লকডাউনের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী অনেকবার তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। অনেক উদাহরণ দিয়েছেন এবং কোনো পরিস্থিতিতেই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার ইচ্ছা লেখকের নেই।
রাজ্যেও মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে এইসব প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাচ্ছি, তবুও কিছু প্রশ্ন করতে হল।
স্মৃতির সরণি বেয়ে যখন একবার তিন বছর আগের ঘটনার দিকে তাকাই তখন মনে পরে যায় মুম্বই হাইকোর্টের সেই বিখ্যাত উক্তি,”যদি কাজ করতে ভয় পান তবে ঘরে থাকুন।”
আজ পর্যাপ্ত পি পি ই ছাড়াই চোয়াল শক্ত করে কাজে নেমে পরেছে ডাক্তাররা। ৫৬ ইঞ্চির ছাতি নেই কিন্তু মানবতাটা এখনো বিসর্জন দিতে পারেনি ডাক্তাররা। গ্লাভস,মাস্ক হ্যাজমেট কভার অল সুটস – এইসবের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে আসছে দুসপ্তাহে সুনামির আকার নিতে চলেছে করোনা। বিশ্বায়ন পরবর্তী বিশ্বে এই বিশ্বব্যাপি বিপর্যয় আগে দেখা যায়নি। বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশেরাও আজ হিমশিম খাচ্ছে করোনা ঠেকাতে।
নব্য-উদারপন্থী পৃথিবীর এই ভাইরাসও নব্য-উদার পন্থা অবলম্বন করেছে।
ব্যাঙ্ক, কর্পোরেট এবং বড় ব্যবসায়ীদের আর্থিক মন্দা থেকে মুক্ত করতে গিয়ে ক্যাপিটালিজম ভুলে গেছে তার প্রতিশ্রুতি। ফরাসি বিপ্লবের তিন প্রতিশ্রুতি- স্বাধীনতা, সাম্য এবং সৌভ্রাতৃত্ব।
ডেনমার্ক ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং ইউ কে ৪০০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক দপ্তরকে সহায়তা করছে। ট্রাম্পের ইউ এস এ দিয়েছে ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। তাছাড়াও বিভিন্ন কর্পোরেটকে তারা দিয়েছে ৭০০ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু বেকারত্ব দূর করার ক্ষেত্রে এর সিকিভাগ খরচ হয়নি। এর সমতুল্য টাকা স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক উন্নতির খাতে খরচ হয়নি। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান এয়ারলাইনস ১০,০০০ কর্মীকে ছাঁটাই করেছে এই করোনার প্রকোপে।
ইউ কে মাত্র কিছুদিন আগে লকডাউন ঘোষণা করে। বরিস জনসন একে বলেছেন ভার্চুয়াল লকডাউন। সেখানকার রাজনীতিবিদদের বক্তব্য,” The virus mostly kills the old, ill, undernourished poor and we do not really care whether such unproductive people live or die”। অর্থনীতির এই যুক্তিকেই সামনে রেখে তাদের প্রশ্ন করা যায়,”প্রতি বছর যখন ৮,০০০ ক্ষুধাতুর শিশু মারা যায় তখন আপনারা অর্থনীতির কথা ভেবে কেন খাদ্য সরবরাহ করেন না?”
আমেরিকার চিত্রটা অন্যরকম। মানে ওই সেম ওয়াইন ইন নিউ বটল। ৩০ মিলিয়ন আমেরিকাবাসির কোনো স্বাস্থ্যবীমা নেই তাই তাঁরা নিজেদের করোনা ভাইরাসের জন্য পরীক্ষা করাতে পারছেন না। ১০০ মিলিয়নের বীমা করানো থাকলেও তাতে প্রচুর ডিডিউসিবল আছে। তার সাথে “কো- পে” -টাও কম নয় তাই তাঁরা ডাক্তার দেখাতে বা নিজেদের পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন না। এখানেই শেষ নয় – পরীক্ষায় পজিটিভ এলে চাকরি হারাবার সম্ভাবনা রয়েছে। গত দু’সপ্তাহে আমেরিকায় বেকারত্বের পরিমাণ ঐতিহাসিক। আমেরিকার ইতিহাসে কোনোকালে এত মানুষ একসাথে চাকরি হারায় নি। অর্থনীতির চাকা শুধু থেমে যায়নি দেখা দিয়েছে ঋণাত্মক বৃদ্ধি। আমেরিকা ফার্স্ট করতে গিয়ে ক্যাপিটালিজমের ভীষ্ম পিতামহ সেই দেশের নাগরিকদের শরসজ্জায় শুইয়ে দিয়েছে। সেই দেশে কোয়ারেন্টিনের আইন তো আছে কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা কে দেবে? এয়ারলাইন্স এবং পর্যটন কোম্পানিগুলোকে আয়করে ছাড় দিয়ে আমেরিকা আবার প্রমাণ করে দিয়েছে যে ক্যাপিটালিজমের কাছে কার অগ্রাধিকার বেশি। আজ সেই দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে বাজার অর্থনীতি। মাস্ক, পরীক্ষার সামগ্রী, সব আজ যার কাছে পয়সা তার হাতে রয়েছে। আমিরেরা বিলাসবহুল জাহাজে, বাড়ির নিচে বানানো বাঙ্কারে আশ্রয় নিচ্ছে। মাস্কের দাম সেখানে প্রায় ১০০০ ডলার। চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মীদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে কিছুই নেই। ক্যাপিটালিজমের এই নগ্ন রূপ আজ চাক্ষুষ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ।
ভারতের কি আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল? ভারতের পরিস্থিতি এই মুহূর্তে ঠিক কি রকম?
