পৃথিবীতে কিছু মানুষ আসেন, যাঁদের ঠিক বোঝা যায় না। এমনকি তিনি নিজেও খুঁজতে থাকেন জীবনভর, কেন বেঁচে আছি।আমি এই লেখাটা লিখতে গিয়ে দিশেহারা, কোথা থেকে যে আরম্ভ করবো! অসম্ভব আবেগপ্রবণ, নিবেদিতপ্রাণ,আদ্যন্ত সৎ একজন মানুষ। যিনি শেষকালে ওনার কাজ, পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। ঠিক মত করে প্রকাশের অক্ষমতার জন্য পাঠকরা আমার দীনতা ক্ষমা করবেন।
Charity should be abolished; and be replaced by justice.– Norman Bethune
যিনি দারিদ্র্যহীন দেশ,মুক্ত স্বাস্থ্যবব্যস্থা তৈরির জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অপারেশন করে গেছেন-সেই মানুষটার জীবন (The Scalpel, The Sword এবং মহাচীনের পথিক-এর কাছে ঋণী।
ম্যালকম বেথুন আর এলিজাবেথ অ্যান গুডউইনের দ্বিতীয় সন্তান হেনরি নর্ম্যান বেথুন।কানাডার নর্থ আনুটেরিওর গ্র্যাভেনহার্স্টে। সালটা আঠেরোশো নব্বই। মার্চ মাসে। বাবা ছিলেন চার্চের প্রধান এবং পারিবারিকভাবে শল্যচিকিৎসক। তখন চার্চে ঘন ঘন বদলি হতো। মাইনেও ছিলো অল্প। নর্ম্যান বেথুনের ছোটো থেকেই স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হবে। ঠাকুর্দার নাম ছিলো নর্ম্যান বেথুন। তিনি ছিলেন ডাক্তার। সুতরাং বালক বেথুন ঠাকুর্দার নামের ফলকটা নিজের শোওয়ার ঘরের দরজায় টাঙিয়ে দিলোঃ “ডাক্তার নর্ম্যান বেথুন”।
খুব ছোট্টবেলা থেকেই শিশুদের কিছু স্বপ্ন থাকে। আমাদের ডাক্তার বেথুন পারিবারিক স্বাধীনতায় স্বপ্নটা পূরণ করতে পেরেছিলেন। বালক তখনই হেনরি শব্দটা নিজের নাম থেকে বাদ দিয়ে দিলেন। তারপর ইউনিভার্সিটি। চার্চের সামান্য মাইনেতে পড়ার খরচ আর চলে না। ম্যালকম সঙ্গে খবরের কাগজ বিক্রি করা ধরলেন। আর নর্ম্যান নানা কাজের পর যোগ দিলো কাঠুরের কাজে। উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন করা এবং শরীরটাকে শক্ত পোক্ত করে তোলা।
এখানে নর্ম্যানের চেহারার একটু বিবরণ দিই। ছ’ ফুট লম্বা, লালচে চামড়া, নীল চোখ। নর্ম্যানের নিজের ভাষায় “মায়ের প্রভাবে আমি দেখতে ছিলাম ধর্ম উপদেষ্টার মতো আর বাবার মতো অসম্ভব কর্মমুখী।” বেঁচে থাকার অপরিসীম আনন্দে, নর্ম্যান ছবি আঁকে, মূর্তি গড়ে, অনন্ত ক্ষুধায় পাগলের মতো একটার পর একটা বই পড়ে যায়। যখন এমডি পরীক্ষার কয়েক বছর বাকি তখন অগ্নুৎপাতের মতো ছড়িয়ে পড়লো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অর্থহীন, মৃত্যুসর্বস্ব যুদ্ধ।আহত,পঙ্গু,রক্তহীন নর্ম্যান ফিরে এলো হাসপাতালে। গুলিবিদ্ধ ছিন্ন ভিন্ন পা নিয়ে ছ’মাস হাসপাতালে। তারপর সুস্থ হয়ে আবার কলেজে। সেখান থেকে ব্রিটিশ নৌবাহিনী, তারপর নর্ম্যান যোগ দিলো কানাডিয়ান বিমানবাহিনীতে।
