প্রথম মৃত্যু
তখন আবার টাকা উপার্জনের একঘেয়েমিতে নর্ম্যানকে অবসাদগ্রস্ত করে তুলেছে। একটা অদ্ভুত ঘটনা আবার তাকে বাঁচার আলো আর মৃত্যুর পথ চেনালো।
এক মধ্য রাতে দরজায় ধাক্কা। দরজা খুলে দেখে একজন দীর্ণ শীর্ণ মানুষ। একজন দরিদ্র বস্তির মানুষ। শহরের অন্য ডাক্তারের কাছে যেতে ভরসা পাচ্ছে না। তার সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে দেখে একটা পরিত্যক্ত গাড়ির খোলে একটা গর্ভবতী মহিলা প্রসবযন্ত্রনায় ছটফট করছে। দুটো ভীত শিশু জড়ামড়ি করে বসে আছে। কেরোসিনের কুপি জ্বেলে সারা রাত অপারেশন। আলোহীন অন্ধকারে সব স্নায়ু ভেঙে আসা জটিল অপারেশন। সন্তান জন্মালো। অপুষ্ট, বিড়ালছানার মতো একটা প্রাণী। হ্যাঁ প্রাণী। শুধু ঐ প্রাণটুকুই আছে। ওদের একমাত্র ছেঁড়া কম্বলটা দিয়ে শিশুটিকে মুড়ে নর্ম্যান ফিরে চললো। হ্যাঁ, যাওয়ার আগে শিশুটির বাবাকে তার দেওয়া এক ডলারটাই ফেরত দিয়ে এলো। তখন রাত্রি শেষের আলোয় পূর্ব আকাশ আলোয় ভরা। আলো ফোটার পর নর্ম্যান আবার ফিরে এলো সেই পরিত্যক্ত গাড়ির খোলে। সঙ্গে একটা নতুন তোয়ালে। শিশুটিকে আবার পরীক্ষা করে’, নতুন তোয়ালেতে মুড়ে দিলো। হয়তো শিশুটা আর বাঁচবে না।যে ওষুধ চিকিৎসা লাগবে সেটা এই দরিদ্র বাবার সাধ্যের বাইরে। এবং সে মারা গেল। নর্ম্যানের মনে হলো মিথ্যেই আমি ডাক্তার। বৃথা সমস্ত সঞ্জীবনী ওষুধ। যে চিকিৎসা সবাইকার প্রাণ বাঁচাতে পারে না, সেটাকে কি চিকিৎসা বলা যায়?
নর্ম্যান তখনও অমানুষিক পরিশ্রম করছে। সারা দিন বাইরেই থাকে। যেটুকু ঘরে থাকে মদে ডুবে থাকে। স্ত্রী ফ্রান্সেসের সঙ্গে মানসিক সম্পর্ক ছিন্ন। বাইরের ডাক্তারদের সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য।
নর্ম্যান প্রকাশ্যেই বলে “নীতিহীন এইসব ডাক্তারগুলো মধ্যযুগের হাতুড়ে চিকিৎসক আর অশিক্ষিত ক্ষৌরকারদের মতো। আমার ইচ্ছে করে আইন করে ওদের ডাক্তারি বন্ধ করে দিই”
অসম্ভব পরিশ্রম, অতিরিক্ত মানসিক চাপ আর মদ্যপান ওর পাথরের মতো শরীরটাকে ক্ষইয়ে দিচ্ছিল। একদিন আয়নায় দেখলো ওর মুখটা ভেঙে গেছে, চুলে পাক ধরেছে। ফ্রান্সেস দূর থেকে শুধু নিরুপায় নর্ম্যানের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখখানি দেখে। হঠাৎ নর্ম্যান খেয়াল করলো ওর ওজন পঞ্চাশ পাউন্ড কমে গেছে। কিন্তু পরিশ্রম একটুও কমালো না।