যে দেশে প্রতি বছর ৮০,০০,০০০ মানুষ মারা যান, ৪,০০,০০০ মানুষ শুধু টি বি তে মারা যান তাঁরা এতদিনেও সবার জন্য স্বাস্থ্যের গুরুত্ব কেন বুঝতে চাননা ?
ভারতের ৩৭% মানুষ নৈমিত্তিক শ্রমে যুক্ত। ৫৫% মানুষ দিনমজুর। ভাইরাসের আক্রমণের প্রকোপে এক তৃতীয়াংশ রেস্তোরাঁ বন্ধ। কর্মহীন ২০ লাখ মানুষ আর তাঁদের ২০ লক্ষ পরিবার। তারা আজ চান “শুধু ভাত একটু নুন”।
সত্যি করোনা নব্য- উদারপন্থী। সে সত্যিই গরীবের মুখের ভাত কেড়ে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে কোথাও এঁদের জন্য কোনো প্রকল্পের ঘোষণা ছিল না। কিছুদিন আগেই পাশ হয়ে গেছে ২০,০০০ কোটি টাকার পাওয়ার করিডোর রিভাম্প প্ল্যান। সজ্জিত হবে লোকসভা। কেরল সরকার ২০,০০০ কোটি টাকা করোনার মোকাবিলায় বরাদ্দ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
সে যাই হোক শুধু লকডাউন কি পরিস্থিতি সামলাতে সক্ষম?
না। এর জন্য চাই পরীক্ষা। মার্চের ২৩ তারিখ অবধি ভারতে ১৭,৯৯৩ জনের করোনার জন্য পরীক্ষা করা হয়। ভারতে এই মুহূর্তে সার্টিফাইড ল্যাবের সংখ্যা ১২২। এর মধ্যে ১১৬ টি সরকারি হলেও মাত্র ৮৯ টি ল্যাবে পরীক্ষা করানো যাবে। ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে আশা করা যায়।
এইবার বলব দক্ষিণ কোরিয়ার কথা যেইখানে রোজ প্রায় ১৭,০০০ মানুষের পরীক্ষা করা হচ্ছে অভিনব পদ্ধতিতে যেমন – “ড্রাইভ থ্রু টেস্টিং কিট”, “টেলিফোন বুথ” এর মাধ্যমে। এইভাবে তাঁরা বাগে আনতে পেরেছেন মহামারিকে।
পিছিয়ে নেই তুরষ্ক। ইরানের সীমান্তবর্তী এই দেশে আজ অবধি মৃতের সংখ্যা ২ (২৩ শে মার্চ)। তাঁরাও এই রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার মাধ্যমেই এই সাফল্য অর্জন করেছে।
আইসল্যান্ড দেশের অর্ধেক নাগরিকের পরীক্ষা করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।
আমাদের ভারত সরকার অনুরোধ করেছে পুঁজিপতিদের সামনে এগিয়ে আসতে, সাহায্য করতে। যে সরকার মুহূর্তের সিদ্ধান্তে ডিমনিটাইজেশন করতে পারে, একতরফা ৩৭০ ধারা ছিড়ে ফেলতে পারে, নাগরিক আইন পাশ করতে পারে তারা আজ কেন পুঁজিপতিদের অনুরোধ করবে? আদেশ কেন করবে না?
নব্য – উদারপন্থার অন্যতম উপহার- শ্রেণী বিভাগ, জাত বিভাগ, ধর্ম বিভাগ। তাই আজ আমরা নির্বিকার চিত্তে বলতে পারি সোশাল ডিষ্টান্সিং বা সামাজিক দূরত্ব। একবারের জন্যেও ভাবলাম না শারীরিক দূরত্ব ও সামাজিক বন্ধন। ইংরেজিতে ফিজিক্যাল ডিষ্টান্সিং অ্যান্ড সোশাল বন্ডিং।
একেই বলে নব্য-উদারপন্থা আর এই পৃথিবীর ভাইরাসও আজ সেই নব্য-উদারপন্থাই অবলম্বন করেছে।
ওটা ২০০০ কোটি হবে – কেরালা সরকার তাই ঘোষণা করেছে। টাইপের ভুল হয়েছে। সেই জন্য দুঃখিত
চমৎকার লেখা। আজকের অতিমারি এবং নিওলিবারাল ইকোনমির যোগ খুব স্পষ্ট। কাউন্টার পাঞ্চ, মান্থলি রিভিউ সহ অনেকগুলো পত্রিকায় এ নিয়ে প্রবন্ধ বেরিয়েছে।
এ লেখাটিও খুব স্পষ্টবাক। অভিনন্দন আমার অচেনা ভাইকে।
ধন্যবাদ
খুব খুব ভালো লেখা। ছাত্র সুলভ তেজ আছে লেখায়। তথ্যসূত্র দিলে ভালো হোত।
নিউ ইয়র্ক টাইমস, স্ক্রোল. ইন, ক্যারাভান, দ্যা হিন্দু