মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময়ে একবার এক সিনিয়র দাদার থিসিস নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। তিনি যত দিনে থিসিস লেখা শুরু করেছিলেন এবং তারপরে যত দিনে তাঁর গাইড সেটা শুধরে দিয়েছিলেন, তখন কোনও থিসিস টাইপিস্ট আর টাইপিং শুরু করতে রাজি হননি। তাঁদের বক্তব্য ছিল, এখন নতুন করে কাজ নিয়ে ডিউ ডেটের মধ্যে কাজ শেষ করে দিতে পারবেন এমন গ্যারান্টি নেই। স্বর্ণেন্দুদা হন্যে হয়ে ঘুরছে, সবাই চিন্তিত, তখন আমি একদিন বলেছিলাম, “এমনি করে তো এক সপ্তাহ কেটেই গেল। কেউ যদি টাইপিং শুরু করে দিত, তাহলে হয়ত সময়মত শেষও হয়ে যেত।”
হিন্দোল দাঁত খিঁচিয়ে বলেছিল, “বড়ো বড়ো কথা না বলে টাইপ করেই দাও না?”
আমি বলেছিলাম, “আমার টাইপ মেশিন থাকলে দিতাম বৈকি।”
এর ফল হয়েছিল এই, যে সেদিনই কলেজ থেকে ফেরার পথে হিন্দোলের বাড়ি থেকে টাইপ মেশিন তুলে নিয়ে এলাম। সারা সন্ধে টাইপ করলাম, স্বর্ণেন্দুদা আর হিন্দোল চোখ কপালে তুলে আমার ঝড়ের গতিতে টাইপ করা দেখল (ফিরবার পথে হিন্দোলকে বলেছিল, “ছোকরার স্পিড দেখে মনে হচ্ছে দু–সপ্তাহ পরে আজ রাত্তিরে ঘুমোতে পারব।”)। তার পরদিন থেকে ক্লাস শেষ করে এক ছুটে বাড়ি এসে আমি টাইপ করতে বসতাম।
দেখতে দেখতে মেডিক্যাল কলেজে রটে গেল, অনিরুদ্ধ স্বর্ণেন্দুদার থিসিস টাইপ করে দিচ্ছে। সবাই এসে নানা কথা বলতে শুরু করল: যদিও বেশিরভাগই সাধুবাদ বটে, কিছু অযাচিত পরামর্শ এবং ভয় দেখানোও চলত – “অ্যামেচার টাইপিস্ট, খেয়াল রেখো তোমার টাইপং–এর ফলে স্বর্ণেন্দুদা এম.ডি.-টা. যেন ফেল না করেন।” তারা সবাই বিশ্বাস করত যে পরীক্ষকরা পরীক্ষার্থীর থিসিস পড়ে দেখেন। বলা বাহুল্য – আমিও তখন বিশ্বাস করতাম।
একদিন ক্যান্টিন গেছি, দেখা হল দেবু–দার সঙ্গে। “কী রে দাড়ি, কেমন লাগছে থিসিস টাইপ করতে?”
বললাম, “দেবুদা, একটা ঘটনা ঘটছে, সেটা শুনে আর কেউ না হোক, তুমি মজা পাবে। এতদিন কলকাতার পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছি, কোনও দিন কোথাও আলাদা করে থিসিস টাইপিস্ট দেখিনি। স্বর্ণেন্দুদার থিসিস টাইপ করা শুরু করেই দেখছি সর্বত্র থিসিস টাইপিস্ট থিকথিক করছে। এই ধরো কলেজ স্ট্রীট থেকে আমহার্স্ট স্ট্রীট ভিতরের গলি দিয়ে হেঁটে যাও, দুটো দরজা পরে পরেই থিসিস টাইপ করনেওয়ালার সাইনবোর্ড। আগে কখনও চোখেই পড়েনি। এমনকি, ভাবতে পারো, সেদিন গ্রীক অরথোডকস চার্চের পিছনের গলিতে একটা দরজায় দেখি একটা বোর্ডে লেখা, এখানে থিসিস টাইপ করা হয়।”
শুনে দেবুদার মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেল। বলল, “এর থেকে কী প্রমাণ হয় বলত?”
বুঝলাম দেবুদার মাথায় কিছু একটা এসেছে, বললাম, “কী?”
দেবুদা বলল, “এর থেকে প্রমাণ হয়, পৃথিবীতে অনেক টাইপের লোক আছে।”
১৯৭৯ সাল। সবে স্কুল শেষ করেছি। একদিন পরিচিত একজন বললেন, “শোন, দূরদর্শনে একটা প্রোগ্রাম করবি?”
১৯৭৫ সালে কলকাতায় প্রথম টিভি দেখেছিলাম আমরা – টাইগার পতৌদীর নেতৃত্বে ক্লাইব লয়েডের ওয়েস্ট ইণ্ডিজ দলকে ভারতীয় দল হারিয়েছিল ইডেন গার্ডেনে – ভগবত চন্দ্রশেখর যা বোলিং করেছিল ভাবা যায় না – আর গুণ্ডাপা বিশ্বনাথের সেই অনবদ্য ১৩৯ – ওই স্কোয়ার কাটটা যা মেরেছিল, বলটা এখনও যাচ্ছে – থামেনি!
তখন দূরদর্শনে শুধু স্থানীয় অনুষ্ঠান হয়, সারা দেশে একই অনুষ্ঠান দেখা শুরু হয়নি।
“একটা কুইজ কনটেস্ট হবে বিশ্ব বন্যপ্রাণী সপ্তাহ উপলক্ষে। আমি কুইজ মাস্টার – তুই তোর তিনজন বন্ধু নিয়ে আসবি। একজন ছেলে, দু’জন মেয়ে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে – এমন দুটো টিম হবে। এমন কিছু প্রোগ্রাম নয়। শুধু লোকজনের অ্যাওয়ারনেস বাড়ানো আর কি।”
“বেশ, হবে। কিন্তু খুব কঠিন প্রশ্ন কোরো না।”
“আরে না, না, আম–পাবলিক দেখবে – খুব কঠিন করলে বাজে হবে।”
নির্দিষ্ট দিনে আম–পাবলিক অ্যাওয়ারনেস বাড়ানোর জন্য চান করে, চুল আঁচড়িয়ে পৌঁছেছি দূরদর্শন কেন্দ্রে – টালিগঞ্জে বাঙ্গুর হাসপাতালের পাশে। গেটে দারোয়ান বলল, “লাইভ প্রোগ্রাম? ওই দিকে যান, বলবেন – মেক–আপ রুম।”
পৌঁছলাম একটা বসার ঘরে। দুটো সোফা সেট রাখা রয়েছে – একজন ভদ্রলোক বসে আছেন, ভারিক্কে চেহারা… না, একেবারে রাশভারি। মোটা চুরুট খাচ্ছেন, আর এমন ভাব করছেন যেন তিনি ছাড়া ওই ঘরে কেউ নেই।
আমরা গল্প করছি, এমন সময়ে দরজা ঠেলে ঢুকলেন একজন ভদ্রলোক। বললেন, “মিঃ লাহিড়ী, মেক–আপ করতে মেক–আপ ম্যান এখানেই আসছে – আপনাকে যেতে হবে না।”
বজ্রগম্ভীর গলায় ভদ্রলোক বললেন, “হুঁ!”