একদিন কাজ থেকে ফিরে নর্ম্যান খুব তাড়াতাড়ি, যেন কিছু লুকিয়ে রাখতে, নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছিলো।মুখচোখ অস্বাভাবিক। ফ্রান্সেস সিঁড়িতে নর্ম্যানকে আটকে দাঁড়ালো।তাকিয়ে দেখে, নর্ম্যানের রুমাল ভর্তি টাটকা লাল রক্ত। কাশির সঙ্গে উঠে আসা রক্ত।
ফ্রান্সেস দৌড়লো কাছের ডাক্তারকে খবর দিতে। এক্স রে হলো। নর্ম্যান পড়ে রইলো অর্ধচেতন।নীল দুটি চোখের দৃষ্টি আচ্ছন্ন। মাথার কাছে ফ্রান্সেস। ছায়ার মতো। ঘরের মধ্যে ডাক্তারদের আনাগোনা। নর্ম্যান টের পায় কিন্তু চেতনায় পায় না। এই রকমই একদিন জীবনে অতৃপ্ত নর্ম্যানের কাছে এসে একজন বৃদ্ধ, আত্মসুখী, অর্থবান, কৃতী ডাক্তার এসে ডাক দিলেন
“ডাক্তার বেথুন, আপনি কেমন আছেন এখন?”
নর্ম্যান তখন একটু চেতনায় ফিরেছে। সে চিনতে পারে ঐ ধনী ডাক্তারকে। সে তীব্র ঘৃণা উগরে দেয়,সমাজ সম্পর্কে অচেতন, বিজ্ঞান ভুলে যাওয়া, বুড়ো ডাক্তারকে।
“কি হয়েছে আমার, আপনি কি ভেবেছেন আমি মরতে বসেছি? বুড়ো রামছাগল কোথাকার, পারতেন কোনদিন মাঝরাতে কুপির আলোয়, ভাঙাচোরা গাড়ির খোলের মধ্যে, বেকার স্বামী আর অভুক্ত উলঙ্গ ছেলেমেয়ের সামনে, একজন দরিদ্র রমণীর প্রসবযন্ত্রণা দূর করতে? পারা দূরের কথা, চিন্তা করাও আপনার পক্ষে অসম্ভব। আমাকে দেখে কিস্যু হবে না, যান কেটে পড়ুন, নিজের কাজ গোছান গিয়ে”
সামান্য চেতনা আসতেই সমসাময়িক ডাক্তারদের সম্বন্ধে নিজের ভেতরে থাকা বিতৃষ্ণায় উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কেন যে ও প্রচলিত ডাক্তারির ওপর, ডাক্তারদের ওপর, এতো বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলো, নর্ম্যান নিজেও তা জানে না। অথচ ওর বোধ ওকে বলে এরা সবাই ভুল পথে চলছে।ডাক্তারের উপার্জন কমে গেলেও, গরীবের জন্য কিছু করা উচিত। উপার্জনটাই সব নয়।সবাইকার বাঁচার অধিকারটাও দরকার। ডাক্তার নর্ম্যান বেথুন আবার ডুবে যায় এক চৈতন্যহীন জগতে।
এক ভোরবেলায় নর্ম্যানের ঘোর কাটে। আছন্ন ভাবটা নেই। রক্তও আর পড়ছে না। কিন্তু সময়, তারিখ, কিচ্ছু মনে নেই। আজ কতো তারিখ? কটা বাজে?
