প্রতিটি নবজাতক প্রত্যেক পরিবারের কাছে অত্যান্ত মূল্যবান। হাসপাতালে বা নার্সিংহোম, যেখানেই শিশুর জন্ম হোক না কেন, সাধারণ অবস্থায় ৪/৫ দিনের মধ্যে সেখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তার পরে শিশুর পরিচর্যার প্রধান দায়িত্ব তার মায়ের বা বাড়ির লোকের। এই লেখায় আমরা আলোচনা করব, বাড়িতে এনে শিশুকে প্রথমে কি করবেন, কি কি দেখবেন।
প্রথমেই ঘরের মধ্যে যথেষ্ট আলোয় পরিষ্কার নরম বিছানায় শিশুকে খালি গায়ে শুইয়ে দেখে নিতে হবে তার কোন অসুবিধা আছে কি না। এক এক করে পরীক্ষা করতে হবে শিশুর ত্বক, তার মাথা, চোখ ইত্যাদি। এর আগের প্রতিবেদনে ত্বকের কথা বলেছি, এবার বলব মাথার কথা।
মাথা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বেশিরভাগ শিশু যখন জন্ম নেয়, তখন তার মাথা নীচের দিকে থাকে এবং মাথাই প্রথমে বের হয়। জন্মের সময় শিশুর মাথার হাড়, ত্বক সবকিছুই খুব নরম থাকে। মানুষের স্বাভাবিক জন্ম এক জটিল প্রক্রিয়া। শিশুকে অনেক সময় ধরে নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে বাইরের পৃথিবীর আলো দেখতে হয়। তার জন্মদ্বার তুলনামূলকভাবে অনেক সরু। তার মধ্যে দিয়ে শরীরকে ঘুরিয়ে পেচিয়ে বেঁকে তাকে জন্ম নিতে হয়। তাই অনেক সময় মাথায় চাপ পড়ে। আবার অনেক শিশু মাথা বের করার পরে শরীরকে আর বের করতে পারে না, সে ক্ষেত্রে তার মাথা টেনে শরীর বের করা হয়। তাকে ‘ফরসেপস ডেলিভারি’ বলে। সব ক্ষেত্রেই মাথায় আঘাত লাগার সম্ভাবনা থাকে। তাই মাথাকে ভালভাবে পরীক্ষা করতে হবে।
মাথায় কি কি দেখতে হবে?
১। ফরসেপের দাগ (Forceps marks)
শিশুর মাথা বের হবার পর যদি তার শরীরের অন্য অংশ বের হতে অসুবিধা হয়, তখন এক ধরণের সাঁড়াসি দিয়ে মাথা টেনে শিশুকে বের করা হয়। এই সাঁড়াসিকে বলে ফরসেপ। এটি বিশেষ ভাবে তৈরি, যাতে শিশুর কোনও ক্ষতি না হয়। এর একটা দিক লাগানো হয় শিশুর চোয়ালে, অন্যদিক থাকে ডাক্তারের হাতে। অনেক ক্ষেত্রেই তখন শিশুর নরম ত্বকে দাগ বসে যায়, লাল হয়ে যায়। তাই শিশুর থুত্নি বা চোয়ালেতে কোনও দাগ আছে কি না পরীক্ষা করতে হবে। চোয়ালে যদি দাগ থাকে, সেই দাগ কয়েকদিনের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। অনেক সময় মিলিয়ে যাওয়ার পরে সেখানে শক্ত গুটির মত হয়ে থাকতে পারে। কিছুদিনের মধ্যে তাও মিলিয়ে যায়। ভয়ের কোনও কারণ নেই। তবে বেশি অসুবিধা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সিজারের শিশুর ক্ষেত্রে এটি হয় না।
২। মাথা একপেশে হয়ে যাওয়া বা বেঁকে যাওয়া (Molding):
