব পড়েছে। এই মহামারি আমাদের সামনে সামজিক সঙ্কট, অর্থনৈতিক সঙ্কট, শিক্ষার সমস্যা, স্বাস্থ্যের সমস্যা আমাদের সামনে উজার করে নিয়ে এসেছে এবং এই প্রতিটি সমস্যাই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে ফেলতে গেছে। বিশেষ করে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া, তাদের স্বাভাবিক শৈশব থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, অন লাইন ক্লাসের সুবাদে কিছ জায়গায় পড়াশোনা চললেও তা যৎকিঞ্চিত। UNESCO বলছে প্রায় ৮৩০ মিলিয়ন বাচ্চাদের বাড়িতে ক্লাস করার মতো কম্পিউটার ও নেট পরিষেবা নেই! যেখানে ধনীরা আরও ধনী হয়, গরিবেরা আরও গরিব, আর এই ব্যবধান ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে গেছে, ‘যার আছে’ এবং ‘যার নেই’ তার ফারাক অনেক বড় হয়ছে! এই মহামারি পৃথিবীকে যেন দুই মেরুতে ভাগ করে দিয়েছে, আরও ছোট-বড়র এই পৃথিবীকে আরও অসাম্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অর্থাৎ সমাজের উঁচুস্তরের লোকেরা খুব সহজেই স্বাস্থ্যের সুযোগ পাচ্ছেন, কিন্তু নিচুস্তরের লোকেদের অর্থাৎ যাঁদের কাছে টাকা পয়সা কম আছে আর্থিক ভাবে দুর্বল তাঁদের ক্ষেত্রে, আরও বেশি করে স্বাস্থ্যের সুযোগ দূরে সরে যাচ্ছে!
বেড়ে যাচ্ছে ট্রিটমেন্ট গ্যাপ অর্থাৎ মানসিক রোগ ও মানসিক চিকিৎসার আওতায় যাঁরা রয়েছেন তাদের ফারাক। মহামারির আগে যা ছিল ৭০-৮০% মহামারির পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৯০% এর কাছাকাছি। যেভাবে মহামারির সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ বেড়েছে গুরুত্ব সহকারে সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাই স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি সাংঘাতিকভাবে ঘটেছে, লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, ঘরে না ফেরা, ঘরে আটকে থাকা, মহামারির জন্যে দুশ্চিন্তা, আরও বেশি করে দুনিয়া জুড়ে মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে! বেড়েছে পারিবারিক হিংসার ঘটনা, স্কুল বন্ধ হওয়ায় বাচ্চাদের এক স্বাভাবিক বিকাশের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ঘরবন্দী সময়টা! সমস্ত পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাওয়া, হেলথ কেয়ার সার্ভিসগুলো অচল হয়ে পড়া ঠিকঠাক ওষুধের সরবরাহ না থাকা অনেক কারণ মিলিয়ে আজ স্বাস্থ্য পরিষেবা ও মানসিক রোগের মধ্যে ব্যবধান প্রচুর!
১৯৯২ সালের ১০ ই অক্টোবর World Federation for Mental Health-এর বার্ষিক অনুষ্ঠান উদযাপনে জেনারেল সেক্রেটারি রিচারড হান্টার (Richard Hunter)-এর উদ্যোগে এই সচেতনতামূলক প্রোগ্রামের প্ল্যান করা হয়! ১৯৯৪ সালে জেনারেল সেক্রেটারি ইউগেন ব্রডি (Eugen Brody)-র হাত ধরে প্রথম থিম ব্যবহার করে সমস্ত পৃথিবী জুড়েই এর প্রচার অভিযান চালানো হয়! প্রথম থিম ছিল- “Improving the quality of Mental health in Services throughout the World. “ হঠাৎ করে কী এমন দরকার পড়েছিল যে আলাদাভাবে একে নিয়ে একটি দিন ঠিক করে উদযাপন বা সচেতনতা দিবস পালন করার প্রয়োজনীয়তা!?
মানসিক রোগ নিয়ে আমাদের সমাজে যে ভয়ঙ্কর রকমের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তাকে চ্যালেঞ্জ করা, আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি সমাজে উপস্থাপিত করা, সমস্ত পৃথিবীজুড়ে প্রচার ও সচেতনতা অভিযান চালানো।৷ মনে রাখতে হবে এটা কিন্তু মাত্র একটা দিনের প্রোগ্রাম নয়, বছরের পুরোটা সময় জুড়েই এর জন্যে দরকারি কর্মসূচি ও তাকে বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে!
