ফিনিক্স পাখি-তুমি ফিরে এলে
জীবনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে প্রথম গ্রাভেনহার্স্টের স্যানাটোরিয়ামে তারপর ট্রুডো স্যানাটোরিয়াম। সারোনাক লেকের পাশে মাউন্ট পিগসায় স্যানাটোরিয়ামের ছোটো ছোটো কুঁড়ে ঘরগুলো হলো ওর নতুন বাসস্থান। এডোয়ার্ড ট্রুডো নিজের হাতেই সবাইকার চিকিৎসা করতেন।
ডাক্তার বি*, ডাক্তার লিঙ্কন ফিসার আর নান-লি’র সঙ্গে দিব্য বন্ধুত্ব জমে উঠলো। মানসিক ভাবে দিব্বি চাঙ্গা।এক্স রে ছবির উন্নতিও লক্ষ্যণীয়। চার বন্ধু ভালো খাবার দাবার,সিগারেট আর সুরার ব্যবস্থাও করে ফেললেন। কোত্থেকে এক গ্রামাফোন আর একটা মাত্র রেকর্ডও জোগাড় হলো। চারবন্ধু এই একটা গানই বারবার বাজাতেন- বনপথ, হাঁটার সময়, সন্ধেবেলা, চারজনে আড্ডা দিলে বা চুপ করে থাকলে- সব সময়। নর্ম্যান আবার ছবি আঁকা, লেখা আর পড়াশোনার মধ্যে ডুবে গেলেন। আপাত একটা মানসিক শান্তি।
এমন সময় এলো ফ্রান্সেসের চিঠি। আমি বিবাহবিচ্ছেদে রাজি, ফিরে যাচ্ছি এডিনবার্গ।
নর্ম্যান স্তব্ধ হয়ে গেল। ডিভোর্স চেয়েছিলো, ফ্রান্সেস রাজি হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওর মনে হতে লাগলো, ও শুধু পৃথিবীর থেকে নয়, এবার ফ্রান্সেসের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। বাইরে তখন বরফ। পেঁজা তুলোর মতো নিঃশব্দ বরফ।ফ্রান্সেস হারিয়ে গেলো, ভাবতেই ওর বুকের ভেতরটা ভেঙে চুরে টুকরো হয়ে গেলো। এবার যেন মৃত্যু স্বয়ং এসে হাজির হলো।কিজন্য বাঁচবে? যেন মৃত্যু যন্ত্রণা সমস্ত শরীরটা কুরে কুরে খাচ্ছে।
“দূর ছাই, কি হবে এসব ভেবে, কতোদিনই বা বাঁচবো? কুৎসিত যক্ষ্মার কীট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ফুসফুসে, এদের হাত থেকে রেহাই নেই। অতএব মদ খাও প্রাণ ভরে”
ডাক্তার ফিসার ঢেলে দিলেন সুরা, নর্ম্যান চাপালেন সেই একটা মাত্র রেকর্ড- নির্জন বনপথ। সবাই শুয়ে আছে,নর্ম্যান চিঠি লিখছে–“প্রিয় ফ্রান্সেস, তাহলে তুমি সত্যিই এডিনবার্গ চলে যাচ্ছো। তুমি অনেক কষ্ট সহ্য করেছো, আমার জন্য…..আমি এখন অক্ষম আর কিছুই করার নেই। এখন আমি বাস করছি এক নিষ্প্রাণ ও অবাস্তব জগতে।”
হঠাৎ চিঠি লেখা বন্ধ করলো নর্ম্যান। এখন সব কিছুই অর্থহীন।একটা ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গতা আর মৃত্যুভয় নর্ম্যানকে গ্রাস করলো।এই পৃথিবীতে কিছু হয়তো ওর অবদান থাকবে। আলো নিভিয়ে একাকী নর্ম্যান বিছানায় শুয়ে পড়লো।
কোনো কিছুতেই নর্ম্যানের মন বসে না, গল্পের বই টেনে নিয়ে আবার বন্ধ করে দেয়। এরই মধ্যে একটা ম্যাগাজিনে ওর চোখে পড়লো ডাক্তার আলেকজান্ডারের লেখা একটা প্রবন্ধ। চোখে পড়লো বলা ভুল। তন্ময় করে দিলো। বইটা ছিলো দি সার্জারি অফ পালমোনারি টিউবারকিউলোসিস। এতোদিন টিবি রোগের একটাই চিকিৎসা ছিলো।বিশ্রাম। অনির্দিষ্টকালের বিশ্রাম। অথবা আমৃত্যু বিশ্রাম। যদি এই অপারেশন করা যায় তাহলে কতো রোগী জীবন খুঁজে পাবে। পড়তে পড়তে নর্ম্যান ভাবছিলো, ওর তো বাঁ দিকের ফুসফুসটা গেছে। ডান দিকে সম্পূর্ণ ঠিক আছে।প্রবন্ধটা বেরিয়েছে ১৯২৬ সালে। এর ওপর তখন কাজ করছিলেন ডাক্তার এডোয়ার্ড আর্চিবল্ড। মানে এই গত এক বছরে। নর্ম্যান ডাক্তার আর্চিবল্ডের সব লেখা পড়লো। তারপর ট্রুডো স্যানাটোরিয়ামে জানালো, নর্ম্যান রাজি ওর নিজের ওপরে এই অপারেশনের অনুমতি দিতে। নর্ম্যানের পরামর্শ অনুযায়ী প্রথমে অসুস্থ ফুসফুস কেটে বাদ দিয়ে নিউমোথোরাক্স (ফুসফুসে হাওয়া ঢুকিয়ে অসুস্থ ফুসফুসটাকে চুপসে দেওয়া) করা হলো।অপারেশনের দু মাস পরে দেখা গেলো নর্ম্যান সুস্থ। জীবনের পথে হাঁটার অধিকার ফিরে পেলো। নবজন্ম হলো ফিনিক্স পাখির।
ডিসেম্বর। তুহিন শীতল ডিসেম্বর। বরফে ঢাকা ডিসেম্বর এসে গেলো।
“আমি পুরো সেরে গেছি।স্যানাটোরিয়াম থেকে চলে এসেছি।এখনও তোমাকে ভালবাসি, আগের মতোই ভালোবাসি। তুমি কি বিয়ে করবে আমায়?” পোস্ট অফিসে ফ্রান্সেসকে টেলিগ্রাম করে।
বরফ প্রান্তরের ওপর দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন ফিরে আসে। নর্ম্যান প্রতিজ্ঞা করে এখন আমি শুধু জীবনের সন্ধান করবো।জীবনের জয়ের পতাকা ওড়াবো। বিদায় ট্রুডো, ফিসার, নান-লি।আমি চললাম বহু দূর জীবনের সন্ধানে।
ফিনিক্স পাখি অগ্নিশুদ্ধ হয়ে নতুন ডানায় ভর উড়ে চললো জীবনের জন্য।
তৃতীয় পর্ব শেষ।
খুব ভালো লেখা হচ্ছে। মহাজীবনের কথা এই ভাবেই লিখতে থাক।