প্রসন্ন বাবু একজন সদাহাস্যময় মানুষ। তিনি এক বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। তিনি কাজ করতে ভাল বাসেন এবং বুক ফুলিয়ে নিজেকে “ওয়ার্কহলিক” বলে দাবি করেন।
কিন্তু গত একমাস ধরে তাঁর কাজে মন নেই,শরীরের শক্তি যেন নিশ্বেষিত, দশ মিনিটের কাজ করছেন এক ঘন্টা ধরে, তারপরে আবার কাজে ভুলও করে ফেলছেন, কর্মক্ষেত্র যেন তাঁর কাছে দু চোখের বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষমেশ তিনি সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিতে বাধ্য হলেন। সাইকিয়াট্রিস্ট জানিয়েছেন যে প্রসন্ন বাবুর যা ঘটেছে তাকে বলে ‘অকুপেশনাল বার্ন আউট’।
কোন ব্যক্তি যদি তাঁর কর্মক্ষেত্রে নিরন্তর চাপের সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে না পারেন তবে বার্ন আউটের সমস্যা দেখা যেতে পারে। এর লক্ষণগুলি হল-
- কাজ করতে গিয়ে শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করা,
- নিজের কর্মক্ষেত্র থেকে মানসিক দূরত্ব তৈরী হওয়া ও
- কাজের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব ও উন্নাসিকতা তৈরী হওয়া,
- কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে সুচারুভাবে নিজের দক্ষতা অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করতে না পারা।
যদিও সে অর্থে বার্ন আউটকে রোগ বলা যায় না।তবে বার্ন আউট থেকে নানান শারীরিক ও মানসিক রোগের সূত্রপাত হতে পারে। এছাড়া বার্ন আউটের ফলাফল হিসাবে কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি, চাকরী ছেড়ে দেওয়া, সময়ের আগেই চাকরীতে ইস্তফা ইত্যাদি ঘটতে পারে।
বার্ন আউট থেকে স্থূলতা, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল সংক্রান্ত সমস্যা, মাথা ব্যথা, শরীরের অন্যান্য অংশে ব্যথাসংক্রান্ত সমস্যা, হৃদযন্ত্রের নানান সমস্যা, বদহজম ও পৌষ্টিকতন্ত্রের নানান শারীরিক সমস্যা ইত্যাদি দেখা যেতে পারে।
বার্ন আউট থেকে তৈরী হওয়া মানসিক সমস্যাগুলি হল অনিদ্রা, খিটখিটে মেজাজ,উদ্বিগ্নতার সমস্যা,মানসিক অবসাদ (ডিপ্রেশন) ইত্যাদি।অনেকে আবার এই সমস্যাগুলি কাটাতে গিয়ে নেশার আশ্রয় নেন ও শেষ পর্যন্ত নেশার নাগপাশে জড়িয়ে পড়েন।
সাধারণত বার্ন আউটের পিছনে কিছু পরিবেশগত সমস্যা ও কিছু ব্যক্তিত্বের সমস্যা দায়ী থাকে।
পরিবেশগত সমস্যাগুলির মধ্যে
- কাজের অতিরিক্ত চাপ,
- সময় ও কাজের পরিমাণে অসমতা,
- উপযুক্ত কাজের পরিবেশের অভাব,
- কর্মচারীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব,
- অভ্যন্তরীণ কলহ,
- কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত সম্মান না পাওয়া বা হেনস্তার শিকার হওয়া,
- উর্ধতন কর্তৃপক্ষের একপেশে আচরণ, ইত্যাদি থেকে বার্ন আউটের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
- আবার ব্যক্তিগত জীবনে কর্মজীবনের অনুপ্রবেশও বার্ন আউটের অন্যতম কারণ।
ব্যক্তিত্বের সমস্যা থাকলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা যায় ।
- কেউ খুব বেশী নিয়ম কানুন মেনে চলেন,
- একগুঁয়ে স্বভাবের হন,
- কোন কাজ নিখুঁত না হওয়া অব্দি মনে শান্তি পান না।
- কেউবা নিজের সম্বন্ধে খুব উঁচু ধারণা পোষণ করেন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাখেন-তাই সামান্য বিচ্যুতি তাঁদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
যাঁরা সামাজিক জীবনকে বাদ দিয়ে খালি কাজ নিয়ে পড়ে থাকেন, যাঁরা অন্য মানুষ জনের সাথে মিশতে পারেন না, তাঁদের মধ্যে বার্ন আউট দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশী।
কয়েকটা বিষয় মেনে চললে হয়তো বার্ন আউট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যেমনঃ
প্রথমত-কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করুন। নিতান্ত সাদামাটা কেউ খুব বেশী নিয়ম কানুন মেনে চলেন, একগুঁয়ে স্বভাবের হন, কোন কাজ নিখুঁত না হওয়া অব্দি মনে শান্তি পান না।কাজের মধ্যেও কিছু আনন্দের দিক থাকে। সেগুলি খোঁজার চেষ্টা করুন।
দ্বিতীয়ত-কাজের জায়গায় বন্ধু তৈরী করার চেষ্টা করুন।
তৃতীয়ত-বেশী সম্মানের আশায় বা কর্তৃপক্ষের অনুরোধে নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে সবসময় কাজ করার চেষ্টা না করাই ভাল। “না” বলতে শিখুন।
চতুর্থত-কাজের বাইরে যে সামাজিক জগৎ আছে সেটা বুঝতে হবে। পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের বেশী করে সময় দিন, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করুন।
পঞ্চমত-কাজের চাপ অস্বাভাবিক মনে হলে কাজ থেকে পূর্ণ বিরতি নিন, সপরিবারে কোথাও ঘুরে আসুন। অনেক সময় মোবাইল, ল্যাপটপ, ই-মেইল, ইত্যাদি থেকে একটা দিন দূরে থাকলে তা চাপ কমাতে সাহায্য করে।
ষষ্ঠত-ঠিকমত ঘুম হলে এই জাতীয় চাপ কাটান সহজ হয়। খেয়াল রাখুন যাতে ঘুম চাহিদামত হয়।
সপ্তমত-চেষ্টা করুন রোজ অন্তত ৩০ মিনিট করে হাঁটতে বা কোন এক্সারসাইজ করতে। এতে দেহের সাথে সাথে মনও সতেজ থাকে। ডিপ ব্রিথিং ,যোগা ইত্যাদিও চাপ কাটাতে সাহায্য করে।
অষ্টমত-নিজের সখগুলিকে হারিয়ে যেতে দেবেন না। বই পড়া, ছবি আঁকা, নাচ, গান, খেলাধুলা, ইত্যাদি সখগুলি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতেও বজায় রাখার চেষ্টা করুন।
নবমত-খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে অধিক শর্করা জাতীয় খাবার বা ফাস্ট ফুড কম খাওয়া, অত্যধিক চা বা কফি না খাওয়া, সিগারেট বা মদ্যপান বন্ধ করার মাধ্যমেও এই সমস্যা থেকে কিছুটা মুক্তি মিলতে পারে।
দশমত-সমস্যা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে মনে হলে, মন খারাপ বা উদ্বিগ্নতার সমস্যা অত্যধিক মনে হলে অবশ্যই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।