প্রথমে একটু পেট-ব্যথা, তারপর রক্ত-পায়খানা, সুনীল যখন শহীদ হাসপাতালে ভর্তি হল তখন ওর রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা শতকরা ৬.৪ গ্রাম।
রক্ত দিতে হবে। কোথা থেকে পাওয়া যাবে? ওর বাবা-মার রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করা হল। বাবার গ্রুপ মিলে গেল ছেলের সঙ্গে। একটু দ্বিধা ছিল বইকি বরমুর মনে, রক্ত দিলে নিজে না কমজোর হয়ে পড়ে, কিন্তু ছেলের প্রাণ বাঁচাতে রক্ত দিল ও।
আবার রক্ত পায়খানা, রক্ত-বমি। এবার রক্ত দিলেন সুনীলের বাবার সহকর্মী ইউনিয়ন-উপাধ্যক্ষ গণেশরাম। এরপর দুদিনে সুনীলের আরও দুবার রক্ত লেগেছে—একবার দিয়েছেন ইউনিয়নের সহ-সচিব হীরামন, অন্যবার সচিব ছবিলাল। কোনোবারই রক্তের প্রয়োজন দেখা দেবার পর পনেরো মিনিট-আধঘন্টার বেশী সময় লাগেনি রক্ত যোগাড় করতে। সুনীল তারপর সেরে ওঠে। না পুরোপুরি সেরে ওঠা নয়, সুনীল পোর্টাল হাইপারটেনশনের রোগী, কিন্তু তারপর রক্তাল্পতা সেরে যায়।
এরকমই কাহিনী শুনেছি আশীষদার কাছেও। তখনও শহীদ হাসপাতাল হয়নি। শৈবালদা কাজ করে মিশনারীদের পুষ্পা হাসপাতালে। শৈবালদার ডাকে আশীষদা এক রোগিনীর অপারেশন করে। মহিলার পেটের ভেতরে বাচ্চা মরে গেছিল, দল্লী-রাজহরার ডাক্তার মাথাই জরায়ুতে হাত ঢুকিয়ে যন্ত্র দিয়ে বাচ্চাটিকে টুকরো করে বার করতে যান, কেননা তাঁর প্রিএক্লাম্পসিয়া ছিল। এমনটা করতে গিয়ে জরায়ুতে আঘাত লেগে রক্তক্ষরণ হতে থাকে তাই অপারেশন করা। মহিলার শরীরে রক্ত কম ছিল, অপারেশন সেরে আশীষদাই তাঁকে রক্ত দেয় গ্রুপ মিলে যাওয়ায়। তাও আরও রক্ত দরকার। খবর পেয়ে নিয়োগীজীর আহ্বানে কয়েকশ’ শ্রমিক হাসপাতালের সামনে লাইন দেন রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করিয়ে রক্ত দেওয়ার লক্ষ্যে। রক্ত দিয়েও মহিলাকে বাঁচানো যায়নি অবশ্য।
শহীদ হাসপাতালের অভিনব ব্লাড ব্যাংক
আমি যখনকার কথা বলছি তখন শহীদ হাসপাতাল ১৫ বেডের এক ছোট্ট হাসপাতাল। বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত, তাই ছোট একটা ফ্রিজ থেকেও না থাকারই মতো। তাহলে রক্ত কোথায় স্টোর করা হয় আর কোথা থেকেই বা পাওয়া যায়?!
শহীদ হাসপাতাল গড়ে তুলেছিলেন যে শ্রমিক ইউনিয়ন সেই ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের সদস্য সংখ্যা সে সময় প্রায় সাড়ে সাত হাজার। তাঁদের মধ্যে যাঁরা রক্ত দিতে ইচ্ছুক তাঁদের নাম-ঠিকানা আর রক্তের গ্রুপ সম্বলিত একটা তালিকা ছিল। এঁরাই হলেন শহীদ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক। যখন কোনও রোগীর রক্তের প্রয়োজন তখন প্রথমে তাঁর পরিবার-পরিজনকে বোঝানো হতো রক্ত দেওয়ার জন্য। রক্তের গ্রুপ না মিললে বা তাঁরা শারীরিক ভাবে রক্ত দিতে অক্ষম হলে তালিকা থেকে রক্তদাতাদের ডেকে পাঠানো হতো। আর জরুরী অবস্থার জন্য ছিল একটা ইমার্জেন্সি স্টক যাতে থাকতেন হাসপাতালের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও ইউনিয়নের নেতারা। সুনীল তিনবার এই ইমার্জেন্সি স্টক থেকে রক্ত পেয়েছিল।
দল্লী-রাজহরার শহীদ হাসপাতালে আমি কাজ করেছি ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪—এই আট বছর। রক্তের অভাবে কোনও রোগী মারা গেছেন বলে আমার মনে পড়ে না।
আজকে চাইলেও অতো সহজে রক্তদান ও রক্ত চালানো সম্ভব না। হেপাটাইটিস বি, সি এবং এইচআইভি-এডস-এর মতো রক্তবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য এবং রক্ত নিয়ে যথেচ্ছ ব্যবসার জেরে আইনের কড়াকড়ি হয়েছে। তবু কিছু তো করাই যায়।
এমন অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই হয়েছে যখন কোনও আত্মীয়ের রক্তের প্রয়োজন—সরকারী ব্লাড ব্যাংকে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন লাগিয়েও রক্ত পাওয়া যায়নি, চড়াদামে বেসরকারী ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত কিনতে হয়েছে। কখনও বা রক্ত আনতে আনতে রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
দল্লী-রাজহরার শ্রমিকদের মতো আমরাও পারি অবস্থাটাকে পাল্টাতে। পাড়া, ক্লাব বা সংগঠনে যাঁরা রক্ত দিতে ইচ্ছুক তাঁদের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে একটা তালিকা তৈরী করে রাখুন। দেখবেন দরকারের সময় রক্ত পেতে দেরী হবে না।