বলতে না বলতেই ঢুকলেন আরেকজন। হাতে একটা টিফিন বাক্স টাইপের বাক্স। বললেন, “কার মেক–আপ?”
অন্যজন যিনি আগে ঢুকেছিলেন, বললেন, “এই যে! ইনিই মিঃ লাহিড়ী।”
মেক–আপ ম্যান মিঃ লাহিড়ীর সামনে দাঁড়ালেন। দুজনের মাঝখানে সোফা সেট–এর সঙ্গী নিচু সেন্টার টেবিল। হাতের ছোটো বাক্সটা নামিয়ে রাখলেন, তারপর ঘটাস করে জুতো পরা ডান পা তুলে দিলেন টেবিলে, ডান হাতের কনুই নিজের হাঁটুর ওপর রেখে ঝুঁকে পড়ে নিষ্পলক চেয়ে রইলেন মিঃ লাহিড়ীর মুখের দিকে, যেন কোনও আশ্চর্য সুন্দর চিত্রকলা দেখছেন।
চেয়েই আছেন, চেয়েই আছেন, মিঃ লাহিড়ী খানিকক্ষণ পরে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছেন, মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন। ওমনি মেক–আপ ম্যান হাত বাড়িয়ে থুতনি ধরে আবার মুখটা ঘুরিয়ে দিলেন নিজের দিকে।
আরও খানিকক্ষণ পরে বললেন, “হুম!” বাক্স খুলে একটা টিস্যু বার করে ঘষে ঘষে মিঃ লাহিড়ীর মুখটা আর মাথাটা মুছে দিলেন। তারপর একটা পাউডার পাফ বের করে শুকনো কিছু পাউডার লাগালেন ঘষে ঘষে। এই সময়ে মিঃ লাহিড়ী একটু আপত্তিসূচক শব্দ করাতে মেক–আপ ম্যান খ্যাঁক করে উঠলেন, “আঃ চুপ করে বসুন, পাউডার না দিলে স্টুডিয়োতে আলো পড়লে টাক এমন চকচক করবে যে মনে হবে যেন মাথায় সার্চলাইট লাগিয়ে বসে আছেন।”
লাহিড়ী চুপ করে বসে রইলেন; মুখে কাপড়, কাগজ, শিরিষ কাগজ ঘষা হলো – নানারকম রঙ লাগানো হলো, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগানো হলো (মেয়েরা আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল – ভাবখানা এই যে: তোমাদেরও হবে, দেখো) তারপর নিয়ে যাওয়া হলো ওই ঘর থেকে।
খানিক পরে আরেকজন এসে বললেন, “তোমরা লাইভ কুইজ? এসো।”
আমরা গেলাম মেক–আপ রুমে। এক সারি আয়নার সামনে আমাদের বসিয়ে চুল আঁচড়ানো, মুখ মোছা, লিপস্টিক লাগানো এসব করা হলো। আমরা একটুও আপত্তি করিনি তা নয়, কিন্তু বলা হলো, এইটুকু না করলে টিভিতে ঠোঁটগুলো কালো কালো লাগবে – তাই কিছু বললাম না। ও হ্যাঁ, একটা কথা বলা হয়নি: তখন টিভিতে রঙ দেখা যেত না, সাদা কালো ছিল।
যথাসময়ে পৌঁছলাম স্টুডিওর ভিতরে। এর আগে টিভি স্টুডিওতে কখনও ঢুকিনি। দেখে চক্ষু চড়কগাছ! এ আবার কী? একটা কোনায় আমাদের বসার জায়গা; আর একটা দেওয়ালের সামনে বসে আছেন তখনকার বিখ্যাত একজন সংবাদ–পাঠিকা – কিন্তু স্টুডিওর বাকিটা অন্ধকারে ঢাকা – দেখে মনে হচ্ছে গোডাউন – রাজ্যের কাঠের টুকরো, প্যাকিং বাক্স, বিভিন্ন রঙের ছোটো বড়ো প্যানেল চারিদিকে ছড়ানো।
সামনে মাইক রেখে ভয়েস টেস্ট করতে করতে খবরের সময় হয়ে গেল, সকলে আমাদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে চলে গেল। আমাদের দিকের আলো কমে এল, উজ্জ্বল আলো রইল শুধু সংবাদ পাঠিকার উপরে।
সংবাদের পরেই আমাদের কুইজ শুরু হবার কথা। কিন্তু খবর শেষ হবার পরে স্টুডিওর ভিতরের মনিটর টিভির ওপরে দেখলাম লেখা ভেসে উঠল: ‘পরবর্তী অনুষ্ঠান কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে’। একটা কাচের দেওয়ালের ওপার থেকে একজন হাত নেড়ে কিছু একটা ইশারা করলেন, আর ঘরের মধ্যে একজন ক্যামেরাম্যান একটা ক্যামেরা আমাদের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, “ফিলার ছবিগুলো নিয়ে আয়।”
দুটো অনুষ্ঠানের মধ্যে কোনও বাড়তি সময় থেকে গেলে তখন বিজ্ঞাপন বাদে যে ছবি দেখানো হয় তাকে ফিলার বলে, সুতরাং এর মানে এই হল যে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হতে আরও কিছু দেরি আছে।
অন্ধকার একটা কোনা থেকে একজন বেরিয়ে এসে বলল, “ফিলার কোথায়?”
“দেখ, ওইখানে কোথাও।”
লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, “কই?”
ততক্ষণে কাচের ওপার থেকে হাত–পা নাড়ার গতিবেগ বেড়ে গেছে!
লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে “একটা জিনিস যদি কেউ ঠিক জায়গায় রাখে” বলে খুঁজতে থাকল, আর ক্যামেরাম্যানও, “ওখানটা দেখ … ওই ব্যাগটা সরিয়ে দেখ…” বলে বলে নির্দেশ দিতে থাকলেন। শেষে একজন সিনিয়র মতন ভদ্রলোক ভিতরে ঢুকে ধমকের সুরে, “কী হচ্ছেটা কী? ফিলার কী হল?” বলামাত্র লোকটা দরজার পাশের একটা টুল থেকে কয়েকটা কার্ডবোর্ডের টুকরো তুলে নিয়ে বলল, “এই তো! একটা জিনিস যদি কেউ ঠিক জায়গায় রাখে …”
ক্যামেরার সামনে একটা কাঠের স্ট্যাণ্ড – মাথায় একটা কাঠের পাটা, ছ’ ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি মতন সাইজ। তার সঙ্গে একই সাইজের একটা কাঠের পাটা ইংরিজি ‘এল’–এর মতো করে লাগানো। লোকটা কার্ডবোর্ড–এর টুকরোগুলো এনে খাড়া করে ওই পিছনের কাঠের সঙ্গে হেলান দিয়ে সোজা করে দাঁড় করাল। আমরা বুঝলাম, যে ক্যামেরাটা চালু হলে ওই কার্ডবোর্ডের সঙ্গে সাঁটা ছবিটা ধরা পড়বে। খানিকক্ষণ পরে পরে সামনের কার্ডবোর্ডটা আঙ্গুল দিয়ে ঠেলে মুখ থুবড়ে ফেলে দিলেই পরের কার্ডবোর্ডের ছবিটা বেরিয়ে পড়বে।
প্রথম কার্ডবোর্ডটা কালো – ছবি নেই। ক্যামেরাম্যান ফোকাস ঠিক করে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ শুরু করো”, আর লোকটা প্রথম কার্ডবোর্ডটা আঙুল দিয়ে ফেলে দিল।
তখন অক্টোবর মাস, পুজো শেষ, কালীপুজো আসছে। তাই ফিলারের ছবিগুলো সব কালীপুজো নিয়ে। দূরদর্শনে এগুলো গত কয়েকদিন হলো রোজই দেখছি।
প্রথম ছবিটা অন্ধকার আকাশে আতসবাজি ফাটার। কালো ব্যাকগ্রাউণ্ডে সাদা সাদা আলোর ফুটকি। ক্যামেরাম্যান এক লহমা দেখেই বললেন, “উলটো।”
যে লোকটা ছবিগুলো রেখেছিল, সে বলল, “উলটো?”
সাউণ্ড ইঞ্জিনিয়ার, যিনি আমাদের ভয়েস টেস্ট করছিলেন, বললেন, “উলটো?”
অন্য ক্যামেরাম্যান বললেন, “উলটো?”
তিনটে উলটো শুনে ক্যামেরাম্যান রেগে গিয়ে বললেন, “বলছি উলটো, তো সবাই মিলে উলটো উলটো করার কী হয়েছে?”
সাবাই নিজের জায়গা ছেড়ে এসে ছবির সামনে দাঁড়ালেন (সামনে মানে একেবারে সামনে নয়, পাশ থেকে)। আমরাও স্টুডিওর ভিতরে নিঃশব্দ টিভিতে ছবি দেখছি। কালো ব্যাকগ্রাউণ্ডে সাদা ফুটকি – উলটো আবার কী?
ক্যামেরাম্যান আবার বললেন, “ছবিটা উলটো – ওপরটা নিচে, নিচেটা ওপরে।”
“কী করে বুঝলি?” কে জানতে চাইল।
“রোজ দেখাচ্ছি ছবিটা, দেখে বুঝব না?”
“কী জানি বাপু।”
“চেঞ্জ কর, চেঞ্জ কর।”
লোকটা ছুটে গিয়ে ছবিটা ফেলে দিতেই পিছনের ছবিটা বেরিয়ে এল। একটা চরকি।
“এটাও উলটো”, বললেন, ক্যামেরাম্যান। “গোছাটাই উলটে রেখেছিস।”
“কিন্তু অসুবিধা কী?” বললেন কে একজন “এই ছবির তো সোজা উলটো নেই।”
“নেই বুঝি?” একটু হেসে বললেন ক্যামেরাম্যান, “বেশ তাই নয় হলো।”
ছবি দেখানো চলল। পটকা, ফুলঝুরি, আতসবাজির ছবি শেষ করে দেখা গেল একটা তুবড়ি।
উলটো। এবার আর বলতে হল না। সব্বাই দেখতে পেল। উলটো।
তারপরের ছবিটা কয়েকটা বাচ্চা ফুলঝুরি নিয়ে খেলছে। ফুলঝুরিগুলো উজ্জ্বল, কিন্তু তাদের পিছনে ছায়া ছায়া মানুষের চেহারাগুলো উলটো। তারপরের ছবিতে কেউ ফুলঝুরি দিয়ে ‘শুভ দীপাবলী’ লিখেছে – উলটো। তার পরেরটা একটা প্যাণ্ডেলে আলোর রোশনাই – সেও উলটো। বাইরের সেই ভদ্রলোক আবার ঢুকে পড়েছেন, যে ছবিগুলো দেখামাত্র বোঝা যাচ্ছে উলটো, সেগুলো সামনে আসতেই “চেঞ্জ – চেঞ্জ” করে চেঁচাতে লাগছেন। প্যাণ্ডেলের ছবি আসতেও “চেঞ্জ – চেঞ্জ” শুরু করলেন, আর লোকটাও পট্ করে ছবিটা ফেলল, আর শেষ কার্ডবোর্ডটা বেরিয়ে এল।
অনেক বছর পরে – তিরিশ বছরেরও পরে – সেদিন দূরদর্শনে আবার ডাক পড়ল। নামী স্কুলের একটি ছেলে আত্মঘাতী হবার কিছুদিন পরে ছেলেটির বাবা পুলিশের কাছে নালিশ করেছেন, যে প্রধান শিক্ষকের বেত্রাঘাতের কারণেই এই আত্মহনন। বাঙালী, তথা ভারতীয়, স্বভাব অনুযায়ী সবাই হাহাকার করা শুরু করেছেন, গেল–গেল রবে চারিদিক সচকিত – কিন্তু এ–ও বোঝা যাচ্ছে, যে আসলে কারোই মাথাব্যথা নেই – এ হেন সময়ে দূরদর্শন থেকে টেলিফোন।
“আমি ওমুক স্যার, আমি দূরদর্শনে ‘প্রোডুসার’। আমাদের একটা অনুষ্ঠানে আর কী, আপনি যদি একটু আসেন, আমরা ইস্কুলে কর্পোরাল পানিশমেন্ট নিয়ে করব। আর থাকবেন ডায়মণ্ড হারবারের ওদিকে এক ইস্কুলের হেড স্যার আর কলকাতার এক ইস্কুলের অঙ্ক দিদিমণি। আমাদের লাইভ ফোন–ইন প্রোগ্রাম, দর্শকরা ফোন করবেন, আর এ–ছাড়া দুটো রেকর্ডিং – আমরা ইস্কুলের বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা বলেছে যে শাস্তি পেতে তাদের ভালোই লাগে – তাদের হোমওয়ার্ক করতে সুবিধা হয়।”
আমি অবাক! একবার ভাবলাম, যাব না। তারপরে মনে হল, দূরদর্শন যদি দুজন স্কুল শিক্ষককে দিয়ে ‘শাস্তি ভালো’ বলানোর চেষ্টা করে তাহলে নিশ্চয়ই আমার ওখানে গিয়ে অন্য কথা বলা উচিত।
বললাম, “নিশ্চয়ই যাব।”
শনিবার দুপুরের অনুষ্ঠান – বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় ফোন। সেই ‘প্রোডুসার’। বললেন, “স্যার, আপনাকে আজ একবার আসতে হবে।”
আবদার! বললাম, “আজ কেন? অনুষ্ঠান তো শনিবার।”
“একটা কনট্রাক্ট সই করার আছে যে।”
বললাম, “কী কনট্রাক্ট? সেটা কি দিনেরটা দিনে করা যায় না?”
