ক্রসপ্যাথি নিয়ে ভয়ানক হইচই চলছে। এতদিন হাতুড়ে, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা অনেকেই মর্ডান মেডিসিনের ওষুধ লিখতেন, ছোটো খাটো অপারেশন করতেন। তবে রেখে ঢেকে, লুকিয়ে চুরিয়ে। ভারত সরকার তাঁদের কষ্ট লাঘব করেছে। আইন করে অন্য ধারার চিকিৎসকদের বেশ কিছু অপারেশন করার ও কিছু মর্ডান মেডিসিন লেখার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
ক্রসপ্যাথি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি না অবনতি করবে, তাই নিয়ে আলোচনা চলছে। চলুক। আমি গল্পওয়ালা। যুক্তি ও তথ্য নির্ভর প্রবন্ধ লেখার ক্ষমতা নেই। আমি বরঞ্চ একটা গল্প শোনাই। আমিও একবার ক্রসপ্যাথি করেছিলাম। যদিও ফলাফল ভালো হয়নি।
বছর দশেক আগের কথা। ছিলাম মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম হাসপাতালে। দিব্যি মজাতেই ছিলাম। কোয়ার্টারে থাকতাম। ডিউটি করতাম আর বাকি সময় আড্ডা মারতাম। পীযূষদা, চিরঞ্জীবদা, পারমিতাদির মতো সহকর্মী পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার।
প্রত্যেক চিকিৎসক আউটডোরের পরে সপ্তাহে একদিন বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতে ক্যাম্প করতে যেতাম। আমার ভাগে ছিল বালিয়া।
বালিয়া হলো কান্দির কাছাকাছি একটি গ্রাম। যাওয়ার রাস্তাটা বিচিত্র। মূল রাস্তা দিয়ে গেলে কান্দি ঘুরে যেতে হয়। আর শর্টকাট করলে রাস্তা অর্ধেকের কমে নেমে আসে। তবে শর্টকাটটা আদৌও কোনো রাস্তা নয়। দ্বারকা নদীর বাঁধ দিয়ে যেতে হয়। বর্ষাকাল ছাড়া বাদ বাকি সময় হেঁটে যাওয়া যায়। এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় গাড়ি চালানো অসম্ভব। তবে প্রফুল্লদা আর তাঁর জিপের পক্ষে সবই সম্ভব।
আমাদের হাসপাতালে দুটো গাড়ি ছিল। একটা এম্বেসাডর, আর একটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক জিপ।
এম্বেসাডর যিনি চালাতেন তাঁকে আমরা জামাইবাবু বলে ডাকতাম। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ছিলেন। রাস্তা বেড়ালে কাটলে স্টার্ট বন্ধ করে চুপচাপ অপেক্ষা করতেন। আরেকটা গাড়ি গেলে তবে এগোতেন। পুরো ঘটনাটাই অত্যন্ত বিরক্তিকর। গ্রামের রাস্তায় দ্বিতীয় গাড়ি কখন আসবে কোনো ঠিক নেই। রাস্তায় কোনো গর্ত দেখলে গাড়ি থামিয়ে আগে গর্তের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতা মাপতেন৷ অনেক হিসেব নিকেশ করে তবে গর্ত পেরোতেন।
একবার জামাইবাবুর এম্বেসাডরে বহরমপুর সি এম ও এইচ অফিসে একটি মিটিংএ গেছিলাম। যখন পৌঁছালাম মিটিং শেষ। যে যার হাসপাতালে ফেরার জন্য গাড়িতে উঠছেন। আমিও গঙ্গার ধারে কিছুক্ষণ হাওয়া খেয়ে ফিরে এলাম।