কিন্তু পকেটে একমাসের মাইনে নিয়েই আবেগপ্রবণ নর্ম্যান চললো লন্ডন। তখন ওর শিল্পীসত্তা ওকে শিল্পে আকৃষ্ট করে’ তুলেছে। আসলে দিগভ্রান্ত, দিশাহীন নর্ম্যান কিভাবে নিজের অস্থিরতা দূর করবে জানতো না। নিজে কি চাইছে, সেটাও নিজেই জানতো না। প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছিলো হয়তো অনেক টাকা, অতুল বৈভব নর্ম্যানের অশান্ত মনকে শান্ত করবে।ফ্রান্সে গিয়ে সস্তায় শিল্প সামগ্রী কিনে লন্ডনে চড়া দামে বিক্রি করা শুরু করলো। সঙ্গে নিজের আঁকাআঁকি। একেবারে একটা আমাদের মতোই একটা গতে বাঁধা জীবন। টাকা রোজগার করলো অনেক, ওড়ালো তার থেকে বেশী। সার্জারিও সঙ্গে রইলো। ওটা ছিলো নর্ম্যান বেথুনের রক্তবন্ধন।
এরপর দেখা হয়, এক নারীর সঙ্গে। ডাক্তার এলিনর ডেল(ছদ্মনাম)। তাঁর অর্থানুকূল্যে নর্ম্যান এডিনবার্গ গেলো এফআরসিএস পড়তে। সেখানে দেখা ফ্রান্সেস ক্যাম্পবেল পেনি’র সঙ্গে। গানের সুরে কথা বলে, তার সৌন্দর্য, পবিত্র মুখমণ্ডল, অপার্থিব সারল্য, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, এসব দেখে নর্ম্যান ফ্রান্সেসের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করে দিলো। নিজেকে উজাড় করে ভালবাসলো। ফ্রান্সেস এডিনবার্গের অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত মেয়ে। এই দুজন নারী নর্ম্যানের জীবনটাই আমূল বদলে দিয়েছিলো।
বিয়ের পর ফ্রান্সেসের কাছে নর্ম্যানের প্রথম স্বীকারোক্তি “আমার কাছে সংসার চালানোর মতো টাকা নেই। তাই আমি পড়াশোনা ছেড়ে প্র্যাকটিস করতে চাই”। ফ্রান্সেস তীব্র আপত্তি করে’ নর্ম্যানকে ঠেলে আবার পড়তে পাঠালো।
দুজনেই দুজনকে তীব্র ভালবাসতো। কতোটা তীব্র সেটা নর্ম্যান নিজেও জানতো না। সমস্ত আবেগের মতো ওর আবেগও ছিলো তীব্র সর্বগ্রাসী আর একমুখী। মুহূর্তে ভালবাসা, তারপরই ঝগড়া ক্ষমা চাওয়া আবার সেটার পুনরাবৃত্তি ওদের যুগলজীবনে চিড় লাগালো। একদিন আত্মহত্যার জন্য নর্ম্যান ঝাঁপিয়ে পড়লো ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ইংলিশ চ্যানেলে। ফিরেও এলো জীবিত। নর্ম্যানের ক্ষোভ কার বিরুদ্ধে, সেটা নিজেও বুঝতো না। দারিদ্র্য নাকি দিশাহীনতা সেটা বুঝতে পারতো না। কিসের অভাবে নর্ম্যান এই রকম উন্মাদ হয়ে ঘুরছে সেটা সে’ও জানতো না।
এরপর বেড়াতে গিয়ে ফ্রান্সেসকে ব্রিটেনের পার্বত্য অঞ্চলে এক গভীর খাদে লাফিয়ে পড়তে জোর করলো। একসময় এই পাগলের জোরাজুরিতে ফ্রান্সেস রাজি হলো। নর্ম্যান তখন উন্মাদ হয়ে গেছে। ফ্রান্সেস লাফিয়েও বেঁচে গেলো। নর্ম্যান চিঠিতে লিখলো “আমি তখন আমার মধ্যে ছিলাম না। কিছুতেই বুঝতে পারছি না, কেন আমি সেদিন তোমার সঙ্গে ওরকম ব্যবহার করেছিলাম। এবারের মতো তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো”। ফ্রান্সেস ফিরে এলো। কিন্তু দুজনের মধ্যে ফাটলটা দীর্ঘতর হতে লাগলো।
এরপর নর্ম্যান আরও ভালো করে’ সার্জারি শিখতে চলে গেল ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানির ভিয়েনা। বিয়েতে ফ্রান্সেস বাড়ি থেকে যে টাকা পেয়েছিলো, সেটা শেষ। এই নিস্তরঙ্গ একঘেয়ে জীবন নর্ম্যানের ভালো লাগছিলো না।
“মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যেন একটা দৃষ্টিহীন নির্বোধ প্রজাপতি,অকারণে একটা আলোকবর্তিকার চারপাশে ডানা ঝাপটে বৃত্ত রচনা করে চলেছি। মনে হয় জীবন ও মৃত্যুর কোনো অর্থই যেন নেই আমার কাছে”
বছর শেষ হয়ে গেল। দম্পতির হাতে মাত্র দুশো পাউন্ড। দুজনে চললো ডেট্রয়েট। একটা বেশ্যাপাড়ার পাশে একটা সস্তার বাড়ি ভাড়া নিলো দুজন মানুষ। একটা নিঃসম্বল দম্পতি। দিন চলে না।হঠাৎ এক মুদীর স্ত্রী এলো প্রায় পচে যাওয়া একটা পা নিয়ে।নর্ম্যান তাকে ভালো করে দিলো। টাকা বেশী হলো না বটে কিন্তু মুদী বললো যে মাসের মুদীর জিনিসপত্র সে বিনা পয়সায় পাঠিয়ে দেবে।
তারপর এলো এক কসাই, সেরে উঠে সে’ও দরিদ্র ডাক্তারকে মাসের মাংস পাঠানোর কথা দিলো। যাক দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেলো।
আস্তে আস্তে রোগী বাড়তে লাগলো। তখন তাদের রোগাটে শরীরের প্রতিটা কোণে ছড়িয়ে পড়েছে রোগ। কুৎসিত যৌন ব্যাধি, ফেটে যাওয়া অ্যাপেন্ডিক্স, পচন ধরা হার্নিয়া….
নর্ম্যান প্রথমে দেরি করে’ ডাক্তার দেখানোর জন্য ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে পড়তো, তারপর পাগলের মতো দিনরাত এক করে চিকিৎসাকরতো।
“ফ্রান্সেস এদের রোগটা বড়ো সমস্যা নয়। সমস্যাটা অন্য জায়গায়।ওদের পেশা, ওদের দারিদ্র্য। এই সমস্যাদুটো আমি কি করে দূর করবো ফ্রান্সেস?”
এরপর যখন আবার একঘেঁয়েমি নর্ম্যানের জীবনকে আবৃত করেছে, তখন একটা মরণাপন্ন দরিদ্র রোগীকে তিনঘন্টা একটানা অপারেশন করে বাঁচিয়ে তুললো। নর্ম্যানের হঠাৎ নিজেকে অমূল্য মনে হলো, নিজের জীবনটা বড্ডো অর্থবহ মনে হলো।
কিন্তু এরমধ্যেই নর্ম্যানের জীবনটা আবার অন্য খাতে বইতে শুরু করলো।হঠাৎ ডাক্তার নর্ম্যান বেথুনের নাম ডেট্রয়েট শহরের প্রতিটা কোণায় ছড়িয়ে পড়লো। নর্ম্যান বেথুনের পয়সার এবং বড়ো বড়ো ডাক্তারদের সঙ্গের অভাব রইলো না। শুরু হলো টাকা ওড়ানো, অমিত মদ্যপান, পরস্পরের পিঠ চুলকোনো, বিত্ত দেখানোর অসীম প্রতিযোগিতা। পাগলের মতো কাজ, নেশাগ্রস্তের মতো কাজ করা। “টাকাই তোমাকে মান দেবে, তোমাকে সুখ দেবে” এইরকম একটা চিন্তা তখন আজন্ম দরিদ্র নর্ম্যানকে ছেয়ে ফেলেছে। অথচ কাজের নেশা ছুটলেই নর্ম্যানের মনে হয় এই দুটো হাত একদিন গরীবের চিকিৎসা করেছে আজ ধনীদের সেবায় নিয়োজিত। টাকা অনেক রোজগার হলো কিন্তু শান্তি কোথায়? তখন সুরা হলো তার সঙ্গী। বড়লোক ডাক্তারদের সঙ্গে মদ খাও, আড্ডা মারো, কতোগুলো আকাট মূর্খ, তাদের তেল দাও…..
অতীতের ডাক্তার নর্ম্যান বেথুনকে খুঁজতে সে নিজেই আবার চলে গেলো পুরোনো পাড়ায়। গরীবদের চিকিৎসা করতে।অমানুষিক পরিশ্রমের জীবন। দিন নেই, রাত নেই, হয় মদ, নয় অপারেশন। যেন ও একটা অতৃপ্ত মানুষ। কি চাইছে নিজেই জানে না। দিশা দেখানোর জন্য কেউ নেই। নর্ম্যান ভেসে চললো গড্ডালিকা প্রবাহে।
প্রথম পর্ব শেষ।