“না স্যার,” ওপার থেকে আর্তনাদ ভেসে এল। “কাল দুপুর বারোটার মধ্যে কনট্র্যাক্ট জমা না দিলে আপনার চেকটা শনিবারের মধ্যে তৈরি করা যাবে না – আবার আপনাকে আরেকদিন আসতে হবে। নইলে ডাকে পাঠালে হারিয়ে যাবে।”
সে বলে আর কথা, এক সরকারি সংস্থা অন্য এক সরকারি সংস্থাকে কতই বিশ্বাস করে!
“আর তাছাড়া,” বলে চললেন তিনি, “অনুষ্ঠানের আগে আপনার উচিত সঞ্চালকের সঙ্গে কথা বলা, সেজন্যও তো আপনার আসা উচিত।“
বললাম, “দেখুন আমি এখন শহরের অন্য প্রান্তে। দূরদর্শন কেন্দ্র থেকে অন্তত তিরিশ কিলোমিটার দূরে। আর আপনি যদি মনে করেন যে আমার কোনও কাজ নেই, আপনি ‘আয়’ বললেই আমি পৌঁছে যাব, তাহলে কিন্তু ভুল করছেন।”
সঙ্গে সঙ্গে সুর পালটে গেল।
“না, না, তা নয়, আসলে উনিই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন। আপনি সই করবার জন্য কাল আসতে পারবেন?”
“কাল হলে সকাল সাড়ে আটটা থেকে ন’টা, নয়ত সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে। কখন হলে আপনার সুবিধে হবে?”
“সাড়ে দশটা?” চিন্তান্বিত গলা শুনলাম।
বললাম, “আমি সাড়ে দশটা নাগাদ গলফ গ্রীনের কাছে একটা হাসপাতালে থাকব। কিন্তু এগারোটায় আমাকে ক্লিনিকে পৌঁছতেই হবে।“
“সাড়ে এগারোটাতে আসতে পারবেন?”
দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, “বললাম তো, আমি এগারোটা থেকে আমার কাজের জায়গায় থাকব, এরপর আমি চারটে নাগাদ আসতে পারব।”
“না, না, আপনি সাড়ে দশটাতেই আসুন।”
সাড়ে দশটায় পৌঁছে ‘প্রোডুসার’–কে ফোন করলাম, উনি বললেন, “আপনি সোজা ভিতরে চলে আসুন, আমি নামছি নিচে।”
গেলাম ভিতরে। বিশাল জমি, তার ওপারে বিশাল বাড়ি। আন্দাজে ভর করে এগোলাম, একটুখানি এগোতেই দেখি একটা দরজা দিয়ে হস্তদন্ত একজন বেরোলেন; আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, “আসুন। আমি ওমুক – ‘প্রোডুসার’।”
গেলেন আমাকে নিয়ে তিনতলায়। টেবিল জোড়া একটা রেজিস্টার বের করলেন। পাতা উলটে উলটে আমার নাম খুঁজলেন: “অনিরুদ্ধ দেব, অনিরুদ্ধ দেব… হ্যাঁ, এই তো। এই যে, এইখানে আপনি সই করুন।” খাতাটা আমার সামনে ধরে বললেন, “দেখুন আপনার আগে কতজন সই করেছেন – এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট… এরপর আপনি সই করবেন, তারপরে আরও অন্তত চারজনের সই হলে তবেই চেক তৈরি হবে। ভাবতে পারেন আমাদের খাটনিটা? এই যে আপনি যে সাড়ে এগারোটাতে না এসে এখন এলেন, আমাকে কিন্তু একটা মিটিং ছেড়ে উঠে আসতে হল।”
চিড়বিড়িয়ে উঠতে যাচ্ছি, উনি বলতে থাকলেন, “আর জামা – এই জামা কিন্তু এক্কেবারে চলবে না, কোনও স্ট্রাইপ না, চেক না, সাদা তো নয়ই – ডার্ক রং পরলে সব চেয়ে ভালো হয়।”
“কালো?” জানতে চাইলাম।
“হ্যাঁ, কালো চলবে – ডার্ক ব্লু কিংবা ডার্ক গ্রীন পরতে পারেন।”
পরদিন, তিনটের অনুষ্ঠানের জন্য নির্দেশমতো দু’টোর সময়ে পৌঁছলাম দূরদর্শন কেন্দ্রে। একটা গেটের গায়ে লেখা: ‘বিনা অনুমতিতে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ’। গার্ড ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি সি.আই.এস.এফ.-এর বন্দুকধারী জওয়ান আমার দিকে তাকাচ্ছেই না। মনে হল, আমি আমন্ত্রিত না অবাঞ্ছিত সেটা তিনি জানলেন কী করে?
ফোন করলাম ‘প্রোডুসার’–কে। তিনি বললেন, “এসে গেছেন? স্টুডিওতে চলে যান, মেক–আপ রুমে। ওখানে আপনার সঞ্চালক আর অন্য প্যানেলিস্ট অপেক্ষা করছেন। আমিও আসছি।”
চতুর্দিক শুনশান। কাউকে দেখা যায় না। ঢুকে দেখি ডাইনে–বাঁয়ে লম্বা লম্বা করিডোর – সব ফাঁকা। খানিকটা এদিক ওদিক ঘুরলাম, বিশাল বাড়িতে জনমানুষ নেই। রূপকথার গল্পের দানবের পুরী। আমি যদি সন্ত্রাসবাদী হতাম, মনের আনন্দে সর্বত্র আর.ডি.এক্স রেখে চলে যেতে পারতাম, কেউ বুঝতও না।
বেরোলাম, দূরে পার্ক করা গাড়ির সামনে দুজন। গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “স্টুডিও কোথায়?”
যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিলাম, তার পাশের একটা দরজা দেখিয়ে দিলেন। আবার ঢুকলাম, আবার একই অবস্থা: কেউ কোত্থাও নেই। খানিকটা এধার ওধার হেঁটে দেখি একটা ডেস্কের সামনে একজন বসে ঢুলছেন, আমি কাছে যেতে এক চোখ মেলে বললেন, “মেক–আপ রুম যান।”
এমন অন্তর্যামীর পাল্লায় পড়ব ভাবিনি, বললাম, “কোনদিকে?”
হাত তুলে বললেন, “ডানদিকে, তারপর সোজা গিয়েই বাঁদিকে সোজা।”
বলে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
আমি অনির্দিষ্ট পথে চলতে চলতে দরজার পর দরজা পার করছি যেন সারিয়ালিস্ট ছবির স্বপ্ন। শেষে, পেলাম একটা দরজা – গায়ে কাগজ সেঁটে লেখা আছে, মেক–আপ রুম। দরজার ওপারে আর একটা করিডোরের শেষে আরেকটা দরজায় হলদে–হয়ে–যাওয়া আধখোলা কাগজে আবার লেখা : ‘মেক–আপ রুম’। এবার নিঃসন্দেহে মেক–আপ রুম: সেই পরিচিত দেওয়ালে লাগানো লম্বা টেবিল, দেওয়ালে সাঁটা আয়নার তিন দিকে বড়ো বড়ো আলোর ডুম। চেয়ারগুলো চারিদিকে ছড়ানো, কোনওটার ওপর আধখোলা ব্যাগ – চারিদিকে খালি সিগারেটের প্যাকেট। মানুষ নেই।
ঘরটার শেষে বন্ধ দরজার গায়ে কাগজ সেঁটে লেখা: ‘দরজা সব সময় বন্ধ রাখুন’।
বন্ধ দরজা ঠেললাম। আরও একটা মেক–আপ রুম। এটাতে প্রাণের সাড়া মিলল। বিশাল ঘরের দূরের দেওয়ালে ছ–টা আয়না। প্রত্যেকটার পাশে আর ওপরে মিলিয়ে পাঁচটা করে ২০০ ওয়াটের ডুম। তিরিশটা বাল্ব জ্বলে রয়েছে। ঘোঁ–ঘোঁ শব্দে তিনটে এ. সি. মেশিন চলা সত্ত্বেও ঘরটা ঠিক ঠান্ডা নয়। চলনসই।
মাত্র একটা আয়নার সামনেই একজন বসে নিজের প্রতিবিম্ব নিরীক্ষণ করছেন, আরেকজন মেক–আপ ম্যান তাঁকে সাজাচ্ছেন। ঘরের অন্য দিকের দেওয়াল ধরে প্রচুর সোফা, তার মধ্যে একটিতে একজন বসে আছেন, আমাকে ঢুকতে দেখে একগাল হেসে, “বসুন বসুন”, বলে হাতের চেটো দিয়ে নিজের পাশের জায়গাটা চাপড়ালেন।
বসে জিজ্ঞেস করতে যাব, “আমি অনিরুদ্ধ দেব। আপনিই কি সঞ্চালক ওমুক চন্দ্র ওমুক?” কিন্তু আমি বসা মাত্র উনি আমার থেকে নজর সরিয়ে নিয়ে মেক–আপ ম্যানকে বললেন, “টিকিটা খাড়া করে দাও।”
মেক–আপ ম্যান সামনে–বসা অভিনেতার পরচুলার ঝুঁটি ধরে একটা রবার ব্যাণ্ড পাকিয়ে জড়িয়ে দিলেন। কিন্তু সেটা ছাড়া মাত্র লটকে পড়ল।
“স্প্রে দাও,” বললেন আমার পাশে বসা ভদ্রলোক।
স্প্রে দেওয়া হল, টিপে টিপে শক্ত করা হল টিকিটাকে। এবার ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শক্ত চুলের ঝুঁটিটা সবটাই শুয়ে পড়ল। মেক–আপ ম্যান একটা ঝাঁটার কাঠি ভেঙে সেটাকে গুঁজে গুঁজে ঢোকালেন চুলের গুচ্ছের মধ্যে। এইবার আধখানা টিকি খাড়া হয়ে রইল। সবাই খুব খুশি – অভিনেতা চলে গেলেন, মেক–আপ ম্যান ঘরের দূর প্রান্তে গিয়ে একটা তিনতলা টিফিন ক্যারিয়ার খুলে সাজিয়ে বসে, ভাত, ডাল, মাছের ঝোল খেতে লাগলেন, আর অন্য ভদ্রলোক পা ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করলেন।
আমি কী করব ভাবছি, এমন সময়ে দরজা খুলল। ঢুকলেন কটকটে হলদে আর লাল বাটিকের নক্সা কাটা শার্ট পরা এক ভদ্রলোক, সঙ্গে একজন বয়স্ক মহিলা। ভদ্রলোক একবার আমার দিকে তাকালেন তারপর আমার পাশে বসা ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন, তারপর গটগট করে ঘরের একেবারে ভিতরে গিয়ে ভোজনরত মেক–আপ ম্যানকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি ডাঃ অনিরুদ্ধ দেব?”
