টিকা আমরা সবাই নিয়েছি। কেউ একবার, কেউ বহুবার। টিকা বা ভ্যাকসিন কি জিনিস এখন আর কাউকে বলে দিতে হয় না। অবশ্য টিকার বিরুদ্ধে বলবার মত লোকও কম নেই। আমি যেহেতু নিজেকে কোন বিপ্লবী বা বিশেষজ্ঞ মনে করি না তাই সাধারণ মানুষের মত, সাধারণ বুদ্ধিতে যা বুঝেছি তাই বলি। সেই মারাত্মক গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার আর তাই দিয়ে পৃথিবীর এক আতঙ্ককে চিরতরে হারিয়ে দেওয়া দিয়ে যে সাফল্যের শুরু; আজও চলেছে সেই বিজ্ঞানের জয় যাত্রা।
আমাদের বাড়ীর পাশেই ছিল স্বাস্থ্য কেন্দ্র। আমি জ্ঞান হওয়া থেকে জানতাম একজন টিকাদাদু বলে বয়স্ক মানুষ আছেন ঐ হাসপতালে। কোয়ার্টারে থাকতেন। ওনার মেয়ে আমার মেজদির সাথে স্কুলে পড়ত। টিকাদাদুর নাম কি ছিল আমার জানা হয়নি। আমরা গ্রামের ছেলেরা শুধু টিকা নয় , যে কোন ইনজেকশনকেই খুব ভয় পেতাম। এমনকি বাড়িতে টিকাদাদু আসছে জানলে দৌড়ে মাঠের দিকে পালাতাম। আমাদের জ্ঞান হওয়ার আগেই নিশ্চয়ই কয়েকটা টিকা আমাদের দেওয়া হয়েছে, পরে টিকার দাগ দেখে জানতে পেরেছি। সবথেকে কম বয়সে নেওয়া যে টিকার কথা আমার মনে আছে সেটা সুঁচ ফুটিয়ে দেওয়া হত না। একটা ছোট কাঁচের শিশি থেকে একটা ঘোলা ওষুধ হাতের কব্জির একটু ওপরের চামড়ায় আগে লাগিয়ে দেওয়া হত। তারপর একটা গোল ধারালো জিনিস ঐ ওষুধ লাগানো চামড়ার ওপর চেপে ধরে একটা মোচড় দিয়ে চামড়ায় দাগ কাটা হত। কদিন পর ঐ জায়গায় একটু ঘা মত হত। ঘা শুকানোর পর অনেকদিন পর্যন্ত ঐ জায়গায় একটা দাগ থেকে যেত।
পরে আর একরকম টিকা দেওয়ার যন্ত্র এল। দুই মুখওলা কাঁটার মত একটা সুঁচ; ঐ দিয়ে ওষুধ লাগানো চামড়ার ওপর কয়েকটা আঁচড় কেটে দেওয়া হত। টিকা দাদু ছাড়াও পরে মিত্রা মাসিকেও এরকম টিকা দিতে দেখেছি।
ইনজেকশন দিয়ে টিকা প্রথম এল কলেরার জন্য। সে সময় আমাদের গ্রামের ওদিকে প্রায় প্রতি বছর বন্যা হত। বন্যা হলেই খাওয়ার জল দূষিত হয়ে কলেরা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, তাই সকলকে কলেরার ভ্যাকসিন দেওয়া হতো। আর এই ইঞ্জেকশন ব্যাপারটাতে ছিল আমাদের ভয়। শুধু আমাদের নয়, এই ভয়টা যে আপামর জনসাধারণ সকলের ছিল সেটা দেখা যায়, সমরেশ বসু মহাশয় -এর অমৃত কুম্ভের সন্ধানেতে। কুম্ভ মেলায় ঢোকার আগে সকলকে কলেরার টিকা নিতেই হবে; আর তাই নিয়ে কান্নাকাটির ধুম।
টিকার থেকেও অনেক জরুরী হল বিশুদ্ধ পানঈয় জল। এই সার কথাটি যখন কর্তৃপক্ষের মাথায় ঢুকল তখন থেকেই কলেরা কমে গেল, টিকাও প্রায় উঠে গেল। যাঁরা টিকার বিরুদ্ধে বলেন, তাঁরা এই ব্যাপারটিকে তুলে ধরেন। তাঁদের যুক্তি হল জীবনযাত্রার উন্নতি হলেই আর টিকার দরকার হবে না।
বছর তিরিশ আগে আমাদের বাচ্চাদের জন্মের সময় থেকেই কয়েকটা টিকা অবশ্যই নিতে হবে জানলাম। প্রথমেই টিবি রোগ আটকানোর জন্য বিসিজি টিকা। আমরা ডাক্তারী পড়ার সময়ই এই বি সি জি টিকার বিচিত্র সুন্দর নামটা জেনেছি।পুরো কথাটা হল ব্যাসিলাস কালমেটি গুয়েরিন। বিজ্ঞানীর নামে এক রকম জীবাণু। এই জীবাণু অনেকটা টি বি রোগের জীবাণুর মত। এই জীবাণ্য এমনভাবে গবেষণাগারে তৈরী করা হয় যে, এরা টি বি রোগ ঘটায় না। কিন্তু এরা শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী করে।
