বিশ্ব বই দিবসে প্রিয় একটি বই নিয়ে দুচার কথা —
ধ্রুপদী ঘরানার বাংলা সাহিত্যকর্মের লেখক ও পাঠকরা নারায়ণ সান্যালের সৃষ্টি গুলি সর্ম্পকে কিঞ্চিৎ নাক সিঁটকালেও দিনের শেষে যে কথা স্বীকার করতে বাধ্য হন সেটা হল তাঁর বিষয়বস্তু নির্বাচনের বৈচিত্র্য। সেই থোড় বড়ি খাড়া, মধ্যবিত্ত জীবন যাপনের নানান দিক নিয়ে জটিলতার বাইরে তিনি যে কত বিচিত্র বিষয়ে স্বচ্ছন্দ গমন করেছেন তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হল এই বইটি। এ পথে গমন করতে গিয়ে তাঁকে প্রায়ই বিদেশি সাহিত্যের দ্বারস্থ হতে হয়েছে (যেমন এই বইটির ক্ষেত্রে রবার্ট জঙ্কের “ব্রাইটার দ্যান এ থাউজ্যান্ড সানস”) তাতে সান্যাল সাহেবের রচনার মৌলিকত্ব নিয়ে কূট প্রশ্ন তুললেও সেটা আপাতগ্রাহ্য। কারণ তিনি প্রতিটি রচনাতেই আপন মনের মাধুরী এত চমৎকার ভাবে মিশিয়েছেন যে রচনাগুলো প্রায় মৌলিক হয়ে উঠেছে।
বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব নিয়ে দুটি কথা বলার থাকে। প্রথম কথা হল বাজার। বাজারে যা খায় সেই ধরনের বিষয় নির্বাচন কোনো সাহিত্যিক করে থাকলে তাকে ছোট না করেই একথা বলা যায় যে বাংলা সাহিত্যের জগতে বিষয় বস্তু নির্বাচনে অসীম সাহসিকতায় পরিচয় দিয়েছেন স্যানাল মশাই। বাজারে খাবে কি খাবে না, সেটা আদৌ ভাবেন নি। তিনি মনে করতেন যে লেখাটি স্বাদু হলে, উপভোগ্য হলে পাঠককুল মুখ ফিরিয়ে নেবেন না, সে বিষয়বস্তু নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যা রসায়নের মতো খটোমটো বিষয় হলেও। বাংলার পাঠক কুলের প্রতি তাঁর এই আস্থা প্রকাশ অতি বিরল ঘটনা। বিষয় বস্তুর বৈচিত্র্যের আরেকটি দিক হল বিষয়নিষ্ঠতা। যেটা নিয়ে লিখছেন তাতে তথ্য ও তত্ত্বের ফাঁকিবাজি যাতে না থাকে তার জন্য উনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। অনেক প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিকই এটা করতেন না, এখনও করেন না। স্যানাল মশাই ব্যতিক্রমী ছিলেন। তাই তাঁর লেখায় আমরা পদার্থবিদ নায়ক পাই। পদার্থবিদকে নায়ক হিসেবে উপস্থাপিত করার মতো সাহস ও পরিশ্রম অন্য কোনো বাঙালি সাহিত্যিক করেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। অধিকাংশ বাংলা উপন্যাসে নায়কের পেশাটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই না। বিদেশি ফিকশন জগতে এই ধরনের পড়াশোনা করে (ওঁরা বলেন রিসার্চ) লেখাটা প্রায় বাঁধাগতের ব্যাপার। পাতি বিদেশি থ্রিলার লেখকরাও এসব করে থাকেন। বাংলা সাহিত্যে এই বিষয়ে স্যানাল মশাই অন্যতম পাইওনিয়ার।