বেচারা মেক–আপ ম্যান তখন সবে মাছের ঝোল মাখা ভাত এক গরস মুখে দিয়েছেন। এরকম প্রশ্নে তিনি একেবারে ঘাবড়ে গিয়ে মুখ থেকে হাত নামাবার আগেই মাথা নেড়ে এবং ম্–ম্–ম্ শব্দ করে জানালেন, যে তিনি না। এবার হলুদ শার্ট অসহায়ভাবে ফিরে আমাদের দিকে তাকালেন। ঘরে তিনজন উপস্থিত, তার মধ্যে তিনি যাঁকে মনে করেছেন ডাঃ দেব তিনি ফলস হয়ে গেলেন, এবার বাকি দু’জনের মধ্যে কাকে জিজ্ঞেস করবেন, স্বাভাবিকভাবেই সে সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও কঠিন হয়ে গেল, এমন সময়ে ঘুমন্ত ভদ্রলোক উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেক–আপের সরঞ্জাম গোছাতে শুরু করে ব্যাপারটা আরো কঠিন করে দিলেন।
ততক্ষণে আমিও উঠে দাঁড়িয়েছি, হলুদ শার্ট আমার দিকে তাকালেন, আমি বললাম, “আমি অনিরুদ্ধ দেব।”
ভদ্রলোক অমায়িক হেসে এগিয়ে এসে বললেন, “আমি ওমুক চন্দ্র ওমুক, ওমুক স্কুলের হেডমাস্টার, অনুষ্ঠানের অ্যাঙ্কর, আর ইনি হলেন তমুকদি, তমুক স্কুলের অঙ্কশিক্ষিকা।”
নমস্কার বিনিময়ের পরে আবার সোফায় বসলাম, একদিকে আমি, একদিকে অঙ্ক শিক্ষিকা, আর মাঝখানে সঞ্চালক। সঞ্চালক একটা প্যাড খুলে আমাকে বললেন, “আমরা কী ভাবে এগোব বলি – অনুষ্ঠান শুরু হবার পর আমি প্রথম প্রশ্ন করব দিদিকে, শিক্ষিকা হিসেবে – এইটা। আর তারপরে আপনাকে, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে এইটা, তারপরে একটা প্রশ্ন দিদিকে, একটা আপনাকে, এমনভাবে এগোব, মাঝে–মাঝে একটা–দুটো ফোন নিয়ে নেব।”
আমি বললাম, “কিন্তু আমি যে শুনলাম কিছু রেকর্ডিং আছে, যেখানে স্কুলের বাচ্চারা বলছে যে তাদের শাস্তি পেতে ভালো লাগে: সেগুলো দেখানো হবার পর সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত নয় কি?”
সঞ্চালক উত্তেজিত হয়ে বললেন, “নিশ্চয়ই। যেমন সেগুলো দেখাবে আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করব। আপনি কিন্তু ওই কথাটা বলতে ভুলবেন না, যেটা আমাকে টেলিফোনে বলেছিলেন: ডিসিপ্লিন করতে গেলেই শাস্তির প্রয়োজন, এটা ভুল কথা।”
আমি সঞ্চালকের সঙ্গে কথা বলছি, আর অঙ্ক শিক্ষিকা তাঁর ওদিকে বসে কী একটা খাতা নিয়ে মন দিয়ে পড়ে চলেছেন: অঙ্কের হোমওয়ার্কের মতো দেখাচ্ছে না, কিন্তু আমি বুঝতেই পারছি না কী ওটা। হঠাৎ কথার মাঝখানে বললেন, “আমাকে যে ২ নং প্রশ্নটা করবেন, সেটা কী?”
সঞ্চালক বললেন, “আপনাকে ২নং মানে আমার ৩নং প্রশ্ন… এই যে, এইটা।”
ভদ্রমহিলা প্রশ্নটা পড়ে নিয়ে নিজের খাতাটা সঞ্চালককে দিয়ে বললেন, “আমি যদি তার উত্তরে এটা বলি, তাহলে ঠিক আছে?”
সঞ্চালক খাতাটা হাতে নেবার পর আমি দেখলাম তাতে ১, ২ করে সব প্রশ্নের উত্তর লেখা আছে। ২নং উত্তর পড়ে সঞ্চালক খাতা ফেরত দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে,” আর ভদ্রমহিলাও আবার দুলে–দুলে খাতা মুখস্ত করতে লাগলেন।
আমি বিড়বিড় করে বললাম, “হায় হতোস্মি!” কেউ শুনতে পেল না।
এমন সময়ে ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলেন ‘প্রোডুসার’, আমাদের দেখে বললেন, “আপনাদের কথা শেষ হয়েছে?” আমরা বললাম, “হ্যাঁ”। একে একে সঞ্চালক, অঙ্ক শিক্ষিকা আর আমাকে গিয়ে বসতে হল আয়নার সামনে, সেখানে চুল আঁচড়ানো হল, মুখে পাউডার লাগানো হল, একটা ছোট্ট, প্রায় এক পোয়া ইঞ্চি চিরুনি দিয়ে ভুরু আঁচড়ানো হল, এবার লিপস্টিক লাগানো হল না বোধহয় রঙিন টিভি বলেই। মেক–আপ শেষ করে আবার সবাই দরজায় দাঁড়িয়ে এটা–সেটা গল্প করছেন, আমি ‘প্রোডুসার’কে বললাম, “তিনটের সময় প্রোগ্রাম না?”
‘প্রোডুসার’ বললেন, “হ্যাঁ, তিনটে।” বলে আবার গল্পে মন দিলেন। আমি আবার বাধা দিয়ে বললাম, “এখন তো দুটো পঞ্চান্ন – স্টুডিওতে ঢুকব কখন?”
বলা মাত্র সবাই ঘড়ি দেখলেন – ‘প্রোডুসার’ বললেন, এই দেখুন, কী কাণ্ড! চলুন! চলুন! চলুন!” বলে এদিক ওদিক দৌড়োদৌড়ি শুরু করলেন, সঞ্চালকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ও হ্যাঁ, টেপটা পাওয়া গেছে।”
সঞ্চালক বললেন, “কোথায় ছিল?”
‘প্রোডুসার’ বললেন, “আরে উলটো করে ঢোকানো ছিল কেস–এ। তাই কী লেখা আছে দেখা যাচ্ছিল না। আর কভারে তো অন্য কিছু লেখা, তাই…” বলে ছুটে চলে গেলেন স্টুডিওর দিকে।
আমি সঞ্চালকের পাশে হাঁটছিলাম, বললাম, “কিসের টেপ পাওয়া যাচ্ছিল না?”
