পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ নিয়ে আমার তেমন কোনো তীব্র আবেগ নেই। থাকার কথাও ছিল না হয়ত। আমার শিকড় এপার বাংলায়, ভাটপাড়া আর চন্দননগরে। তাই ওপার বাংলা নিয়ে কোনো নস্টালজিয়া জিনবাহিত হয়ে আমার রক্তে কম্পন ধরায়নি কখনো।
আমার এক কলেজি বন্ধু যেমন সেই শিকড়ের আন্তরিক টানেই মাকে দেখিয়ে এনেছিল তাঁর ছেলেবেলার ফেলে আসা শহর, ছেড়ে আসার সত্তর বছর বাদে। যে নাড়ির টানে আমি মধ্য কলকাতার দেড়শো বছরেরও বেশি প্রাচীন এক ক্ষয়িষ্ণু বাড়িতে গেলে তার গম্ভীর, প্রাচীন থামে আর ফুলের নকশা তোলা রেলিঙে মায়া জড়ানো আঙুল বুলোই, সেই টানেই আমার সেই বন্ধু কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে পা রাখে প্রত্যেক বছর। কিছু কিনুক আর না কিনুক, হাত বোলায় সেই দেশের প্রকাশনার বইগুলোর উপরে। কি অনুভব করে? রক্তের মধ্যে পূর্বজ পূর্বজাদের ডাক? হয়ত।
পুবের সেই দেশ নিয়ে এই একই মায়াময় অতীতচারিতা রয়েছে আমাদের বরেণ্য বাঙালি সাহিত্যিকদের কলমে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ বসু — ওপার বাংলার অনবদ্য সব ছবি এঁকেছে সকলের স্মৃতিভারাতুর কলম। হৃদয়ের টান বিনে সে লেখার জন্ম হয় না। ১৯৪৭ এ যেখানে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বলি হয়েছেন দুটি বিবদমান ধর্মের হাজার হাজার মানুষ, ১৯৭১এ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে প্রাণ, সম্ভ্রম, মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও হারিয়েছেন আরো অনেকে, সেখানেও কাঁটাতারের এপার-ওপারের সম্প্রীতির সেতু হয়ে জেগে ছিল একটিই বস্তু — ভাষা। আমাদের ধর্ম, যাপন, আচার, পরিধানে যত পার্থক্যই থাকুক, মুখের ভাষা ছিল এক। সেই ভাষাই বেঁধে রেখেছিল আমাদের এতদিন, বাঁচিয়ে রেখেছিল সহস্র বিপন্নতা থেকে।
কিন্তু বর্তমানে? খবরের কাগজ, সমাজমাধ্যম, পাড়ার আলাপচারিতা সর্বত্র যে অসীম ঘৃণা, ক্রোধ, অবিশ্বাসের বাতাবরণ দেখছি, শুনছি — স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি।
কতখানি বিভ্রান্ত হলে, ঠিক কতটা মগজধোলাই হলে শিক্ষিত মানুষ অপর একটি দেশের পতাকাকে প্রকাশ্যে মাড়িয়ে চলে যেতে পারে? তাও এমন একটি দেশ, যেটি সর্বান্তঃকরণে স্বাধীন? অত্যাচারিত, পরাধীনতার অত্যাচারে জর্জরিত, বিদেশি শাসকের হাতে লাঞ্ছিত কোনো দেশ নয়, অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে গোটা পৃথিবী যাকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ বলে জেনে এসেছে!
বাংলাদেশ নিয়ে এপার বাংলার আবেগ কি তবে স্তিমিত হয়ে আসছে? উত্তর জানা নেই।
তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী একটি জিনিস প্রমাণ করে দিয়েছে, ভাষার চেয়ে ঢের শক্তিশালী হলো ধর্ম।
কারণ, ধর্মের সঙ্গে শাসনক্ষমতার সরাসরি যোগ রয়েছে। বিশেষত, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে ধর্ম ক্ষমতা দখলের সবচেয়ে জরুরি তাস। আগেও ছিল, এখনো তাই। সূক্ষ্মভাবে আপাত উন্নত পশ্চিমি দেশগুলির মধ্যেও ছড়িয়ে যাচ্ছে ধর্ম আর ক্ষমতার সরাসরি সমীকরণের নীতি। বিষাক্ত ধোঁয়াশা যেমন করে গিলে নেয় চরাচর, মুছে যায় গ্রাম, শহর, প্রকৃতি, তেমনি করেই ধর্মের নামে মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ আর সার্বিক অসহিষ্ণুতা গ্রাস করে নিচ্ছে গোটা পৃথিবী।
বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
ভাষার ক্ষমতা কোথায় যে সে এই অসম্ভব আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে?
বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে আসতেন চিকিৎসার জন্য। সল্টলেক, আলিপুর, ই এম বাইপাসের ধারের অনেকগুলি বেসরকারি হাসপাতাল ছিল তাঁদের আরোগ্যসন্ধানের ঠিকানা। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়াতেই দু’একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের মধ্যে বাংলাদেশি রোগীদের ফেরানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। তাঁরা নাকি বলেছিলেন, নিজেদের দেশের পতাকার সাম্প্রতিক অবমাননার ছবি দেখার পরে, বাংলাদেশের বহু সাধারণ মানুষের সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে সুতীব্র ভারতবিদ্বেষ প্রকট হওয়ার পরে, তাঁরা সম্মিলিতভাবে সে দেশের কোনো রোগীর চিকিৎসা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
চিকিৎসক হিসেবে তাঁরা তা করতে পারেন কিনা, সে অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু বিষয়টি যথেষ্ট অমানবিক।
আজ কাগজে পড়লাম, দিল্লির আর্থিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনস বা আইসিআরআইইআর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন —
“বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপরে হামলার প্রতিক্রিয়ায় অনেকে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করছেন। কিন্তু এতে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি ধাক্কা খাবে। হাসপাতালের ব্যবসা মার খাওয়ার ফলে কর্মী ছাঁটাই হতে পারে। হাসপাতালের কর্মচারী থেকে আরম্ভ করে বাংলাদেশি রোগীদের অস্থায়ী ঠিকানার হোটেলগুলির কর্মীরাও তাঁদের রুটিরুজি হারাতে পারেন।”
মানে, এথিক্যাল উচিত অনুচিতের প্রশ্ন পরে, আগে পেটে লাথির প্রসঙ্গটা উত্থাপন করে দেওয়া হলো সুচতুরভাবে।
মানবধর্ম অনেককাল আগেই পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে। ধর্মান্ধতার উত্তেজনা ছড়িয়ে, অর্থনীতির উদারীকরণের হাত ধরে চলতি রুটিরুজি হারানোর ভয় দেখিয়ে, উগ্রতম জাতীয়তাবাদের কড়া আরক গিলিয়ে রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা যেন তেন প্রকারেণ ধরে রাখাই এখন পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশনায়কদের লক্ষ্য।
এখানে ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশে কোথাও কোনো ফারাক নেই। থাকার কথাও নয় অবশ্য।
সকলেই একই ক্ষমতালিপ্সার জঠরপ্রসূত সন্তান। ফারাক হবে কি করে?