প্রফুল্লদা ঠিক তার উল্টো। খানাখন্দ দেখলে কাটানোর চেষ্টাই করেন না। একটু জায়গা পেলেই গাড়ি ঢুকিয়ে দেন। প্রাগৈতিহাসিক জিপের গদি জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। লোহার স্প্রিং বেরিয়ে আছে। ঘন্টা খানেক গ্রামের রাস্তায় ঐ জিপে চড়লে তারপর হাঁটা চলাই মুশকিল হয়ে যেতো।
যাইহোক গাড়ির গল্প ছেড়ে ক্রসপ্যাথির গল্পে ফিরি। আমি প্রফুল্লদার জিপেই প্রতি শুক্রবার হাসপাতালের আউটডোরের পর বালিয়া যেতাম। এবং শর্টকাট রাস্তা দিয়েই যেতাম।
এক শুক্রবার আউটডোরের পর স্নান খাওয়া সেরে জিপে উঠেছি, প্রফুল্লদা বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি যা ওষুধের লিস্ট দিয়েছিলেন, মঙ্গলদা দিয়ে দিয়েছে। তবে এমলোডিপিন নেই। ওর বদলে বেশি করে প্যারাসিটামল দিয়েছে।’
এমলোডিপিন হলো প্রেশারের ওষুধ। তার বদলে প্যারাসিটামল নিয়ে কি করব একমাত্র মঙ্গলদাই বলতে পারেন।
দোল খেতে খেতে বালিয়া চললাম। বাঁধের জায়গাটুকু হেঁটে পার হতাম। প্রফুল্লদার জিপে চড়ে পার হওয়ার সাহস হতো না।
বালিয়া পঞ্চায়েতে পৌঁছে দেখলাম গরু, ছাগলের বিশাল লাইন পরে গেছে। দেখে ঘাবড়ালাম না। এনারা আমার জন্য আসেননি। আমার পাশের ঘরেই একজন ভেটেনারি ডাক্তার বসেন। এনারা তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছেন।
পশু চিকিৎসকের পাশের ঘরে রোগী দেখা বেশ মুশকিল। মাঝে মাঝে ঘরে বাছুর, রামছাগল ঢুকে যায়। আমি আঙ্গুল তুলে চেঁচাই, ‘এই ঘরে না, এই ঘরে না, পাশের ঘরে।’
ফেরার সময় হয় আরেক বিপদ। পঞ্চায়েত অফিসের সামনেটা গোবর, ছাগলের নাদি, মুরগির বিষ্ঠাতে ভরে যায়। সাবধানে পা ফেলতে হয়।
ক্যাম্পের সময় সেকেন্ড এএনএম ডালিয়াদি আমাকে সাহায্য করেন। লাইন ঠিক রাখেন। ওষুধ কেটে দেন। কিছুক্ষণ বাদে বাদে বাইরে গিয়ে গরুর মালিকদের সাথে ঝগড়া করে আসেন। সেদিন ডালিয়াদি ফিসফিস করে বললেন, ‘ডাক্তার ভৌমিক, তাড়াতাড়ি রোগী শেষ করে পালান। ভেটেনারি ডাক্তার বাবু এখনো আসেননি। ওনাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। গরু, ছাগলের মালিকদের মধ্যে অসন্তোষ জমছে।’
ঝড়ের বেগে রোগী দেখা শেষ করলাম। প্রফুল্লদাকে বললাম, ‘ওষুধের বাক্স এক্ষুনি গাড়িতে তুলুন।’
ঘর থেকে বের হতেই কোলাহল শুরু হলো, ‘ডাক্তার পালায় যাচ্ছে রে…. ডাক্তার পালায় যাচ্ছে।’
একজন মুরুব্বি গোছের লোক এগিয়ে এসে বললেন, ‘ছার, এতোগুলান পেশেন্ট রেখে চলি যাচ্ছেন? এটা কি ন্যায্য কাজ হইছে?’
বললাম, ‘আমি মানুষের ডাক্তার। পশুদের কিছু বুঝিনা।’
‘দ্যাহেন, মানুষের বুঝলেই হবে। পশুগুলানরে মানুষ মনে করে ওষুধ দেবেন। নইলে এই অবলা জন্তুগুলারে নিয়ে কনে যাব?’