সঞ্চালক নির্বিকারভাবে বললেন, ‘ওই যে, স্কুলের বাচ্চাদের ইন্টার্ভিউ করে টেপ হয়েছিল না? সেই টেপগুলো কোথায় রেখেছিলেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না।”
আমরা স্টুডিওতে ঢুকলাম। ‘প্রোডুসার’ আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন – আমি ওঁর ঠিক পেছনে। ঘুরে তাকিয়ে আমাকে বললেন, “ডা. দেব, আপনি ওই কোনার চেয়ারটায় বসুন।” বলে আবার আমাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন, “কিন্তু আপনি তো ডার্ক রঙের জামা পরে আছেন!”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “আপনিই তো আমাকে বললেন ডার্ক রঙের জামা পরতে।”
“কিন্তু আপনি তো এখন দেখতে পাচ্ছেন ব্যাকগ্রাউন্ডটা কালো!” ওঁর গলা চড়ে গিয়ে কেঁপে উঠল। চোখে বোধহয় জল।
এমন অবস্থায় কী করা উচিত বুঝতে না পেরে আমি ফ্লোরের মাঝখানটাতেই দাঁড়িয়ে সবে দাঁত খিঁচিয়ে বলতে গেছি, “তাহলে জামাটা খুলে গেঞ্জি পরেই বসি?” এমন সময় আমার ডানদিক থেকে গম্ভীর গলায় কে বলে উঠলেন, “আজ সকাল ন’টায় প্রধানমন্ত্রী শ্রী মনমোহন সিং দিল্লি বিমানবন্দরের তৃতীয় আন্তর্জাতিক টার্মিনালটির উদ্বোধন করলেন…”
আঁতকে উঠে তাকিয়ে দেখি একটা ক্যামেরার ওপারে একজন টাই–পরিহিত ব্যক্তি খবর পড়ছেন। আমার ডার্ক রঙের শার্টের খবর সারা পশ্চিমবঙ্গে সবাই জেনে ফেললেন ভেবে আতঙ্কিত হয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম, কিন্তু দেখলাম সংবাদ পাঠক কেন, ফ্লোরের কেউই তা নিয়ে চিন্তিত নয়। এমনকি একজন কে সশব্দে হেঁকে বললেন, “না, না। চিন্তা নেই। আপনি বসুন, আমি ব্যাকগ্রাউন্ডটা বদলে দিচ্ছি।” বলে দুমদাম শব্দে একটা গোলাপি কার্ডবোর্ড এনে আমার পিছনের কালোটা ঢেকে দিলেন। আমি চেয়ারে বসে শুনলাম সংবাদ পাঠক আবার পড়তে শুরু করেছেন, “আজ সকাল ন’টায় প্রধানমন্ত্রী শ্রী মনমোহন সিং দিল্লি বিমানবন্দরের তৃতীয় আন্তর্জাতিক টার্মিনালটির উদ্বোধন করলেন…” স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। রিহার্সাল চলছে।
চেয়ারে বসামাত্র ‘প্রোডুসার’ এসে একটা করে কলার মাইক হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “লাগিয়ে নিন, দেখতেই তো পাচ্ছেন, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারদের টিকির দেখা নেই। দেখুন, তারটা আবার যেন জামার সামনে না ঝোলে… জামার ভিতর দিয়ে টেনে আনুন। দিদি (অঙ্কের শিক্ষিকাকে) আপনি আঁচলের আড়াল দিয়ে নিয়ে যান… দাঁড়ান, আমি করে দিচ্ছি…”
এ সব চলছে, আর আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছি কাঁটা প্রায় তিনটে ছুঁইছুঁই। তাতে অবশ্য দূরদর্শনের কারও কোনও হেলদোল নেই। এমন সময়ে দড়াম করে স্টুডিওর দরজা খুলে ঢুকলেন একজন – মুখে একরাশ বিরক্তি। বললেন, “আব্ লাইব্ হ্যায় ক্যা?”
আমাদের ‘প্রোডুসার’ বললেন, “আরে, আপলোগকা কোনও পাত্তাই নেহি হ্যায়! সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার নেহি রহনে সে কি হাম কলার মাইক লাগায়গা?”
‘প্রোডুসার’–এর দিকে তাকালেনও না সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। আবার জিজ্ঞেস করলেন, “আব্ লাইব্ হ্যায় ক্যা?”
একটা চেয়ারে একজন বসেছিলেন কানে ইয়াব্বড়ো হেডফোন লাগিয়ে – আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, এখন লাইভ প্রোগ্রাম।”
হিন্দিভাষী আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, “কোন বোলা? কোন বোলা? কোই বোলা কি ইসকা বাদ লাইব্ প্রোগ্রাম হ্যায়?”
নির্বিকারভাবে সামনে রাখা একটা ফাইল দেখালেন হেডফোন। ‘নিজেই দেখে নাও’ গোছের হাবভাব।
হিন্দিভাষী একটু থতমত খেলেন। বললেন, “আরে, ও ম্যায়নে দেখা। ম্যায় পুছ রহা হুঁ কি ইনকে বাদ কোই লাইব্ হ্যায় ক্যা?” বলে আমাদের দেখালেন।
মাথা নেড়ে ‘না’ বললেন হেডফোন।
“হাঁ, ও হি ম্যায় পুছ রহা হুঁ না? ইয়ে লাইব্ হ্যায়, সো তো ম্যায় জানতা হি হুঁ,” বলে তিনি এসে আমাদের কলার মাইকগুলো খুলে খুলে আবার লাগিয়ে দিলেন।
মাইক লাগানো শেষ হতে না হতেই হেডফোন বিশাল হেঁকে বললেন, “স্ট্যান্ড বা–আ–আ–আ–আ–ই…” এবং স্টুডিওর সব আলো নিভে গিয়ে শুধু সংবাদ পাঠকের ওপর আলো রইল। আমরা নিঃশব্দ মনিটরে দেখলাম সংবাদ–শিরোনামের ছবি ফুটে উঠল, এবং তারপরে দেখলাম সংবাদ পাঠককে, তিনি বলতে শুরু করলেন, “আজ সকাল ন’টায় প্রধানমন্ত্রী শ্রী মনমোহন সিং দিল্লি বিমানবন্দরের তৃতীয় আন্তর্জাতিক টার্মিনালটির উদ্বোধন করলেন…”
শুধুই হেডলাইন, তাই দু’মিনিটেই খবর শেষ। তারপর আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হল। আধঘণ্টার অনুষ্ঠান, তাতে আবার দর্শকদের ফোন উত্তর করা হবে, ফলে একলাইন বলতে না বলতেই বাধা – নানা স্কুল শিক্ষক–শিক্ষিকারা ফোন করে জানতে চাইছেন, যদি শাস্তিই না দিলাম তাহলে ডিসিপ্লিন কোত্থেকে হবে? এই তালেগোলে মিনিট দশেক পরেই সঞ্চালক বললেন, “এই বিষয়ে স্কুল ছাত্র–ছাত্রীরা কী বলেন? আসুন দেখি…” বলতেই মনিটরে ভেসে উঠল মাইক হাতে এক দূরদর্শন–মার্কা দিদি একগোছা স্কুল–পড়ুয়াকে কী জিজ্ঞেস করছেন, আর মাইক বাড়িয়ে দিচ্ছেন তাদের মুখের সামনে।
আমরা কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। নির্বাক চলচ্চিত্র দেখছি।
সঞ্চালকের দিকে তাকিয়ে বললাম, “এ কী? আমরা তো কিছুই শুনতে পাচ্ছি না?” সঞ্চালক আমার দিকে ফিরে ঠোঁটে আঙুল দিলেন। ফিশ্–ফিশ্ করে বললেন, “সাউন্ড হয়ত কেউই শুনতে পাচ্ছে না – হয়ত আমাদের কথাই শোনা যাচ্ছে।”
হেডফোন খুব নিচু গলায় একটা মাইকে বললেন, “এখানে সাউন্ড দাও… আরে এখানে শোনা যাচ্ছে না… আরে, ওনারা বলছেন শুনতে চান কী বলা হচ্ছে… না, শোনা যাচ্ছে না… না, এখনও সাউন্ড নেই… না… না…”
এই ‘না, না, না, না,’–র ফাঁকে ক্লিপিংটা শেষ হয়ে গেল। সঞ্চালক বললেন, “স্ট্যান্ড–বাই,” এবং তারপরেই তাঁর মুখের ছবি ভেসে উঠল টিভিতে, এবং আগের ব্যাপারটার কোনোও উল্লেখ না করেই তিনি দিব্যি, “আচ্ছা, দিদি, আপনি শিক্ষিকা হিসেবে বলুন, যদি আপনার ক্লাসে কোনও ছাত্রী অমনোযোগী হয়, তাহলে আপনি কী ভাবে ব্যাপারটা সামলাবেন?”