দূরে চড়ুই, শালিক ডাকছে। জানালা দিয়ে সকালের সোনালী রোদ্দুর এসে বিছানায় পড়েছে।কোথায় যেন কারখানার ভোঁ বেজে উঠলো। বাচ্চাদের ছোটাছুটির শব্দ। রাস্তার কতো রকম শব্দ। সবাই যেন বলছে ডাক্তার নর্ম্যান বেথুন, তুমি বেঁচে আছো। ও যদি সেই লন্ডনে থাকতো, সোহোতে, তাহলে এখন সেখানে দুপুর। ভূমধ্যসাগরীয় ছায়া নেমে আসছে, টেমসের জলে নৌকো, যদি ভিয়েনায় থাকতো, তাহলে বরফ আর বরফ। আর এই ডেট্রয়েটে? চরম হতাশা আর দারিদ্র্য। জীবনের জন্য, রোজগারের জন্য অবিরাম লড়াই। বেচারা ফ্রান্সেসকে একটা দিনও ভালো রাখতে পারে নি, ওর ভালবাসার ফ্রান্সেস, গানের সুরে কথা বলা, শান্ত ফ্রান্সেস।অথচ ওর সঙ্গে জীবনটাই শুধু তিক্ততা আর তিক্ততা।
বিছানার পাশে রাখা আয়নাটার দিকে তাকিয়ে দেখে, গাল বসে গেছে, দুটো ভাবলেশহীন চোখ, সমস্ত চুল পেকে গেছে-এই কি সেই নর্ম্যান?
নর্ম্যান ক্ষীণ স্বরে ডাক দেয় “ফ্রান্সেস…..”
ফ্রান্সেস এসে নীরবে বিছানার পাশে দাঁড়ায়।
নর্ম্যান ভাবে ফ্রান্সেসের এই জীবন প্রাপ্য ছিলো না। ও ফ্রান্সেসকে মুক্তি দেবে। “ফ্রান্সেস, আমি জানি না, ডাক্তাররা তোমাকে কি বলেছে। আমার টিবি হয়েছে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তোমার সঙ্গে পাকাপাকি বিচ্ছেদ চাই। আমি চাই না, তুমি আমার মতো একজন রোগীর সঙ্গে, বাকি জীবনটা কাটাও। আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। তোমার জন্য পড়ে আছে অনেক বড়ো, সুন্দর একটা জীবন। এখন আমাকে স্যানাটোরিয়ামে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। কেননা আমাদের উন্নত বিজ্ঞান, আমার জন্য এটুকুই পারবে। তুমি সুন্দর একটা জীবন কাটাও, ফ্রান্সেস। তুমি এতে রাজি না হলে আমি কিন্তু স্যানাটোরিয়ামে যাবো না….”
মনে আছে সেই ব্রিটেনের সেই পাহাড়ের কথা? যেখানে ফ্রান্সেস বাধ্য হয়েছিলো খাদে ঝাঁপ দিতে? আজও সেই রকম ঘটলো। কথা শেষ করে নর্ম্যান হাঁফাতে থাকে।
কিছুতেই না। ফ্রান্সেস প্রথমে পাগলের মতো হয়ে যায়। সে বিয়ে ভাঙার কথা ভাবতেই পারছিলো না। “জীবনের সব খারাপ সময়ে, নর্ম্যান, আমরা পাশাপাশি থেকেছি। আমি তো চেয়েছি….হয়তো একটু চেষ্টা করলেই আমরা আবার একসঙ্গে থাকতে পারবো, নর্ম্যান… নর্ম্যান…”
কিন্তু চিরকালের মতো আজও নর্ম্যান একগুঁয়ে। মৃত্যু এসে যেন আরও জেদী আর রুক্ষ করে তুলেছে। অবশেষে ফ্রান্সেস রাজি হয়।
গ্রাভেনহার্স্টের স্যানাটোরিয়ামে যাওয়ার ট্রেনে ওঠার আগে নর্ম্যান ফ্রান্সেসের হাত ধরে বললো
“ফ্রান্সেস, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব কিছু বিক্রি করে এডিনবার্গ চলে যাও”
নর্ম্যান মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ট্রেন চলতে থাকে বিচ্ছেদের দিকে।
দ্বিতীয় পর্ব শেষ।
চমৎকার ঝরঝরে ভালোবাসা-মাখা লেখা!
প্রণতঃ জয়ন্তদাদা