ভয়ঙ্কর ২০২০-তে ভয়ের সহবাস যখন প্রায় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠাহর করলাম হঠাৎ নাক থেকে চেনা গন্ধগুলো উধাও। এতদিনে প্যানডেমিক আর ইনফোডেমিকের যুগলবন্দীতে সবাই জেনে গেছে গন্ধবিচার বন্ধ হলে করোনা এল চলে। পেশায় ডাক্তার হওয়ায় এই লক্ষণ আসার সঙ্গে সঙ্গে আর দেরি না করে সেদিনই করে ফেললাম টেষ্ট, এবং ফলাফল যথারীতি পজেটিভ।
তার আগে সকাল থেকেই শুরু হয়ে গেছে এক নতুন জীবন.. নিভৃতবাস, ডাক্তারি পরিভাষায় ‘হোম আইসোলেশন’। সৌভাগ্যক্রমে পৈত্রিক বাড়িটি কলেবরে একটু বড় হওয়ায় একটি আলাদা ঘর এবং বাথরুমের সুবিধা আমার ছিল যেটা কিন্তু মাপা ও চাপা ‘জিরো ফিগার’ আধুনিক ফ্ল্যাট নিবাসীদের পক্ষে বেশ দুর্লভ। যাই হোক, বন্ধু ডাক্তারদের পরামর্শ এবং সাহস যোগানো চলতে থাকলো দূরভাষে । শুরু হলো এক বিভীষিকাময় জীবন।
যদিও শরীর তেমন বেগড়বাই করে নি, কিন্তু ডাক্তার হবার চিরকালীন অভিশাপে মাথার মধ্যে চলতে থাকলো নানা ‘জানা’, ‘আধজানা’ আর ‘না জানা’ তথ্যের অভিঘাত, যা আকার নিতে থাকলো এক ভয়ঙ্কর মানসিক চাপের, আর তার সঙ্গে যোগ হল পরিবারের অন্যদেরকে চাপে না ফেলার জন্য যতদূর স্বাভাবিক থাকা যায় তার চেষ্টা।
সহধর্মিণী পেশাগত সহকর্মী হওয়ার সুবিধা অসুবিধা দুই-ই আমার আজীবন সঙ্গী। যাই হোক এইভাবে কাটতে থাকলো নিভৃতবাসের দিনগুলো। একই সঙ্গে বন্দি জীবন, আর অস্পৃশ্য হবার এক বিরল অভিজ্ঞতা। দরজার বাইরে এক চারপাই-এর ওপর থালা রেখে অপেক্ষা, বৌ-এর “দেওয়া হয়ে গেছে” কথাটা শুনলে দরজা ফাঁক করে খাবার নিয়ে নেওয়া নিজেরই কেমন অবাক লাগছিল। তারমধ্যে আবার রক্ত পরীক্ষা আর একটা সিটি স্ক্যান করানোর ফরমান এল বন্ধুদের কাছ থেকে, তৃতীয়দিন একা মুখ ঢেকে গাড়ি চালিয়ে সোজা গিয়ে থামলাম আমার কর্মক্ষেত্র ফোর্টিস হাসপাতাল এর ফ্লু ক্লিনিক-এর সামনে, হাতের ইশারায় সিকিউরিটি স্টাফদের দূরে যেতে বললাম, তার পর নেবে সোজা ভেতরে, আগে থেকে বলা থাকায় সব পরীক্ষা হয়ে গেল, রিপোর্টও আশানুরূপ, একই ভাবে সোজা বাড়ি।
এইভাবে দুর্বিষহ ছয়দিন কাটানোর পর আরেক যুদ্ধ, বাড়ির সকলের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হল, কারণ সেটাই নিয়ম যার পোষাকি নাম কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং। সারাদিন দুরু দুরু বুকে অপেক্ষার পর খবর এলো আমার বৃদ্ধ এবং অশক্ত মা কোভিড পজেটিভ। কিন্তু কোনো সমস্যা বা উপসর্গ নেই। এই অবস্থায় হোম আইসোলেশন বা নিভৃত বাসই যথেষ্ট। কিন্ত একজন অশক্ত বয়স্ক মানুষ যার পরিচর্যার জন্য এমনিতেই লোক লাগে তার পক্ষে একা সব করা অসম্ভব, তাই অনেক দোলাচলের পরে মাকে পরদিন সকালে ভর্তি করালাম হাসপাতালে।
আশ্চর্যের বিষয় হল উপসর্গ না থাকলেও মায়ের সিটি স্ক্যান কিন্তু দেখালো ফুসফুসে রোগের অভিঘাত বেশ স্পষ্ট, শুরু হয়ে গেল চিকিৎসা। আমার বন্দী দশায় চিন্তার চাপ গেল আরো বেড়ে। তখনও বাকী নিভৃত বাসের আরো দশদিন, সে এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। তবে দুঃসময় তো চিরস্থায়ী হয় না, দিন গুলো একে একে পার হল। মাও সুস্থ হলেন হাসপাতালে। আমার মুক্তির পরদিন বাড়ি নিয়ে এলাম মাকে। আবার জীবন ফিরতে থাকলো চেনা ছকে। তবে থেকে গেল এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি।
গত একবছরে অগুন্তি মানুষ এরকম, অথবা এর থেকেও খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। দুর্ভাগ্যবশত এখনও আমরা এই দুঃসময় পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। যদিও রোগীর সংখ্যা আগের থেকে কমেছে কিন্তু আমাদের এখনই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া অসম্ভব, দেশের নানা প্রান্তে চোখ রাঙাচ্ছে দ্বিতীয় ঢেউ এর সম্ভাবনা।
একজন ভুক্তভোগী রোগী এবং ডাক্তার হিসেবে সকলের কাছে আমার বিনীত আবেদন, দয়া করে পরিস্থিতিকে একদম অবহেলা করবেন না।
- মাস্ক, সঠিক পদ্ধতিতে হাত ধোওয়া এবং যথাসম্ভব শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম অতি অবশ্যই মেনে চলুন। নিজে করোনা থেকে বাঁচুন, অন্যকেও বাঁচতে সাহায্য করুন।
- যদি দুর্ভাগ্যবশত বহুল আলোচিত রোগের লক্ষণগুলি দেখা দেয়, অতি দ্রুত পরীক্ষা করান দয়া করে দেরি করবেন না। এই অসুখে সময়মত চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি।
- ইতিমধ্যে এই রোগের প্রতিষেধক আমাদের হাতে এসে গেছে, এবং আমাদের দেশেই আড়াই কোটির ওপর মানুষ তা পেয়েও গেছেন। তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সমস্যার কথাও শোনা যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত ভাবে আমি এবং আমার চিকিৎসক সহধর্মিণী দুজনেই দুটি করে ডোজ নিয়েছি। আমার সত্তরোর্ধ মা-ও একটি ডোজ পেয়ে গেছেন কোন সমস্যা ছাড়াই। আপনাদের কাছে আমার বিনীত আবেদন, সুযোগ পেলেই প্রতিষেধক নিয়ে নিন। কোনো গুজবে দয়া করে কান দেবেন না। টিকা নিয়ে অমুলক ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।
করোনা-র বিরুদ্ধে যুদ্ধ আমাদের জিততেই হবে।