এবারকার করোনা ভাইরাসের অতিমারীর সময় ইউরোপ আমেরিকার মৃত্যুহার আমাদের মত অনুন্নত দেশের তুলনায় অনেক বেশী। কেউ কেউ মনে করেছেন এর সাথে আমাদের দেশে ব্যাপক বি সি জি টিকা দেওয়ার সম্পর্ক আছে।
ঐ বছর তিরিশ বা তার আগে থেকেই জাতীয় টিকাকরণ কর্মসূচী চলছে। ট্রিপল আন্টিজেন বা ডি টি পি টিকা একসাথে তিনটি রোগ প্রতিরোধের টিকা। ডিপথেরিয়া, পার্টুসিশ বা হুপিং কাশি আর টিটেনাস।
এই ডি টি পি ইঞ্জেকশন নিয়ে আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার ছেলের প্রথম বা দ্বিতীয়বার এই টিকা নেওয়ার পর ধুম জ্বর আসে। আমি ঐ দিন কোন কাজে একটু দূরে গেছলাম, ফেরার সময় কালবৈশাখী ঝড়ের জন্য ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাসায় ফিরে দেখি ছেলের খুব জ্বর, সাথে গোটা শহরে লোডশেডিং। ছেলেকে নিয়ে আমরা খুব বিব্রত ছিলাম। রাতে ঐ অবস্থার মধ্যে একদল লোক একজন বয়স্ক মানুষকে নিয়ে আসে, একজন খুব বিখ্যাত সার্জেন পাঠিয়েছেন বলে। আমরা টর্চের আলোয় ওনার চোখের পাতার জখমের সেলাই করি। লোকগুলি এতই অভদ্র ছিল যে যাওয়ার সময় আমাকে ফি দেওয়ার কথা জিজ্ঞেসও করেন নি। অন্য একজন ডাক্তারবাবু পাঠিয়েছেন বলে ডাক্তারের ফি দিতে হবে না , এমন আবদার কেউ কোনদিন শুনেছেন ? এখন রাত্রে কেন ডাক্তাররা দরজা খোলে না নিশ্চয়ই বুঝছেন ।
ছেলে মেয়ের ছোট বেলায় জাতীয় কর্মসূচী মত সবকটা টিকা দেওয় হল। এর মধ্যে আমি উত্তর বঙ্গের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাকরী করতে গেলাম। কয়েক মাসের মধ্যে শুনলাম, পালস পোলিও টিকা বলে নতুন কর্মসূচী। গত পঁচিশ বছর ধরে এটা চলছে; এখন সবাই জানে ব্যাপারটা কি। কিন্তু প্রথম বার শুরু করতে গিয়ে আমরা লেজে গোবরে হয়েছিলাম।
আমি তো নতুন চাকরী করতে গেলাম; বাঘা বাঘা লোক হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিলেন। সেই এক একটা দিন নিয়ে একটা বই লেখা যায়। আমার এলাকায় একশ দশটি টিকা কেন্দ্র খুলতে হল। নির্দিষ্ট দিনের মাস দেড়েক আগে থেকে নানান রকম মিটিং প্রচার চলতেই থাকলো। আমরা গ্রামে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে প্রচার করতে থাকলাম, ঐ নির্দিষ্ট দিনে যেন বাচ্চাদের নিয়ে টিকা কেন্দ্রে মায়েরা আসেন।
ওদিকে একদল লোক অপপ্রচার চালাচ্ছে। এভাবে আমার কাজের সময়ের ভেতর তিন -চারবার ঐ পোলিও টিকা খাওয়ানোর অভিযানে থেকেছি। এই অভিযানগুলির জন্যই আজ দেশ পোলিও মুক্ত হয়েছে।
এখানে একটা কথা বলে রাখি। পোলিও টিকাও কিন্তু প্রথমে ইঞ্জেকশন হিসেবেই এসেছিল।
জাতীয় কর্মসূচির বাইরেও বেশ কয়েকটি রোগের টিকা আমরা বাজার থেকে কিনে ছেলে মেয়েকে দিয়েছি। সেই সব টিকার কয়েকটি এখন জাতীয় কর্মসূচিতে এসেছে। এম এম আর অর্থাৎ মাম্স, মিজেলস আর রুবেলার টিকা আমাদের কিনতে হয়েছিল। এছাড়া জল বসন্ত আর হেপাটাইটিস -বি -এর টিকাও আমরা কিনেছি।
এই হেপাটাইটিস বি এক রকম মারাত্মক জন্ডিস ঘটায়। এর টিকা আমিও নিয়েছি, বোধ হয় চল্লিশ বছর বয়সে। পরে আর একটি টিকা এসেছে, এটি অবিবাহিতা মেয়েদের জন্য ; এইচ পি ভি টিকা তেমন প্রচলিত হয়নি।
আফ্রিকার দেশগুলিতে বেড়াতে যেতে হলেও ইয়োলো ফিফার নামে একটি অসুখের টিকা নেওয়া বাধ্যতামুলক।
আমাদের দেশে সবথেকে প্রচলিত টিকা হল টিটেনাসের টিকা বা ভ্যাকসিন। একটু কেটে ছড়ে গেলেই সবাই হাসপাতালে এসে প্রথমেই বলে, একটা টিটেনাস দিয়ে দিন তো। কোথায় কেটেছে, কতোটা কেটেছে, সেলাই লাগবে কি না , অন্যকোন ওষুধ লাগবে কি না এসব নিয়ে কোন চিন্তা ভাবনা নেই । আমি দেখেছি, পরের প্রশ্নগুলি করতে গেলে, সাধারণ লোকজন প্রচন্ড বিরক্ত হয়।
