বাবা একটি টেপ রেকর্ডার কিনে এনেছিলেন, তখন আমি পাঁচ কি ছয়, মা রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতে শেখান। সেই টেপ রেকর্ডারে “সোনার তরী” রেকর্ড করে স্কুলে গিয়েছেন, আর আমি বার বার শুনে শিখে নিচ্ছি কবিতার ভাষা। সেই রেকর্ডারে একদিন মা সবার গলা রেকর্ড করছেন। পাশের বাড়ি কাজ করে সন্ধ্যাদি, কত হবে বয়স দশ কি বারো, (শিশুশ্রম তখনো নিষিদ্ধ হয় নি) মা সন্ধ্যাদিকে বললেন, “কিছু বল, রেকর্ড করি।”
সন্ধ্যাদি নির্ভুল উচ্চারণে, সঠিক যতিচিহ্ন সহ বলে গেল রবীন্দ্রনাথের “রাজা ও রানী”, আমরা অবাক বিস্ময়ে শুনলাম সন্ধ্যাদির আবৃত্তি। জানা গেল কোন এক ভুলে যাওয়া অকালে ফেলে আসা ছেলেবেলায় সন্ধ্যাদি স্কুলে যেত, সেখানে শিখেছিল এই কবিতা, আর এত ভালো লেগেছিল তা ভুলতে পারেনি। না, আর কোন রবীন্দ্রনাথ চর্চা করার তার সুযোগ হয়নি, কিন্তু সেই একটি শিশুদের ছড়ার মধ্যে দিয়ে এক প্রান্তিক শ্রমজীবী শিশুর মনের গভীরে পৌঁছে গিয়েছিলেন কবি।
তারপর যত বড় হতে লাগলাম, যত সভা সমিতি, রবীন্দ্র অনুষ্ঠানে যোগ দিতে লাগলাম কিছু ধুতি পাঞ্জাবী আর লাল পাড় সাদা শাড়ির রবীন্দ্র বোদ্ধা ক্রমাগত চেষ্টা করতে লাগলেন কবিকে নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়ার, তাঁদের কথা বলার ভঙ্গিতে, একঘেয়ে গানের গায়কীতে, অদ্ভুত ভাবে উচ্চারণ করা শব্দে, বা কথায় কথায় অমুক গ্রন্থের অমুক অনুচ্ছেদের রেফারেন্স প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন “দেখ বাছা কবি কে জানবার মত পড়াশোনা তোমার কোথায়? রবীন্দ্র চর্চা কাকে বলে বোঝ হে অর্বাচীন?”
সে এক সময়, কিশোর মনের বিদ্রোহী হয়ে ওঠার, বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠার সহজ সময়। কিন্তু তা হয়নি, কবিকে বেঁধে রাখবে এমন শক্তিমান সে রবীন্দ্র বোদ্ধার দল?
গভীর রাতে দেবব্রত বিশ্বাস যখন গেয়ে ওঠেন “বিস্ময়ে তাই জাগে” বুকের কোন গভীরে জেগে ওঠে বিস্ময়।
বয়স বাড়ে যে “জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনেত” গান কিছু গায়কের গায়কীর গুণে একঘেঁয়ে লেগেছিল সেই একই গান দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে শুনে গায়ে কাঁটা দেয়
“আমার এ ঘর বহু যতন ক’রে
ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।
আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে”
আরো বয়স বাড়ে, এখন আমিও পিতা এই একই লাইন শুনে অঝোর ধারায় জল পরে চোখে, থামাতে পারিনা। কবিপুত্র মারা গেছেন, জগত চরাচর ভেসে যায় চাঁদের আলোয়, সবাই আলোর নেশায় মাতোয়ারা আর কবি লেখেন
“যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে–
এই নিরালায় রব আপন কোণে।”
“যদি আমায় পড়ে তাহার মনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে॥”
মনের কোন গভীর থেকে মুচড়ে ওঠে কান্না। সেও পিতা আমিও পিতা।
এই তো আমার কবি। এই তো আমাদের কবি, গ্রাম দেশে কোন এক মৃত্যু পদযাত্রী ” দাদির” শেষ খেয়ার মাঝি। না না রবীন্দ্র রচনাবলী মুখস্থ করা জ্ঞানী বোদ্ধা যত বিশেষজ্ঞ এ আপনাদের রবীন্দ্রনাথ নাই বা হলো, এ কবি আমার প্রাণের কবি। মাত্র একটি গানে বা একটি কবিতায় হৃদয়ে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে যিনি পারেন তিনিই তো বিশ্বকবি।