এই অবস্থাও সেই জটিল জন্ম প্রক্রিয়ার জন্যেই হয়। মানুষ বড় হলে তার মাথার হাড় শক্ত হয়, অনেকে মাথা দিয়ে বেল বা নারকেল ফাটান। কিন্তু জন্মের সময় সেই মাথার হাড় থাকে নরম। চাপ দিলেই বেঁকে যায়। জন্মের সময় তাই মাথা নানা রকমের চাপ খেয়ে কখনও এদিকে, কখনও ওদিকে বেঁকে যায়, আবার ঠিকও হয়ে যায়। কিন্তু অনেকক্ষণ যদি একই অবস্থায় থাকে, তখন শিশুর মাথার আকার অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। মাথা লম্বাটে অথবা একদিকে চ্যাপ্টা হয়ে যেতে পারে। শিশুকে ছুটি দিয়ে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার সময়ও ঠিক হয় না। দেখা যায় শিশুর মাথা একদিকে চ্যাপ্টা হয়ে আছে বা চেপে আছে, অথবা মাথা লম্বাটে হয়ে আছে। মা বাবারা চিন্তিত হয়ে যান।
তবে চিন্তার কিছু নেই। কয়েকদিনের মধ্যেই, সাধারণতঃ ৭-১০ দিনের মধ্যে মাথা স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসে। যাদের সিজার করে জন্ম হয়, তাদের এমনটি দেখা যায় না, কারণ তখন মাথায় কোন চাপ পড়ে না।
প্রসঙ্গতঃ বলি, শুধু জন্মের সময় নয়, তখন মাথা স্বাভাবিক থাকলেও বাড়িতে এনে শিশুকে সব সময় মায়ের এক দিকে শুইয়ে রাখলে শিশু দুধ পান করার সময় মায়ের দিকে ঘুরে থাকে, ফলে মাথার এক দিকে চাপ পড়ে- কিছুদিনের মধ্যে মাথার সেই দিকে চ্যাপ্টা হয়ে যায়। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলতে থাকলে, শিশুর হাড় শক্ত হয়ে গেলে মাথা ওই অবস্থায়ই থেকে যায়, বড় হলেও আর ঠিক হয় না। তাই সব সময় শিশুকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মায়ের ডান বা বাঁদিকে শোয়ানো উচিৎ। অনেক মা ই তাই সর্ষের বালিশ বানিয়ে দেন, যাতে মাথার অকার ঠিক থাকে।
৩। মাথা ফুলে যাওয়া (Caput)
জন্ম প্রক্রিয়ার সময় যদি দীর্ঘ সময় লাগে এবং শিশু মায়ের জরায়ুর কাছে এসে অনেকক্ষণ থাকে, তখন তার হাড়ে কোনও চাপ না লাগলেও মাথার নরম ত্বকে চাপ লাগে এবং সেখানে রক্তরস জমে যায়। তখন মাথা এক দিকে ফুলে যায় এবং এই অবস্থায়ই শিশুর জন্ম হয়। ত্বকে কলারস (tissue fluid) জমে যাওয়াই এর কারণ। এই ফুলে যাওয়া কোনও বড় কিছু নয়, এনিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কয়েকদিন পরেই আস্তে আস্তে ফোলা মিলিয়ে মাথা ঠিক হয়ে যায়। কোনও চিকিৎসার দরকার হয় না।
৪। মাথার ত্বকে রক্ত জমে যাওয়া (Cephalohematoma):
জানা দরকার, মাথার ত্বক অমাদের অন্য স্থানের ত্বকের থেকে কিছুটা আলাদা। এই ত্বকের মধ্যেই থেকে তৈরি হয় আমাদের মাথার চুল। আর এর নীচে বিশেষ কোনও পেশি বা চর্বি থাকে না। ফলে এই ত্বক তুলনামূলক ভাবে মোটা হয়। জন্মের সময় এই ত্বকের উপর অনেক চাপ পড়ে।