কুকুরে কামড়ালে জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া হয়। লোকজন এসে বলে টিটেনাসটা দিয়ে দিন, জলাতঙ্কেরটা পরে ভাবব। টিটেনাসের ভ্যাকসিন টিটেনাস থেকে বাঁচাবে, ওতে জলাতঙ্ক আটকাবে না, এটা কে শুনছে! এই জলাতঙ্কের টিকা নিয়ে এখনও প্রচুর ভুল ধারণা আছে। কেউ বলে রক্ত তো বেরয়নি, কেন টিকা নেব? কেউ বলে পোষা কুকুর কামড়েছে, কেন টিকা নেব? কেউ বলে আমার কুকুরকে টিকা দেওয়া আছে, কেন আমার টিকা লাগবে? এই একটি ব্যাপারে আমরা বলি, কোন ভাসাভাসা ধারণা নিয়ে টিকা নিতে একদিন দেরীও করা চলবে না। জলাতঙ্ক একবার হলে একশ শতাংশ মৃত্যু। আগে এই টিকা নাভির পাশে চোদ্দটা নিতে হত। এখন কাঁধের পাশে ছোট ছোট চারটি নিলেই হয়।
সব শেষ যে টিকা নিয়ে গোটা পৃথিবী তোলপাড় সেটা হল করোনার টিকা। এতো সবাই জানে , করোনা অতিমারী শুরুর সাথে সাথেই গোটা দশেক দেশে টিকা তৈরীর জন্য বিজ্ঞানীরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। ইংল্যান্ডে প্রথম যে টিকা দেওয়া হয় সেটি অসুখটি জানার এক বছরের কম সময়ে বাজারে এসে যায়। আমাদের দেশেও তার পরপরই দুটি টিকা কোটি কোটি লোককে দেওয়ার জন্য তৈরী হয়ে যায়। আমরা যারা সরাসরি করোনা রুগীর চিকিৎসার সাথে যুক্ত তাদের সরকার থেকে বিনামূল্যে এই টিকার দুটি করে ইঞ্জেকসনের ব্যবস্থা হয়েছে।
আগের দিনে যে কোন রোগের টিকা আবিষ্কার করতে দশ- পনের এমনকি কুড়ি বছরও লেগেছে। স্বাভাবিক ভাবেই এত দ্রুত করোনার টিকা বাজারে এসে যাওয়ায় মানুষের মনে সন্দেহ দেখা নিয়েছে। এটা শুধুই ওষুধ ব্যবসার কায়দা কিনা এমন প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে টিকার কার্যকারিতা আর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে সন্দিহান হয়ে টিকা নিতে চাননি। আমি নিজে দুবার এই টিকা নিয়েছি , কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়নি। কার্যকারিতা কতোটা সে তো সময়ই বলবে।
এখন পর্যন্ত শুধু স্বাস্থ্যকর্মি পুলিশ ইত্যাদি নির্দিষ্ট কিছু ঝুঁকিপূর্ণ পেশার লোকেদেরই করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে। গোটা দেশের সকল না হলেও তিন ভাগ লোককে টিকা দিতে হলেও একশ কোটি লোক হচ্ছে; সংখ্যাটা কিন্তু বিশাল।
এবার এই এত তাড়াতাড়ি টিকা বাজারে আসা নিয়ে আমার যা মনে হয়েছে বলি। বাজার ধরা বা ব্যবসা তো আছেই। এখন গোটা পৃথিবীতেই সবকিছু নিয়েই ব্যবসা চলছে, তাই টিকা নিয়ে ব্যবসা হবে না এটা ভাবা বোকামী। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কি করে তৈরী হল, এটা আমার কখনো মনে হয়নি। প্রযুক্তির কি বিশাল উন্নতি হয়েছে আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
আমরা যখন প্রথম চোখের ছানি অপারেশন করতাম তখন রুগীর দু চোখ বেঁধে সাতদিন চিৎ করে শুইয়ে রাখা হত। আজকাল সেই অপারেশন করে আধঘন্টা পর লোকে বাড়ী চলে যাচ্ছে। বেঙ্গালুরু থেকে হার্ট এনে কোলকাতার রুগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এসব উন্নতি কি আমরা ভুলে যাচ্ছি, শুধুই তর্ক করার জন্য? তর্ক ভালো, কিন্তু তা ঠিক ততোক্ষণই ভালো যতক্ষণ তা সমাজের ক্ষতি না করছে।