শুনলাম, আজ নাকি বিশ্ব বই-দিবস। সে নিয়ে কী-ই বা বলি! ভাস্কর চক্রবর্তী কোথায় একটা লিখেছিলেন, যে, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তিনি আর কিছুই করেননি, শুধু কবিতা লেখা ছাড়া। অবান্তর বিনয় না করতে চাইলে নিজের সম্পর্কে আমিও বলতে পারি, গুটিকয় বই পড়া – এবং তার চাইতে কয়েকগুণ বেশি বই কেনা – এছাড়া আমি জীবনে আর কিছুই করিনি। করিনি মানে, করে ওঠা হয়নি। ইচ্ছেও হয়নি, অবকাশও ঘটেনি।
বই কেনার বাহুল্য নিয়ে বাড়িতে রোজই গালমন্দ শুনি। বই রাখার স্থানাভাব নিয়েই গঞ্জনা মূলত – জানালার কার্নিস থেকে খাটের তলা, সবাই জবাব দিয়েছে – সুতরাং গঞ্জনা অকারণ, এমন কথা বলতে পারি না। তবে কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, এত এত বই কেনেন, সবগুলো পড়েন? পড়বেন কখনও? উত্তর দিতে আনাতোল ফ্রাঁস-এর গল্পটা বলি। আপনারই মতো একজন ফ্রাঁস-এর লাইব্রেরি দেখে একই প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দেন – আপনার বাড়ির সব বাসনপত্র, চিনেমাটির দামী দামী ডিনার সেট, সেসব কি আপনি রোজ ব্যবহার করেন? অতএব…
তো যাঁরা জ্ঞানার্জনের জন্য বই পড়েন, আমি তাদের দলে পড়ি না। পড়ি আনন্দের জন্য, পড়ি আগ্রহের কারণে – পড়ি স্রেফ পড়া বাদে আর কোনও অভ্যেস সেভাবে গড়ে ওঠেনি, এই অক্ষমতা বশত-ও। অমুক বইটি পড়েছি শুনে কেউ যদি সে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেসটিজ্ঞেস করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি ভাসাভাসা উত্তরের বেশি কিছু বলতে পারব না। কেননা প্রথমত, আমার স্মৃতিশক্তি খুব পোক্ত নয় এবং বহুকাল আগেরও তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা মনে থেকে গিয়ে যেটুকু স্মৃতি-স্পেস ছিল তা এমন ভরাট করে রেখেছে, যে, কাজে-লাগলেও-লাগতে-পারে-এমন কথা আর মাথায় থাকে না। এবং দ্বিতীয়ত, পড়াটা যেহেতু স্রেফ আগ্রহ ও আনন্দের কারণে, মনে রাখার মতো করে পড়া হয় না। এক সময় এ নিয়ে দুঃখ হতো, পরে যখন দেখলাম যে স্বয়ং মন্তেইন বলেছেন, “And if I am a man of some reading, I am a man of no retention.”, তখন আর মনখারাপ করি না। ‘সাম রিডিং’ যদি না-ও হয়, ‘নো রিটেনশন’-এ মন্তেইন-কে ধরে ফেললাম, সে-ই বা কম কী!
