আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এই উপলক্ষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবছরের জন্য থিম বেছে নিয়েছে “আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার”..
দেখেশুনে কিছুটা খটকা, কিছুটা আমোদ এবং বাকিটা ভারী অস্বস্তি হ’ল। স্বাস্থ্য ছাড়ুন, এদেশের মানুষ যে কোনও ‘অধিকার’ নিয়েই আজকাল আর ভাবেন এরম বোধ হয় না। দ্বিতীয়ত, “স্বাস্থ্যের অধিকার” কথাটি বললেই নানান বখেড়া। একজন নাগরিক “আমার স্বাস্থ্য আমার অধিকার” বলা মানে গোটা বিশ্ব-স্বীকৃত অধিকারের কিছু দায় প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রকে নিতে হয়। স্বাস্থ্যের অধিকার মানে একজন নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে বেসিক এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যের অধিকার। এবং সেটা দেওয়ার দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র একদিকে নিজস্ব উদ্যোগে চিকিৎসা- শিক্ষা থেকে শুরু করে পরিষেবা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রকে প্রাইভেটাইজেশন করবে, মাল্টি- বিলিয়ন ডলার ফার্মা জায়ান্টদের থেকে কোটি কোটি টাকার ইলেকটোরাল বন্ড কিনবে যার প্রত্যক্ষতায় নাগরিকের জন্য সাধারণ জীবনদায়ী ওষুধের দাম মহার্ঘ্য হবে আর অন্যদিকে গোটা দেশে বিজ্ঞজনেরা “আমার স্বাস্থ্য আমার অধিকার” পালন করবেন ঝাঁ- চকচকে পোডিয়াম থেকে সেমিনার সেরে আর একদিনের বিনামূল্যে হেলথ ক্যাম্প করে– এই হিপোক্রিসিটি আমোদ জাগায় বই কী!
এর পরেও পড়ে থাকে গুচ্ছ কথা। “স্বাস্থ্য” মানে শুধু “সুস্থতা”? সবকিছু ইনডিভিজুয়ালাইজেশনের যুগে স্বাস্থ্যকেও ধীরে ধীরে ইন্ডিভিজুয়ালাইজ করে দেওয়া হচ্ছে না কি? বিগত কয়েক দশক ধরে হয়নি কি? সোনাম ওয়াংচুক একুশ দিন অনশন করতে বাধ্য হলে তার শরীরে যে কিটোন বডি পাওয়া যায়, তার ব্যক্তিগত দায় সোনামের ওপর দিয়ে আমরা সবাই শান্তির ঘুম ঘুমোতে পারি, তাই তো? যে বেকার মেয়েটা মাথার ভেতর শূন্যতা নিয়ে প্রত্যেকদিন ঘুমোতে যাচ্ছে তাকে অ্যালপ্রাজোলাম প্রেসক্রাইব করলেই আমার এবং সিস্টেমের সব দায় শেষ? কর্পোরেটে কয়েকটা হাজার টাকার জন্য অমানুষিক সেলস টার্গেটের পেছনে সারাক্ষণ বাইক ছোটাচ্ছে যে ছেলেটা, তার হিট স্ট্রোকের দায় শুধুমাত্র তারই? ভূগর্ভস্থ জলস্তর ধ্বংস হয়ে গিয়ে শরীরে আর্সেনিকের ছোবল নিয়ে ঘুরছে যে গ্রামবাসীরা, তার দায় তাদের? দিনে পাঁচ হাজার টাকার গাড়ি ভাড়া করতে পারবে না বলে যে মা- বাবা নিজের বাচ্চাকে দেখাতে শহরতলি থেকে লোকাল ট্রেনে কলকাতা আসছেন, যে ট্রেন আড়াই ঘন্টা লেটে হাওড়া ঢুকবে (দিনের পর দিন) যার ফলে সরকারি মেডিকেল কলেজের বাইরে এক কিলোমিটার লাইন দিয়ে ওপিডিতে আর দেখানো হবেনা তাদের এবং তারা জমি বন্ধক রেখে বাধ্য হবেন উলটো ফুটের নার্সিংহোমে বাচ্চাটিকে ভর্তি করতে, সেই বাধ্যতাকে আমাদের পক্ষ থেকে ‘চয়েজ’ নাম দেওয়া যায় তো?
স্বাস্থ্য মানে শুধু ব্যক্তিগতভাবে সুস্থ থেকে আজীবন ন’টা- পাঁচটা ঠেলে যাওয়া নয়। স্বাস্থ্যের অধিকার মানে তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে মানুষের জল- জঙ্গল- জমির অধিকার, মানুষের জীবন- জীবিকার অধিকার, মানুষের অন্যান্য পরিষেবাগুলো পাওয়ার অধিকার। দিনের পর দিন এ দেশে “অধিকার” শব্দটাকে হয় ব্যঙ্গের ডিকশনারিতে ছুঁড়ে দেওয়া হবে অথবা তুমুল অবজ্ঞায় ভুলিয়ে দেওয়া হবে, আর আমরা আশা করব কোনও এক ৭ই এপ্রিল হঠাৎ মানুষ নিজের স্বাস্থ্য- অধিকার নিয়ে খুব সচেতন হয়ে উঠবেন, এ হয় না।
আমরা কেউ কারও লড়াই লড়ে দিতে পারি না। কেউ কারও চিৎকার করে দিতে পারি না। কিন্তু এদেশের এক দীর্ঘ ইতিহাস ছিল, এদেশের মানুষ সর্বংসহা হয়েও সময়ে চিৎকার করতে জানত। আপাতত এদেশের দিকে তাকিয়ে বোধ হচ্ছে না কেউ জেগে আছে। ভোটের জন্য লড়াই সবসময়ই ছিল। কিন্তু তার পাশেও মানুষ নিজের অসুবিধে হলে বলত, প্রথমে নিজেদের, তারপরে সরকারকে। সে সরকার যেই হোক না কেন। এখন সবাই শান্ত, সবাই সুশীল। এবং সবাই দলীয়! সবাই দল করেন, কেউই রাজনীতি করেন না। সবাই কথা বলার আগে দেখে নেন প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে তার দল এটা অনুমোদন করে কী না। অন্তত তার দলের বিরুদ্ধে কথাটা যায় না তো! নিজের ভাষায় নিজের কথা বলায় যে বিশুদ্ধ রাজনীতি আছে, তা সব্বাই ভুলে গেছে।
তাই স্বাস্থ্য এবং অধিকারের কথাও সব্বাই ভুলে গেছে। ফেলো কড়ি মাখো তেলের ইকোনমিতে এখন শুধু ট্রানজাকশন হিস্ট্রি পড়ে আছে। সেটা রাষ্ট্রও জানে, WHO ও জানে আর পোডিয়াম আলো করে দাঁড়িয়ে থাকা বিজ্ঞজনেরা যারা আইডিয়া প্রোপাগেট করেন, তারাও জানেন।
আজও এদেশে নিজের স্বাস্থ্যের জন্য টাকা গুনতে গিয়ে দারিদ্রসীমার নীচে চলে যান একটা বড় অংশের মানুষ। রাজ্য বা জাতীয়, কোনও হেলথ স্কিমেই এর সমাধান এখনও হ’ল না। এখনও আমাদের দেশ তার জিডিপির যে শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে খরচ করে তা WHO রেকমেন্ডশনের চেয়ে অনেক কম, পৃথিবীর কিছু দরিদ্রতম দেশের সমতুল্য। সর্বোপরি যে টাকাটা খরচ হয়, সেটা মূলত তেলা মাথায় তেল দেওয়া। ফলে হেলথ ইনইক্যুয়ালিটি, হেলথ গ্যাপ আকাশছোঁয়া।
যে কোনও কনটেক্সটেই “অধিকার” শব্দটি উচ্চারণ করতে গেলে রাজনৈতিক হতে হয়। এবং “স্বাস্থ্য” ভীষণভাবে রাজনৈতিক। বরাবরই। যতদিন না পর্যন্ত মানুষ রাজনৈতিক হতে শিখছে, ততদিন পর্যন্ত WHO এবং স্বাস্থ্য দিবসে তাদের “অধিকার”এর থিম একটি ফার্স হিসেবেই রয়ে যাবে, এটুকুই আশঙ্কা। আর আশা, মানুষ সবকিছু থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকতে পারে, নিজের থেকে, নিজের স্বাস্থ্যের থেকে নয়। ফলে আজ বা কাল, তার স্বাস্থ্যের অধিকার তাকে বুঝতেই হবে।
তাকেই বুঝতে হবে।