সম্প্রতি নোবেল কমিটি ঘোষণা করলেন এই বছরের ফিজিওলজি ও মেডিসিনের নোবেল প্রাপকদের নাম। পুরস্কার পেলেন হার্ভে অলটার, মাইকেল হটন, এবং চার্লস রাইস। হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আবিষ্কারের জন্য তাঁরা পেলেন এই সম্মান।
হেপাটাইটিস কথাটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘লিভার বা যকৃৎ’ আর ‘ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ’ -এই দুটি শব্দের সংমিশ্রণে। এই রোগের মূল লক্ষণ গুলো— ক্ষুধামান্দ্য, বমিভাব, ক্লান্তি এবং জন্ডিস। ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস সি যকৃৎ-এর পচন বা যকৃৎ ক্যান্সার ঘটায়।
এখন প্রশ্ন, কেন হয় এই হেপাটাইটিস? অত্যধিক মদ্যপান, পরিবেশজাত দূষণ, অটোইমিউন রোগ ছাড়াও হেপাটাইটিসের মূল কারণ কিন্তু ভাইরাস জনিত সংক্রমণ, যেটি আবার করোনা ভাইরাসের মতো একটি RNA ভাইরাস।
১৯৪০ এর দশকে, বিজ্ঞানীদের কাছে এটি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, প্রধানত দুই ধরণের হেপাটাইটিস রোগ রয়েছে। প্রথম ধরণের রোগটি দূষিত জল বা খাবারের মাধ্যমে সংক্রমিত হয় এবং রোগীর উপর সাধারণত স্বল্পমেয়াদী প্রভাব পড়ে। এর নাম দেওয়া হয় হেপাটাইটিস এ (HAV)।
দ্বিতীয় ধরণের রোগটির সংক্রমণ হয় রক্ত এবং শারীরিক তরলের মাধ্যমে। এই দ্বিতীয় প্রকারটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেহেতু এটি রোগীর দেহে বহুদিন অবধি নিঃশব্দে লুকিয়ে থেকে শেষমেশ সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের মতো দীর্ঘস্থায়ী ও গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর এই রক্তবাহিত হেপাটাইটিসে দশ লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ফলে, এইচআইভি বা যক্ষার মতই এই রোগটিও বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের আরেকটি কারণ ছিল।
যে কোনো সংক্রামক রোগের সফল প্রতিরোধের চাবিকাঠিটি লুকিয়ে থাকে রোগসৃষ্টিকারী অণুজীবটিকে সনাক্তকরণে।
১৯৬০ সাল নাগাদ, বারুচ ব্লুমবার্গ প্রথম
নির্ধারণ করলেন যে রক্তবাহিত হেপাটাইটিস রোগের একটি প্রকারের জন্য দায়ী এক ভাইরাস, যার নামকরণ করা হয় হেপাটাইটিস বি ভাইরাস (HBV)। ব্লুমবার্গের এই আবিষ্কার রোগটির ডায়াগনস্টিক টেস্ট এবং ভ্যাকসিনের বিকাশকে বাস্তবায়িত করে। এই আবিষ্কারের ফলস্বরূপ ব্লুমবার্গকে ১৯৭৬ সালে ফিজিওলজি ও মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
সেই সময়, হার্ভে অলটার নামে এক ভদ্রলোক
ইউ এস ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটস অব হেলথে
ব্লাড ট্রান্সফিউশানের বা অন্যের শরীর থেকে রক্তগ্রহণকারী রোগীদের মধ্যে হেপাটাইটিস হওয়ার প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। যদিও সদ্য আবিষ্কৃত হেপাটাইটিস বি এর টেস্ট করে রক্ত দিলে দেখা যাচ্ছিলো, রক্তগ্রহীতাদের মধ্যে হেপাটাইটিসের সংখ্যা অনেক কম হচ্ছে; কিন্তু অল্টার এবং তাঁর সহকারীরা লক্ষ্য করে দেখেন এর পরেও বিরাট একটা সংখ্যায় সংক্রমণ রয়েই যাচ্ছে।
ততোদিনে হেপাটাইটিস এ-র টেস্টকিটও বেরিয়ে গেছে এবং তাঁরা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন ঐ সমস্ত রোগীদের রক্তে হেপাটাইটিস-এ কিংবা -বি কোনও টারই অস্তিত্ব নেই।
মনে রাখতে হবে, তাদের শরীরেই এক অজানা কারণে এই দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিসের বিকাশ ঘটছে, যাদের শরীরে কখনো না কখনো রক্ত দিতে হয়েছে। অল্টার এবং তার সহকর্মীরা দেখালেন যে, এই হেপাটাইটিস রোগীদের রক্ত থেকে শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও রোগ সংক্রামিত হতে পারে। দীর্ঘ গবেষণায় তিনি প্রমাণ করলেন, এটি ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিসের একটা নতুন ও স্বতন্ত্র ফর্ম, যার নাম তিনি দিলেন “নন-A, নন-B হেপাটাইটিস” (NANBH) এবং সংক্রমণের কারণ নতুন একটি ভাইরাস।
স্বাভাবিক ভাবেই এর পরের ধাপে ভাইরাসটিকে সনাক্ত করাটা আশু প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অথচ, দশবছরের বেশি সময় চলে গেলেও এই অজানা ভাইরাসটিকে সনাক্ত করা গেল না।