ইতিমধ্যেই প্রফুল্লদার হাত থেকে ওষুধের বাক্স ছিনতাই হয়ে গেছে। ডালিয়াদিকেও কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। বাধ্য হয়েই চেয়ারে বসলাম।
প্রথম রোগীই এক বড়সড় চেহারার গরু। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?’
রোগীর বদলে তার মালিক বলল, ‘আজ্ঞে, খাওয়া দাওয়া কমায় দিছে। স্ফূর্তি নাই। গলার আওয়াজ খানও কেমন ভাঙা ভাঙা। একটু কল লাগায়ে দেখেন কেনে?’
কোথায় কল লাগাবো? ওই বিশাল বপুর পয়স্বিনী আমাকে কল লাগাতে এলাউ করবে? যেভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে!! তাড়াতাড়ি মানুষের ডবল ডোজে ওষুধ দিয়ে বিদায় করলাম।
পেট খারাপের ছাগল দেখলাম। পালক ওঠা হাঁস দেখলাম। একটি ঠ্যাং ভাঙা কুকুরের পা কার্ড বোর্ডের সাহায্যে ইমমোবালাইজ করলাম। প্রফুল্লদা কুকুরটাকে চেপে ধরে ছিলেন আর বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘ডাক্তার বাবু, হাসপাতালে কুকুরে কামড়ানোর ভ্যাক্সিন আছে তো?’
আমি জানি ভ্যাক্সিন সাপ্লাই নেই। কিন্তু প্রফুল্লদার মনোবল ভাঙতে চাইছিলাম না। মোট ছেচল্লিশ জন না-মানুষ রোগী দেখলাম।
পরের সপ্তাহে আবার বালিয়া যাচ্ছি। বাঁধ হেঁটে পেরোচ্ছি। দুপাশেই সবুজ ধানক্ষেত। আমি আবেগ টাবেগ দিয়ে নাক মুখ কুঁচকে গান গাইছি, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি.. ‘ হঠাৎ পেছন থেকে একটা জোরদার ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লাম। মাথা তুলে দেখলাম একটি গরু ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। নেহাৎ শিং নেই বলে এই যাত্রা বেঁচে গেছি।
কি সর্বনাশ… ও যে আবার তেড়ে আসছে!!
হ্যাঁচড় প্যাঁচড় করে বাঁধ থেকে নেমে ধানক্ষেতে ঢুকলাম। চিৎকার করছি… ‘প্রফুল্লদ, প্রফুল্লদা….’
প্রফুল্লদা জিপ থামিয়েছেন। হাতে একটা ভাঙা ডাল নিয়ে এগিয়ে আসছেন, ‘হ্যাট হ্যাট, যা যা… ডাক্তার বাবু আগের দিনই তোদের চিকিৎসা করলো, একটু কৃতজ্ঞতা বোধও নেই গো!!’
কি চিকিৎসা করেছিলাম সে তো আমিই জানি। তাই ভরসা পেলাম না। একটা শক্তপোক্ত ডাল খুঁজতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম। এবার রোগী যদি চিকিৎসক নিগ্রহ করতে আসে, আমিও ছাড়বো না।
আমার ধারণা ছিলো একমাত্র আমরাই অর্থাৎ মর্ডান মেডিসিনের চিকিৎসকরা রোগী ও রোগীর আত্মীয়দের হাতে নিগৃহীত হই। ধারণাটি ভুল ছিল। ভেটেনারি ডাক্তাররাও রোগীর হাতে নিগৃহীত হন!!
সেই দিনের ঘটনার পর থেকে আমি ক্রসপ্যাথির ঘোরতর বিরোধী। আমার মনে হয় যিনি যে ধারার চিকিৎসক, সেটুকুতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ।