আজকের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান “মাই হেলথ মাই রাইটস।” আমার স্বাস্থ্য আমার অধিকার এই বিষয়টা নিয়ে ম্যাক্রো লেভেলে অনেকে আলোচনা হবে আজ পৃথিবী জুড়ে, গুরুগম্ভীর সেমিনার হলে, কাগজের পাতায় আর্টিকেল লিখে। একজন সামান্য স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গত তিরিশ বছর ধরে খুব কাছ থেকে দেখার সুবাদে মাইক্রো লেভেল এর কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করা দরকার।
প্রথমেই স্বীকার করে নেয়া দরকার যে আমরা তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ, তার একটি অঙ্গ রাজ্য। তার সরকারি ব্যবস্থায় অর্থ বরাদ্দের অপ্রতুলতা থাকবেই। সেই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে যদি প্রশ্ন করি,স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটা আরো কি ভাবে ভালো করা যায়। এই প্রশ্নটা নতুন নয়। আশির দশকে বিগত সরকারের আমলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে জড়িত আমরা সবাই শুনেছিলাম একটা শব্দ। ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স। বাংলায় বলা যায় ব্যবস্থাপনা বিদ্যা (সব কিছুতে বিজ্ঞান শব্দটা জুড়ে দেয়াতে আমার আপত্তি আছে)। চাকরি জীবনের শুর থেকে প্রশাসক হিসেবে (বেসরকারিতে যা ব্যবস্থাপক, সরকারিতে তাই প্রশাসক) হিসেবে চেষ্টা করেছি সেই বিদ্যা প্রয়োগের। যে ব্যবস্থাপনায় রিসোর্স যত কম, সেখানে এই বিদ্যা প্রয়োগের সুযোগ তত বেশি।
শুরু থেকে একটা বিষয় খুব যন্ত্রণা দিয়েছে। আমরা, যারা স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে যুক্ত তাদের বেশির ভাগই ব্যবস্থাটা ওই পরিষেবা দানকারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে অভ্যস্ত, পরিষেবা যারা নেয়, সেই আমজনতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। গত দশ বছরের অভিজ্ঞতার কথা বলছি, যখনই কোনো হাসপাতালের সুপারের সাথে, চিকিৎসকদের সাথে বৈঠক হয়েছে, কি চাই বলে, তারা সমস্বরে নানান যন্ত্রপাতি, সাজ সরঞ্জামের ঘাটতির কথা বলেছেন। কিন্তু প্রায় মনেই করতে পারি না যে তাদের কেউ কখনো বলেছেন নতুন ও টি টেবিল, বা C আর্ম-এর পাশাপাশি আউটডোরে অপেক্ষমান পেসেন্টদের বসার জন্য বেঞ্চি চাই, তাঁরা যেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন সেখানটায় তাঁদের মাথার ওপরে পাখা চাই। তাঁদের জন্য গরম কালে একটু খাওয়ার জল চাই। সংবেদনশীলতার অভাব? সহমর্মিতার অভাব? ঠিক কি কারণে দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এই ফাঁক সেটা জানা নেই।
দৃষ্টিভঙ্গি একটা বিরাট ভারী শব্দ। একটু ছোট করে নিয়ে আসি। দেখার চোখ। গত দু মাসের অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার জেলায় একটি হাসপাতালকে কতটা ভালো করা যায় সে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিলাম। বিশেষ কারণ ছিল। কারণটা বললাম না। সেই হাসপাতালে তৃতীয় দিন ভিজিটের সময় চোখে পড়লো যে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে এক বৃদ্ধা নামছেন, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে। সঙ্গে এক বৃদ্ধ। কোনো রকমে সাহায্যের চেষ্টা করছেন। বৃদ্ধা অর্থোপেডিক কেস। গেঁটে বাতের শিকার। ওই হাসপাতালটা ১৯৮০-এর দশক থেকে চলছে। অর্থোপেডিক opd টা দোতলায়। এই গত চল্লিশ বছরে কয়েক ডজন সুপার বদলি হয়ে চলে গেছেন, কয়েক ডজন অর্থোপেডিক সার্জেনও। কারুর একবারও মনে হয় নি যে লিফট নেই এমন হাসপাতালের দোতলায় অর্থো আউট ডোরের ব্যাবস্থা করে রেখে দেওয়াটা অমানবিক ? একতলায় কোনো ঘর ছিল না? হস্তক্ষেপে সাতদিনের মধ্যে সেই আউটডোর দোতলা থেকে একতলায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল।। আসলে রুগীর হয়ে, তার চোখ দিয়ে দেখবার চেষ্টাটাই ছিল না।
ব্যবস্থাপনা বিদ্যার আরেকটা প্রয়োগের কথা বলি। ওই হাসপাতালেই চব্বিশ ঘন্টা ECG হয় না। সুপারের সাফাই, স্যার, মাত্র একজন টেকনিশিয়ান। সত্যি কথা। তাহলে যতদিন না আরো টেকনিশিয়ান, টেকনোলজিস্ট পাওয়া যাচ্ছে ততদিন কি হবে? সুপার, নার্সিং সুপার নিরুত্তর। সরকারি আদেশ নামা খুলে দেখাতে হল যে নার্সিং স্টাফেরা ট্রেনিং নিয়ে ECG করতে পারেন। নার্সিং সুপারের গাঁইগুঁই। স্যার, স্টাফ কম আছে। পে রোল খুলে দেখলাম, অনুমোদিত পদের তুলনায় প্রায় ডবল স্টাফ কাজ করছেন।
এখানেই শেষ নয়, ফার্মাসিস্টের সাথে যন্ত্রপাতির তালিকা নিয়ে বসে দেখা গেল যে কোভিডের সময় এক গাদা মাল্টি চ্যানেল মনিটর পাওয়া গেছিল। তার অধিকাংশই অব্যবহৃত পড়ে আছে। তাদেরই একটা খুলে ইমারজেন্সি রুমে লাগাতে সময় লাগলো মাত্র দু দিন। তাতে দিব্যিই ECG হচ্ছে। এর আগে ডাক্তাররা ইমারজেন্সি ECG লিখলেই বাইরে থেকে একদল ছেলেপুলে এসে করে দিয়ে যেত। তারা এখন আর কেস পাচ্ছে না। অবাক করা বিষয় এই যে ওদের ওই কেস কমে যাওয়া নিয়ে ব্যথিত হয়ে হাসপাতালের কেউ কেউ আবার দরবার করতে এসেছিল।
নাহ্। সবটাই সাফল্যের ইতিহাস নয়। ব্যর্থতার গ্লানিও আছে। হাজার বলে কয়েও ঠান্ডা জলের মেশিন বসাতে পারিনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে টেন্ডার কোটেশনের নিয়মের ভুলভুলাইয়া দেখিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা সেই তাঁদের চোখ দিয়েই দেখছেন, রুগীর চোখ দিয়ে নয়। ওই হাসপাতালের কারিগরি বিভাগের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁদের এমন গড়িমসির ফলে সর্বোচ্চ মহলে নালিশ জানিয়ে তাঁদের বদল করা গেছে। এখন নতুন এজেন্সি। দেখা যাক তাঁরা কবে করে দেন। খোঁজ নিলে হয়তো জানতে পারবো যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আদৌ কোনো রিকুইজিশন ই পাঠান নি। টাকার অভাবে হবে না এমনটা নয়, তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশ বলে স্বাস্থ্য ভবন সেন্ট্রাল AC হওয়া আটকায় নি। CMOH-এর অফিস AC হওয়া আটকায় নি তো!
লেখাটা আর লম্বা করবো না। পুরাণের সেই সিসিফাসের কথা মনে হয়। দেবতাদের শাপে অভিশপ্ত সিসিফাসের টার্গেট ছিল একটা বিরাট পাথরের বলকে গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের মাথায় ওঠানো। সারাদিন খেটে খুটে সিসিফাস মাথায় উঠিয়ে দিত। আর রাত হলেই সেটা গড়িয়ে নিচে নেমে আসতো। সকাল থেকে শুরু হতো আবার পাথর ঠেলার কাজ। কাল সকাল থেকে আবার শুরু হবে। আমি ও আমার সহকর্মীরা যারা মনে করি যে স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান কেবল একটা স্লোগান নয়, স্বাস্থ্য আমাদের অধিকার, তারা আবার পাথর ঠেলতে শুরু করবো। আপনারা সাথে থাকলে একদিন না একদিন অভিশাপ মুক্ত হবই। হ্যাঁ এই দেশে, এই তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশেই।
😏😮💨দারুণ।
হাসপাতাল বরাবরই একটা জীবন দর্শন।
মনের জোরের কারখানা
বেশ রেগেই থাকো তাহলে।🤨😔
কী সুন্দর যে লিখেছো।💕🙏✊️
My comrade