মানসিক স্বাস্থ্য বলতে কী বোঝায়? যে স্বাচ্ছন্দ্যশীল অবস্থায় একজন লোক নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে সঠিকভাবে বুঝতে পারে,জীবনের স্বাভাবিক কোনও স্ট্রেসফুল পরিস্থিতিকে সুন্দর ভাবে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে, নিজের কাজের জায়গায় ফলপ্রসূ কাজ করতে পারে এবং সামাজিক জীব হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে! তাই খুব সহজে মানসিক স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না! মানসিক স্বাস্থ্যের ধারণা অনেক বড় একটা ব্যাপার। শুধু খুশি থাকা মানেই যেমন মানসিক স্বাস্থ্য ভালো এরম নয়, তেমনি অখুশি থাকা মানেই মানসিক রোগ নয়।
দেখা যাচ্ছে ২০১৭ সাল থেকে মানসিক রোগের পরিমাণ বেড়েছে ১৩%। ভারতে প্রতি ৭ জনে ১ জন কোনওরকম মানসিক স্বাস্থ্যহানির শিকার! ৫ % যুবক-যুবতীরা ডিপ্রেশানের শিকার। সিজোফ্রেনিয়ার রোগীরা প্রায় স্বাভাবিক বেঁচে থাকার ১০-২০ বছর আগে মারা যান! বাচ্চাদের মধ্যে প্রায় ২০% ভাগ কোনও না কোনও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। ১৫-২৯ বছরের বয়সীদের মধ্যে সুইসাইড চার নম্বর মৃত্যুর কারণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। WHO বলছে ইন্ডিয়াতে প্রতি ৩ জন সাইকিয়াট্রিস্ট প্রায় ১,০০,০০০ রোগীর জন্যে বরাদ্দ! তবুও সরকারি ভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে আর্থিক বরাদ্দ থাকে ২% এরও কম।
এইবছর তাই WHO একধারে যেমন এই প্রচার ও সচেতনতা অভিযান বিভিন্ন জায়াগায় নিয়ে পৌঁছচ্ছে- “Mental health care for all: let’s make it a reality” (সবার জন্যে মানসিক স্বাস্থ্য-এটাকে বাস্তবায়িত করা হোক) অন্যদিকে World Federation for Mental Health (WFMH)-এর পক্ষ থেকে ইংগ্রিড ড্যানিএলস (Dr. Ingrid Daniels) অন্য আর একটি থিমের ঘোষণা করেন। “Mental Health in an Unequal World: Together we can make a difference” (অসাম্যের এই পৃথিবীতে মানসিক স্বাস্থ্য…) WFMH এই প্রচার ও গঠনমূলক কাজ বিশ্বজুড়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে!
২০২১-এর থিম তাই তাই সুন্দরভাবে মানসিক স্বাস্থ্যে অন্যায্য ও অন্যায় ভাবে মানসিক রোগীদের প্রতি মানবিধাকার লঙ্ঘনের ঘটনাকে তুলে ধরে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যে আজ অসাম্যকে আজ কোনও ভাবেই আর হালকা ভাবে নিলে চলবে না। দেশ, রাজ্য, ধর্ম, বিভিন্ন কালচারে সম্প্রদায়ের মধ্যে এই অসাম্য আজ প্রকট হয়ে উঠছে! আর কোভিড মহামারি সেই সঙ্কটকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে!
তাই আজকের দিনে মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকার সবার অধিকার, একটি সার্বজনীন অধিকার। তাই সবার জন্যে প্রতিটি জায়গায় আমাদের এই পরিষেবা পৌঁছে দিতে হবে, সমাজের প্রতিটি স্তরে স্তরে মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক রোগ নিয়ে সচেতনতা পৌঁছে দেওয়া!
সম্প্রতি ২০২১ এর মে মাসে WHO থেকে একটি প্ল্যান ও প্রোগ্রাম গ্রহণ করা হয়! মানসিক স্বাস্থ্যের গুণগত পরিষেবা সমস্ত পৃথিবীজুড়ে ২০১৩-২০৩০ অ্যাকশান প্ল্যান গ্রহণ করা হয়েছে।২০৩০ এর মধ্যে প্রতিটি জায়গায় আরও বেশি করে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিষেবা শক্তিশালী করা, সরকারকে আরও দায়িত্ব নেওয়া, সহজ পদ্ধতিতে লোকজনের কাছে পৌঁছে যাওয়া!
