ডাক্তার, সিষ্টার, মেডিক্যাল টেকনোলজিষ্ট, সুইপার- এদের প্রতি রাষ্ট্র তথা সমাজ ঠিক কি ধরনের আচরণ করছে, তাতে আমি হতবাক নই মোটেও!
ইন্টার্নশিপের প্রথম দিনেই, শুয়োরের-বাচ্চা, বোকাচোদা, হারামির-বাচ্চা বিশেষণ শুনে ডাক্তারি জীবনের প্রথম দিনটা শুরু হয়েছিল।
মন খারাপ হয় কি এখন? নাহ্, সেদিন-ই আমার প্রফেসর আমাকে শিখিয়েছিলেন, “বাচ্চা, ডাক্তার-কে সমাজ মোটেই সম্মান দেয় না, সম্মান না-দেখিয়ে উপায় নেই, তাই শাসনতন্ত্র তোমার সাথে সম্মান-সম্মান খেলা করে! আসলে তোমাকে শুয়োরের বাচ্চা, বোকাচোদা-ই ভাবে!
সেদিন ভেঙে পড়া উচিৎ ছিল, সমাজের প্রতি ঘেণ্ণা জন্মানো উচিৎ ছিল।
তবুও টিঁকে যেতে হয়! মহামারী-অতিমারীতে লড়ে যেতে হয়!
জো হুজুর! না করতে পারলে Dr Sudhakar, Dr Kafeel Khan হয়ে যেতে হয়। বারবার ফিরে যেতে হয় সেই স্মৃতি-সুখের উষ্ণতা ভরা অভ্যর্থনায়, “শালা হারামির বাচ্চা!”
@ ডিউটি ফেরত সিস্টারের গালে পুলিশের থাপ্পড়
@ ট্রেনি সিষ্টারকে বাসা বাড়ী থেকে বিতাড়ণ
@ মেডিক্যাল টেকনোলজিষ্ট-কে পাড়ায় ঢুকতে না-দেওয়া
@ ডাক্তারকে আবাসনের গেটে আটকে দেওয়া
@ ডাক্তার চেম্বার না-খোলায় জনরোষ
@ ডাক্তার চেম্বার খোলায়, ডাক্তারের বিরুদ্ধে মহামারি ছড়ানোর মামলা দায়ের
@ ডাক্তারের নামে ইনফেক্টেড হওয়ার ভুয়ো খবর ছড়িয়ে দিয়ে তাকে ব্রাত্য করার চেষ্টা!
মহামারি-অতিমারি পরিস্থিতি-তে সমাজের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যে অবিচল থাকা-টা সবার আগে দরকার। ডাক্তার-সিষ্টার-টেকনোলজিষ্ট-সুইপারের প্রতি সমাজের আচরণ বুকে দগদগে ঘা তৈরী করছে।
পরিস্থিতি বুঝে নীরব আছি, উদাসীন নই!
বিলেত-বাসী ডাক্তার বন্ধু, প্রায়ই হাতছানি দেয়, “চলে আয়”
জানি এদেশের প্রত্যেকজন ডাক্তার, গতজন্মের পাপের বোঝা লাঘব করছে।
সিনেমা-নির্মাতা থেকে কলিযুগের গায়ক, নিজ যোগ্যতায় শিল্প সৃষ্টিতে অক্ষম হলেই, ডাক্তারি জীবনের অতি-ব্যতিক্রমী বা কল্পনা প্রসূত ঘটনা নিয়ে গালগল্প রচনা করে পয়সা-কামিয়েছে! আর এদের প্রত্যেকজন, প্রত্যেক ডাক্তারকে সমাজের কাছে “হারামির বাচ্চা” প্রমাণ করে ছেড়েছে। আর কিছু জনতা ধেঁই ধেঁই করে উল্লাসনৃত্য করেছে। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র-কে তারা ডকুমেন্টেড চলচ্চিত্র ভেবে নিয়েছে। বাণিজ্যিক গান-কে তারা জীবনমুখী গান ভেবে নিয়ে বসে আছে।
ডাক্তারের জীবন দুর্বিষহ করে, এই সব নায়ক-গায়ক কোম্পানি স্পনসর্ড জামা-জাঙ্গিয়া পড়ে, পাঁচতারা হোটেলে ফূর্তি মারে। ডাক্তার পড়ে থাকে সেই রোগজীবাণুর সাথে। তারা নায়ক, ডাক্তার ভিলেন!
তবুও টিঁকে থাকতে হয়, বিলেতের হাতছানি উপেক্ষা করতে চায়।
ছেড়ে দেওয়া যায় না এই গোটা সমাজকে “মাদুলী আর তেল-পড়া”-র ভরসায়। যদিও মানুষ আজও আংটি-মাদুলীর খরচকে আনন্দ-খরচ ভাবে আর “ডাক্তারের ফি”-টা বাজে খরচের তালিকায় রাখে। তবুও টিকে যেতে হয়। দু-চারজন আজও তো এসে বলে, “ডাক্তারবাবু, ভালো আছি!” দিন শেষে ওইটুকু পাওনার আশায়, এতো উৎপাত সহ্য করেও।
“ডাক্তারকে সম্মান না-দেখিয়ে উপায় নেই, তাই শাসনযন্ত্র তোমার সাথে সম্মান-সম্মান খেলা করে!”
এরপর আসতে থাকবে, মানবিকতার বুলি শেখানো মহান সব বাণী।
ঘরেতে ঝুলবে গুপ্ত-গহ্বরে লুকিয়ে থাকা গায়ক-নায়কের ছবি, আটা-র প্যাকেটে ৩০ হাজার না দিয়েও, নায়কের পোষ্য-রা তাকে মহান বানাবে, ডাক্তারের তকমা শুধু হারামীর বাচ্চা।
কালো-ব্যাজ পরো, ফেসবুক এইসব অকারণ পোষ্টে ভরিয়ে তোলো, বদলে পাবে তুমি কুচকাওয়াজের ঢক্কানিনাদ আর উড়ো-জাহাজী ফুলবৃষ্টি।
পরিস্থিতি ব্যবসা করে যাবে সান্ত্রী-যন্ত্রী,
জান-প্রাণ নিলামে উঠবে যোদ্ধার,
তোমার পায়ে বেড়ী পড়বে, হাতে পড়বে হাতকড়া।
মানুষ থেকে ডাক্তার হওয়া যায়,
ডাক্তারী ছেড়ে মানুষ হওয়া যায় না?
রেজিষ্ট্রেশন ত্যাগ করে বিচার চাওয়া যায় না?
ডাক্তারের প্রতি এত অবিচার করে, পার পেয়ে যাওয়াটাই নিয়ম।
কালো-ব্যাজের নাটক আমার সহ্য হয় না!