আমি অবাক! একটু আগেই বাচ্চারা হয়ত বলে গেল, শাস্তি পেতে তাদের ভালোই লাগে – হোমওয়ার্ক করতে নাকি সুবিধে হয় – আর সঞ্চালক ব্যাপারটা একেবারে এড়িয়ে গেলেন? লোকে ভাবল আমরাও ব্যাপারটা মেনে নিচ্ছি?
কিন্তু অঙ্ক দিদিমণি প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করেছেন। আমার কিছু করার নেই। অনুষ্ঠান চলল, ফোন আসতে থাকল, আবার মিনিট দশেক পরে আর একটা ভিডিও দেখান হল – সেই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক – তিনিও নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে চলে গেলেন।
প্রহসনের এই পর্যায়ের পরে আমার পালা। সঞ্চালকের কোনও ভাববিকার নেই, “ডাক্তারবাবু, আমাদের অনুষ্ঠানের সময় প্রায় শেষ – আপনার কাছে আমার শেষ প্রশ্ন…” বলে পরের প্রশ্নে চলে গেলেন।
আমি বললাম, “আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে বলি, একটু আগে আমরা দুটো ভিডিও দেখলাম, যার একটাতে স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা আর অন্যটাতে কোনও স্কুলের অধ্যক্ষ বোধহয় শাস্তি পাওয়া এবং শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে কিছু বলেছেন। দর্শকরা হয়ত ভাবছেন আমরা কেন সে বিষয়ে কিছু বলছি না। আমার মনে হয় দর্শকের জানার অধিকার আছে, যে ওঁরা কী দেখেছেন বা শুনেছেন, আমি জানি না। কিন্তু এখানে বসে আমরা চার্লি চ্যাপলিনের নির্বাক সিনেমার মত কিছু একটা দেখেছি, কোনও কথাই শুনতে পাইনি। সুতরাং ওই দুটি ক্লিপিং সম্বন্ধে আমরা কিছু আলোচনাই করতে পারলাম না।”
এই বলে আমি সঞ্চালকের প্রশ্নের উত্তর দিতে যাব, সঞ্চালক আমার কথা কেটে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা কিছুই শুনতে পাইনি – আচ্ছা, আমরা এখন একটা টেলিফোন নিয়ে নিই,” বলে তিনি টেলিফোন নিলেন এবং তারপরই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল।
যেমনি শেষ হওয়া, ওমনি পাগলা ষাঁড়ে তাড়া করেছে এমনভাবে দরজা খুলে ঢুকলেন ‘প্রোডুসার’। প্রথমে বললেন, “খুব ভালো প্রোগ্গাম হয়েছে।” তারপরেই অঙ্ক–শিক্ষিকাকে, “আপনি শেষ প্রশ্নের উত্তরটা দেননি। কী চমৎকার প্রশ্ন ছিল – ডাক্তারবাবু বাঁচিয়ে দিলেন…” বলে আমার দিকে ঘুরে বললেন, “আপনার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই? অন–এয়ার বলে দিলেন অডিওটা শুনতে পাননি? সবাই শুনে ফেলল?”
আমার খুব রাগ হয়ে গেল। জোর দিয়ে বললাম, “বেশ করেছি বলেছি। আপনার লজ্জা করে না? একটা আধঘণ্টার প্রোগ্রামে দুটো তিরিশ সেকেন্ডের ক্লিপিং দেখাতে পারেন না ঠিক করে, আবার এসে চেঁচাচ্ছেন? এই আপনি ‘প্রোডুসার’? আমি ১৯৭৯ থেকে দূরদর্শনে প্রোগ্রাম করছি। তখন টালিগঞ্জে স্টুডিও ছিল। তখনও আপনাদের যতটা ক্যালাস, কেয়ারলেস, ল্যাকাডিজিকাল এবং আনপ্রফেশনাল দেখেছি, আজও ঠিক ততটাই ক্যালাস, কেয়ারলেস, ল্যাকাডিজিকাল এবং আনপ্রফেশনাল রয়েছেন, শুধু বড়ো বাড়ি পেয়ে গলার জোরটা বেড়েছে।”
আমার পর সঞ্চালক আর অঙ্ক শিক্ষিকা একই কথা বলতে লাগলেন। এমনকি হেডফোন, যিনি আমাদের সঙ্গেই বেরোচ্ছিলেন, তিনিও বললেন, “আমি তো কতবার বললাম, সাউন্ডটা দাও, ভেতরে সাউন্ডটা দাও – কিন্তু কে কার কথা শোনে – বলছে, ওনাদের শোনার কোনও দরকার নেই।”
আমি আবার বললাম, “আপনার এই আধঘণ্টার প্রোগ্রামের জন্য আমাকে আপনি দু–দু’বার উত্তর কলকাতা থেকে দূরদর্শন অবধি দৌড় করিয়েছেন। রেজিস্টার খুলে আটজনের সই দেখিয়ে আমাকে বুঝিয়েছেন আপনাকে কত কাজ করতে হয়। আপনার কি আপনার দিকটা সুষ্ঠুভাবে চালানোর দায়িত্ব ছিল না? সেটা না করে আপনি গেস্টের বিরদ্ধে নালিশ করছেন?”
‘প্রোডুসার’ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, “কোনও কথাই শোনে না আমার। আমি তো বলছি, সাউন্ডটা দাও, সাউন্ডটা দাও…”
দূররদর্শন কেন্দ্র থেকে বেরোবার সময় দেবুদার কথাটা আবার মনে পড়ল। ভাবলাম, অনেক টাইপের লোকের মধ্যে এই বিশেষ টাইপের সব লোক বোধহয় শুধু দূরদর্শনেই কাজ করে।