গত কয়েক বছর এই মহামারি ও অন্যান্য সামাজিক বদলের কারণে যাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁরা মূলত ছয় ধরণের, যাদর কারণে এই অসাম্য (Unequal) শব্দটি নিয়ে আসতে হয়েছে! ওয়ার্কাররা, রিফিউজিরা (যার সংখ্যা প্রায় ৪-১১ কোটির কাছাকাছি), সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষেরা, ঘরবাড়ি হারা অংশের মানুষেরা (প্রায় ১৮ লাখ লোক আজ বিভিন্ন কারণে ঘরছাড়া), যাদের কোনও রকমের মানসিক ও শারীরিক রোগের কারণে অক্ষমতা তৈরি হয়েছে,(Persons With disability ) প্রান্তিক যৌনতার মানুষ(LGBTQ)-দের হেলথ কেয়ার সার্ভিস পেতে সবচেয়ে অসুবিধা হয়েছে। বেড়ে উঠেছে মানুষের মধ্যেই ‘পাওয়া’ আর ‘না পাওয়ার’ ব্যবধান। তৈরি হয়েছে অসাম্য।
তাই এই বছর থেকে আরও জোরদার করে তুলতে হবে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি-
এক, মানসিক চিকিৎসার পরিকাঠামো বাড়ানো।
দুই, মানসিক রোগীদের প্রতি সাম্য ও বৈষম্যহীন আচরণ
তিন, মানসিক রোগীদের মানবাধিকার রক্ষার জন্যে আইনি ব্যবস্থা।
বার বার উঠে আসছে Mental health Care Act,2017-এর কথা, যেখানে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে মানসিক রোগীদের অধিকারের কথা, তাঁদের কোনও ভাবেই আলাদা করা যাবে না, সমস্ত রকমের সুযোগ সুবিধা তাঁরা পাবেন!
সেকশান ১৮-তে মানসিক স্বাস্থ্য পাওয়ার কথা অর্থাৎ ওপিডি ইনডোর সার্ভিস, সমস্ত রকমের পরিষেবা, সঠিক ওষুধের বন্দোবস্ত, যাতায়াতের পরিষেবা। এক্ষেত্রে মনে রাখতে 5A এর কথা সচেতনতা (Awareness), ক্রয়ক্ষমতা (Affordable), গ্রহণযোগ্যতা (Acceptable), পর্যাপ্ত (Adequate) এবং যথাযথ (Appropriate)।
সেকশান ২১-এ বলছে সমতা ও বৈষম্যহীন দৃষ্টিভঙ্গির কথা। এই সেকশানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলে দেওয়া হয়েছে যা এই অসমানতার দুনিয়াতে আমাদের শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক অসুস্থতার গুরুত্ব সমান এবং অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস সমান রকম গুরুত্বপূর্ণ, এমারজেন্সি সার্ভিসেও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। প্রত্যেক কোম্পানি মেডিকাল ইন্সোরেন্সের ক্ষেত্রেও মানসিক রোগ অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে ।
২০২১-এর মানসিক স্বাস্থ্য দিবস তাই দাবি করে সমস্ত রকমের স্টিগমা দূরে সরিয়ে একসঙ্গে সব জায়গায় মানসিক রোগীদের অধিকারের জন্যে কথা বলা, সমস্ত অন্যায় ও অসাম্যের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিষেবা সার্বজনীন করে তুলতে হবে! শুধুমাত্র একটা দিন বা একটা সপ্তাহের কর্মসূচি এটা নয়, সবার জন্যে সমস্ত জায়গায় সব সময় আমাদের এই স্বাস্থ্যকর্মসূচি চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে! মানসিক রোগীদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের নিজেদের যন্ত্রণাকে যতটুকু শেয়ার করতে পারে তার সুযোগ করে দিতে হবে, আজ কেউ একা নয় এই ভরসা দিতে হবে ছোট-বড়, ধনি-গরিব সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে! কোভিড মহামারির জন্যে যে অসাম্যের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে তার ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। সঠিক আইনের প্রয়োগ, কোনওরকম বঞ্চনার শিকার না হওয়া, পর্যাপ্ত পরিষেবা পাওয়া প্রতিটি মানুষের জন্যে। কোনও একজন ডাক্তার বা নার্স সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোলজিস্ট কারও একার পক্ষেই এই কাজ করা সম্ভব নয়, যদি না আজ প্রত্যেকে এই সচেতন প্রয়াসের দায়িত্ব নিই! তাহলেই হয়তো এই অসাম্যের পৃথিবীতে মানসিক স্বাস্থ্য সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে! সমস্ত পৃথিবী জুড়ে এই ধারাবাহিক, ঐক্যবদ্ধ, গঠনমূলক কাজের জন্যে আমাদের নিজেদেরই দায়বদ্ধ হতে হবে। কারণ মনে রাখতে হবে একটি সুস্থ সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য ছাড়া, কোনও স্বাস্থ্যই সম্পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারে না!
খুব ভাল লাগল।