এই ত্বকের মধ্যে কলারস (tissue fluid) জমে গিয়ে সেই স্থান ফুলে থাকে- আমরা আগেই আলোচনা করেছি। কিন্তু অনেক সময় চাপ বেশি লাগলে বা যদি শিশুকে চাপ দিয়ে বের করার চেষ্টা হয়, তখন রক্ত জালক ছিঁড়ে গিয়ে সেই ফোলা স্থানে রক্ত জমা হয়। এই অবস্থাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে ‘কেফালোহেমাটোমা’। (Cephalohematoma). । রক্তের পরিমাণের উপর নির্ভর করে ফোলা বড় বা ছোট হতে পারে। এর নির্দিষ্ট আকার থাকে এবং ঠিক হতে সময় লাগে। রক্ত জমার ফলে ত্বকের উপর দিয়ে নীলচে রঙ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, জন্মের সময় শিশু ঠিক আছে, কিন্তু জন্মের পরে মাথা ফুলতে শুরু করেছে। অর্থাৎ, জন্মের সময় রক্ত জমা হয় নি, জন্মের পরে রক্ত জমতে শুরু করেছে। ত্বকের চাপে এক সময় রক্ত জমা বন্ধ হয় এবং ফোলাও নির্দিষ্ট আকার ধারণ করে।
সাধারণ ভাবে ২ সপ্তাহ থেকে ২ মাস সময় লাগতে পারে এই ফোলা কমতে। এর ভিতরের রক্ত আস্তে আস্তে শোষিত হয়ে গেলে ফোলা কমে যায়। প্রথমেই এর মাঝের অংশের রক্ত শোষিত হয়, ফলে প্রথমে শক্ত থাকলেও কয়েকদিন পরে ফোলার মাঝখানের অংশ নরম হয়ে যায় এবং গর্তের মত হয়ে যায়। তারপর সবটাই নরম হয়ে ফোলা ধীরে ধীরে কমে যায়।
এই রক্ত যখন শোষিত হয়, তখন শিশুর জন্ডিস দেখা দিতে পারে। আমরা আগের লেখায় আলোচনা করেছি, অনেক শিশুর জন্মের পরেই জন্ডিস হয়- যা দশ/বারো দিন পর্যন্ত থাকতে পারে, কিন্তু যাদের Cephalohematoma আছে, তাদের জন্ডিস বেশি হয় এবং দীর্ঘ সময় লাগে ঠিক হতে।
৫। মুখের অকৃতির অস্বাভাবিকতা (Facial asymmetry)
শিশু যখন মাতৃজঠরে থাকে, অর্থাৎ মায়ের ইউটেরাসে থাকে, তখন সে হাত-পা কুঁকড়ে বেঁকে থাকে, তার দুই কাঁধের মধ্যে থাকে তার মুখ। অনেক সময় কাঁধের হাড়ের চাপে মুখের আকৃতির পরিবর্তন হতে পারে। মুখের চোয়াল একদিকে বেঁকে যেতে পারে। মুখকে একপেশে দেখায়। তবে এই অবস্থা বরাবরের জন্যে থাকে না। কয়েকদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়। এ নিয়ে কোনও চিন্তার কারণ নেই।
এ ছাড়া অনেক সময় সিজারের শিশুর ক্ষেত্রে কোনও কাটা দাগ দেখা যেতে পারে, যা সিজার করার সময় কোনও কারণে হয়ে যেতে পারে।
অন্য কোনও অসুবিধা দেখলে বা এখানে যে বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করা হল, তা নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা হলে বা বাড়াবাড়ি হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
বাড়িতে এনে কোনও কিছু না দেখা গেলেও অবশ্যই একবার শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দিয়ে শিশুকে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। আর অন্য কোনও অস্বাভাবিকতা থাকলে অনভিজ্ঞ মায়ের নজর এড়িয়ে যেতে পারে কিন্তু অভিজ্ঞ চিকিৎসকের নজর এড়াবে না। তাই শিশুকে বাড়িতে এনে একবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করানো দরকার।