তো মন্তেইন-এর কথা যখন উঠলই, তখন আরেকটু বলি। উনি বলেছেন, কোনও একটি বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ বা নিখুঁত জ্ঞান লাভের জন্য তিনি পড়তেই পারতেন, কিন্তু সেরকমভাবে পড়ার জন্য যে মূল্য চুকাতে হয়, তিনি তাতে রাজি ছিলেন না। বলাই বাহুল্য, এ আমারও মনের কথা। অথবা, কোনও বিষয়েই সম্যক জ্ঞান লাভ করা হলো না, এমন অক্ষমতা ঢাকতে এ-ই আমার অজুহাত। দুভাবেই দেখতে পারেন।
তবে পড়া কি কাজে আসে না কখনোই? অবশ্যই আসে। এই যেমন ধরুন, মাঝেমধ্যে জীবনটাকে অসম্ভব ক্লান্তিকর মনে হয়। বিশেষ করে চাকরিটাকে। না, একেবারেই এসব বদলিটদলির জন্য নয়, সামগ্রিক কাজের পরিস্থিতি পারিপার্শ্বিক এই সবকিছু নিয়েই বিরক্তি। মাঝেমধ্যে এমনও ভাবি, স্রেফ উপার্জনের জন্য এমন একটা চাকরি করে চলার কী অর্থ! (প্রসঙ্গত, অকপটে স্বীকার করি, কোনও কারণ বা যুক্তি ছাড়াই মাঝেমধ্যেই মনে হয়, সেভাবে চেষ্টা করলে আমার পক্ষে মহত্তর কিছু করা সম্ভব হলেও হতে পারত, রণ-রক্ত-সফলতা না হলেও ওই লেভেলের ভালো একটা কিছু ঘটলেও ঘটতে পারত এই আমারই সঙ্গে – তবে চিন্তা করবেন না, অল্পসময়েই চটকা ভেঙে বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসতে পারি এবং সত্যিটা উপলব্ধি করতে দেরি হয় না।) তো যখন এমন মনে হয়, তখন সত্যিসত্যিই অস্থির লাগে এবং মনে হয় – আক্ষেপ হয় – শুধু গ্রাসাচ্ছাদন নিশ্চিত করার পেছনে ছুটেই জীবনটা পার করে দেব!! এদিকে এমন আর কোনোই গুণ নেই, যা দিয়ে ন্যূনতম উপার্জন সম্ভব! অগত্যা… তো এই সব মুহূর্তে আচমকা মার্কাস অরেলিয়াস-এর কথাটা মনে পড়ে – রোজ সকালে বেরোনোর সময় নিজেকে মনে করাবে, আজ সারাদিন তোমার সঙ্গে যাদের দেখা হবে, তাদের মধ্যে থাকবে একগাদা ধূর্ত ধান্দাবাজ ঘোড়েল দালাল চিটিংবাজ মেশা-যায়-না পাতে-দেওয়া-যায়-না এমন কিছু মানুষ… মাইরি বলছি, পড়ে মনে হয়, ভদ্রলোক কি সরকারি চাকরি করতেন নাকি! আর তখুনি চটকা ভেঙে মনে পড়ে, ভদ্রলোক রোমের সম্রাট ছিলেন – সেভাবে দেখতে গেলে, তৎকালীন বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাশালী মানুষ তিনিই। তাঁরই যদি এই অবস্থা, তাহলে আমার তো…
আসলে রবি ঠাকুর তো বলেইছিলেন : “হঠাৎ খবর পাই মনে/ আকবর বাদশার সঙ্গে/ হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।/ বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে/ ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে/ এক বৈকুণ্ঠের দিকে।”
তো মন্তেইন-এর কথাতেই ফিরি। তিনি বলেছিলেন, বই যদি কোনও বিশেষ কারণে পড়ি, তাহলে সেটা নিজের সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য – আর কী করে ভালোভাবে বাঁচা যায় এবং ভালোভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া যায়, সেটুকু বুঝতে।
আদতে, এমন অকারণ বই পড়া – বই পড়ে চলা, কিনে চলা-ও – সেসব নিয়ে যদি কিছু জিজ্ঞেস করেন, তাহলে বলব, এ অভ্যেস আমার কাছে শুধু সেই গানটুকু স্পর্শ করতে চাওয়া… বামনের চন্দ্রস্পর্শাভিলাষ জেনেও শুনতে চাওয়া…
“এ গান যেখানে সত্য/ অনন্ত গোধূলিলগ্নে/ সেইখানে/ বহি চলে ধলেশ্বরী,/ তীরে তমালের ঘন ছায়া…”
আসলে, আরও বড় কিছু নয়, আমার কাছে বই পড়া বলতে মাত্র এটুকুই।
“কম কিছু মোর থাকে হেথা/ পুরিয়ে নেব প্রাণ দিয়ে তা/ আমার সেইখানেতেই কল্পলতা…”
বই বলতে, আমার ওই কল্পলতার মায়াবী আশ্রয়…
তাতে “আমার না-ই বা হলো পারে যাওয়া…”
২৩শে এপ্রিল, ২০২৪