এতক্ষণ যা লিখলাম সেগুলি সবটাই সান্যাল মশাই-এর একনিষ্ঠ পাঠকরা জানেন। এই বার নেহাৎই ব্যক্তিগত উপলব্ধি। আমার কাছে এই উপন্যাসের সবচেয়ে বর্ণময় চরিত্র ছিলেন ফাইনম্যান। ফিজিক্স নিয়ে ফাইনম্যা্নের অসাধারণ পাঠ্য পুস্তুক পড়ার অনেক আগেই এই বইটির দৌলতে ওই নামটির সাথে পরিচয়। পরিচিত হয়ে একেবারে ফিদা হয়ে গেছিলাম। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে যে গল্পের খাতিরে কোনোভাবেই কোনো চরিত্র নিয়ে সান্যাল মশাই-এর বিস্তারিত লেখার সুযোগ ছিল না। সামান্য যতটুকু জায়গা পেয়েছেন তাতেই ফাটিয়ে দিয়েছেন। শুধু ফাইনম্যান নয়, ওপেনহাইমার, ফুকস, আইনস্টাইন, নিলস বোহর সবাই সবাই। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে এঁরা সবাই ঐতিহাসিক চরিত্র। আপন মনের মাধুরী মেশানোর বিশেষ সুযোগ সান্যাল মশাই-এর ছিল না, উনি নেন নি।
পরিশেষে বলবো, বইটার প্রায় শেষ দিকে আসার আগে এটা একটা ট্রু স্টোরি বেসড থ্রিলার হিসেবেই পড়ছিলাম শেষের দিকটায় এসে নারায়ণ বাবু তাঁর লেখাটাকে একটা আলদা উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ এটা কেবল মাধ্যমিক স্তরের পাতি পরীক্ষার কমন কোশ্চেন নয়। বৃদ্ধ পদার্থবিদ, ব্রিটিশ জেলে বন্দী অটো হান যখন হিরোশিমায় বোমা বিস্ফোরণে মৃতদের রক্তে রাঙা তাঁর দুটি হাত মেলে দেখছেন হাহাকার করছেন সেই দৃশ্যটা যে উপন্যাসে এসে যায় তাকে থ্রিলার বলে অপমান করা যায় না। পপুলার সায়েন্সের বই বলে যাঁরা একে চিহ্নিত করতে চান তাঁদের বলবো ফুকস্ আর রেনাটার অমন রোমান্সে ভরপুর পপুলার সায়েন্স ভাই রোজ লেখা হোক। মোদ্দা কথা একটাই এই বইটা ঠিক কোন ঘরানার সেটা ঠিক করা নিয়ে গ্রন্থাগার বিশেষজ্ঞেরা মাথা ঘামাক, আমরা খালি বলবো নারায়ণ স্যানাল জিন্দাবাদ। বইটা যে কতবার পড়েছি তার হিসেব দাখিল করলাম না। কোনোবার পুরোনো হয় না। আমার মতো পাতি পাঠকের কাছে চিরন্তন। আবার বলি সান্যাল মশাই জিন্দাবাদ…
২৩শে এপ্রিল, ২০২৪
আরে মুশকিল!” পাতি কোয়ালিফিকেশন” বলতে তো আমি কম বলেছি।যার কথা বলেছি ভদ্রমহিলার নাম নূপুর গাঙ্গুলী এবং গ্রাজুয়েট কি না সন্দেহ। আর তার স্বামী হলেন ঘটনাচক্রে সেই সিপিএম নেতা সুনীল কুমার গঙ্গোপাধ্যায় ।🙂😏😠
ভালো হয়েছে লেখারূপ আলোচনাটা।
বিশ্বাস ঘাতক পড়েছি।আমার মনে নেই এখন আর।
কতগুলো পর পর পড়লাম। কিন্ত রিভিউ দিতে নিলেই
অযোগ্য মনে হয় নিজেকে।যাইহোক ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টও পড়া অনেক আগের। বিদেশী সাহিত্য অনুবাদ শিল্পের কোনো তুলনা হয় না।এক অর্থে খুব মধুরতার সে তার।
‘কতগুলো বই’ হবে ।*টাইপো হয়েছে ^^