১৯৮২ সালে, মাইকেল হাউটন একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ফার্মের হয়ে NANBH ভাইরাসটির জেনেটিক সিকুয়েন্স (genetic sequence)-এর উপর গবেষণামূলক কাজ শুরু করলেন। হাউটন এবং তাঁর সহকর্মীরা সংক্রামিত শিম্পাঞ্জির রক্তে পাওয়া ডিএনএ খণ্ডগুলির একটা সংগ্রহ (বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় cDNA library) তৈরি করেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন যে, খণ্ডগুলির বেশিরভাগই শিম্পাঞ্জির জিনোম থেকে এলেও তারই মধ্যে কিছু অংশ তাঁরা পাবেন যা অজানা ভাইরাস থেকে আসা। কিন্তু পরীক্ষার প্রাথমিক ফলাফলে সেই ভাবনার কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না।
হাউটন তখন আরও দুজন গবেষকের সহায়তায় আরেকটি নতুন উপায়ে স্ক্রিনিং শুরু করলেন। হেপাটাইটিস রোগীদের রক্তে ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি উপস্থিত আছে, এই ধারণা থেকে তিনি ভাইরাল প্রোটিন তৈরির প্রতিলিপি বহনকারী ভাইরাল ডিএনএ খণ্ডগুলিকে সনাক্ত করতে রোগীর সেরাকে ব্যবহার করলেন। এই পদ্ধতিতে প্রায় দশলক্ষ ক্লোনের মধ্য থেকে তাঁরা একটি পজিটিভ ক্লোন পেলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের বিস্তারিত গবেষণা থেকে জানা গেলো যে, ক্লোনটি ফ্ল্যাভি ভিরিডি পরিবারভুক্ত একটি নোভেল RNA ভাইরাস থেকে উদ্ভূত, যার নামকরণ করা হল হেপাটাইটিস সি ভাইরাস।
হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আবিষ্কার তো হল। তবুও, ধাঁধার একটি জরুরি অংশ অজানা রয়ে গেছিল — ভাইরাসটি কি একাই হেপাটাইটিস রোগ সৃষ্টি করবার জন্য যথেষ্ট? নাকি সাহায্য কারী অন্যান্য উপাদানও রয়েছে?
এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য এটা দেখা দরকার ছিল যে ক্লোন করা ভাইরাসটি সংখ্যা বৃদ্ধি করে রোগ তৈরি করতে পারে কিনা।
চার্লস এম রাইস তখন গবেষণা করছেন
সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের জিনোমের শেষপ্রান্তের একটি অজানা অঞ্চলকে ভাইরাল DNAএর সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে সন্দেহ করলেন। অতঃপর, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে রাইস হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের RNA জিনোম তৈরি করেছিলেন যাতে ঐ নতুন অঞ্চলটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই RNA টি শিম্পাঞ্জির যকৃতে ইনজেক্ট করার অব্যবহিত কাল পরে তার রক্তে ভাইরাসটির উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেল। এর পাশাপাশি, শিম্পাঞ্জির শরীরেও ঠিক সেই রকম রোগজনিত পরিবর্তনগুলি দেখা গেল যা দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস রোগাক্রান্ত মানুষের মধ্যে দেখা যায়।
চার্লস রাইসের গবেষণা লব্ধ ফলাফলটি থেকেই চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া গেলো যে, হেপাটাইটিস সি ভাইরাস একাই ঐ অজানা হেপাটাইটিস সংক্রমণটি ঘটাতে সক্ষম।
তাহলে, নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত এই আবিষ্কারটির তাৎপর্যটি ঠিক কোথায়?
হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের অাবিষ্কার ভাইরাসঘটিত রোগের বিরুদ্ধে মানুষের চিরন্তন লড়াইয়ে একটি অসামান্য সাফল্য। এই আবিষ্কারের ফলে ভাইরাসটির সনাক্তকরনের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী কিট তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের বিরুদ্ধে ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে।
প্রতিবছর প্রায় ৭.১ কোটি মানুষ এই ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হন। সঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে ৯৫% ক্ষেত্রেই রোগী সম্পূর্ণ সেরে ওঠেন। পৃথিবীর বহু দেশে এভাবে রক্তদান জনিত হেপাটাইটিস সি নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।
হেপাটাইটিস সি-র এই যুগান্তকারী আবিষ্কার
রোগটির সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে, যা আগামীতে পৃথিবীর বুক থেকে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস নির্মূল করার আশা বাড়িয়ে তুলেছে।
২০২০ এর এই করোনা অতিমারি-কালে আরেকটি RNA ভাইরাসের গবেষণায় নোবেল প্রাপ্তির চেয়ে প্রাসঙ্গিক বোধহয় আর কিছু হয় না। সমগ্র মানবজাতির পক্ষ থেকে তাই কুর্নিশ এই তিন বিজ্ঞানী ও তাঁদের সহকারীদের।
তথ্যসূত্র:
১.
https://www.nobelprize.org/prizes/medicine/2020/press-release/
২. https://www.nature.com/articles/d41586-020-02763-x