সে বার বাড়ির নিচের বাসিন্দা ভুলু’র মন খারাপ। কি জানি কেন। সারাদিন ধরে পড়ে ছিল ঘরের সামনে। খাবার দিচ্ছি, মুখেও তুলছে না! কয়েকদিন আগেই পাঁচটা বাচ্চা দিয়েছিল। শরীর তেমন ভালো না। ডাকলেই কেমন একটা করুণ সুরে শব্দ করছে। তারপর দুই পা সামনে ছড়িয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে শুয়ে থাকছে।
ভুলু’র দৌলতেই শিখেছি – কিভাবে মন খারাপের সময় শুয়ে থাকতে হয়।
আমাদের ব্যস্ততম জীবনের ফাঁকে রাতের বেলা ছাড়া সময় পাই না ওদের খবর নেয়ার। সেদিনও রাতে হঠাৎ খেয়াল করলাম – ভুলু র বাচ্চা গুলোর সবকটাকে দেখছি না! কি হতে পারে?? এইজন্যই কি মন খারাপ?
সিঁড়ি ঘরের নিচে খুঁজলাম। না, নেই! তাহলে কি কিডন্যাপাররা তুলে নিয়ে গেল?? আগের বারের পাঁচটি সন্তান কেই কিডন্যাপ করেছিল কয়েকটি দোপেয়ে মিলে। এবারেও কি তবে ….
মাথা গরম হয়ে গেল। ভুলু কে ডাকলাম। আমি খুঁজছি আর ভুলু একটা করুণ সুরে শব্দ করতে করতে আমার পাশে পাশে ঘুরছে। বুঝতে পারছি না – কেলোটা কি হলো!! এমন অসহায় ভুলু , বাংলা বলতে বোঝে আয় আয়, নে খা, যা ঘুমো, চুপ করে থাক! আর বোঝে চুপ করে আদর খাওয়া। সামনের ঘরের দাদাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম – তিনটে বাচ্চা ই মারা গেছে বমি করতে করতে। দাদা ই কবর দিয়েছেন। বাকি দু’টোর অবস্থাও সঙ্গীন। শরীর শুকিয়ে গেছে। দু’তিন দিন ছিলাম না বলে কিছু খেয়াল করিনি ভালো করে।
সন্তানহারা এক মায়ের এহেন করুণ অবস্থায় কি যে করবো – মাথায় আসছিল না। যদ্দুর বুঝি- বাচ্চা গুলোর এই অবস্থার জন্য দায়ী ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট। সাধারণতঃ কৃমি। খাবার না পেলে ওখান থেকেই খেয়ে নেয় ওরা। পেটপুরে। কাউকে কামড়াতে যায় না কখনো। ধর্মঘটও করে না।
দেখলাম বাকি দু’টো বাচ্চাকে নিয়ে রেখেছে একটা ঝোপের আড়ালে। ঝিমিয়ে পড়ে আছে। ডাক্তার হয়ে এমন অসহায় অবস্থায় কখনো পড়িনি। কি দিতে কি দেবো, তার ফলে যদি খারাপ হয়?? আমি ভেটেরিনারির কি বুঝি?
ঠিক করলাম – একজন পরিচিত পশুর ডাক্তারকে ডেকে পাঠাবো। বাচ্চাগুলোকে নিয়ে এলাম তুলে। ঘরের সামনে শুইয়ে দিলাম। স্ট্রেচার হলো একটা চটের বস্তা। দুই রোগীই চোখ বন্ধ করে আছে। ভুলু র চোখে কি জল? গলার স্বরও খানিকটা খুশি খুশি! মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই বসে পড়লো সন্তানদের কাছে।
ডাক্তারকে ফোন করলাম। রাতের বেলা কোন কিছুই পাওয়া যাবে না বলে ডাক্তার বললেন – ওষুধ পাওয়া যায় কিনা দেখুন তো। না হলে এসে তো লাভ নেই। সকালে ওষুধ নিয়ে একবারেই আসবেন।
দেখলাম – কথাটা তো সত্যি। ডাক্তার তো নিধিরাম সর্দার এখন। কিন্ত কিছু না করলে যদি রাতেই ট্যাঁ বলে দেয়!! ঠিক করলাম – খানিকটা পথ্য খাবার আর সাথে নেট ঘেঁটে পাওয়া নলেজ দিয়ে একটা কৃমিনাশক দিয়েই দেবো। যা হয় হবে। ভুলু তো আর কাউকে বলতে পারবে না যে আমি ক্রসপ্যাথি করেছি!!
একটা ওষুধ খাবারে মিশিয়ে দিলাম। ভুলু জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে আছে। বাচ্চাগুলো পুরোটা খেয়ে নিল। তারপর শুয়ে পড়লো। আমি ও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে উঠে তো কেলেঙ্কারি। ঘরের সামনে গন্ধে মুখ বের করা যাচ্ছে না! বাচ্চা গুলো পায়খানা করে রেখেছে। সকাল। হতেই কোথায় গেছে কে জানে।
একটু রাগ হলো। উপকার করলে বুঝি এমন করতে হয়?? মনে মনে ভাবলাম – দেবো কয়েকটা পেটানি।
সকালে পশুর ডাক্তার এলেন। কালপ্রিটগুলোকে আবিষ্কার করলাম সিঁড়ির নিচে। ডাক্তার দেখে বললেন – কিছুই লাগবে না। ঠিকমতো খাবার দিলেই হয়ে যাবে।
বুঝলাম – কৃমির ওষুধ ব্যাপারটা ক্রসপ্যাথি হয়ে গেছে। আসলে খেতে না পেলে এসব ক্রসপ্যাথির ক্রসফায়ার দিয়ে কোন সুরাহা হবে না।
শয়তান বাচ্চাগুলো দেখছি ভুলুর চারপাশে মহানন্দে ঘুরছে আর আমার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হলো বলছে – শোন ব্যাটা ডাক্তার, যতই ভালো মানুষ হোস না কেন, ক্রসপ্যাথি করতে গেলেই কিন্ত ঘরের সামনে হেগে আসবো!!
আমি সেই ভয়ে ছুটলাম বাজারে। মাংস কিনে আনতে হলো!!! সেই থেকে রেগুলার চলছে আমার পয়সায় রোগীদের মাংসভোজ!
না, তারপর আর একদিন ও ঘরের সামনে নোংরা করেনি!!?
ভাবছি, এমনটা হবে না তো??