৯-ই ডিসেম্বর, ২০২৪
আরজি কর মেডিকেল কলেজে পঠনরতা এক ডাক্তারি ছাত্রীর ভয়াবহ ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর অনেক দিন কেটে গেল – ‘অভয়া’-র সুবিচার পাওয়ার আশা ক্রমশ সুদূরপরাহত বলে মনে হচ্ছে – আজ সেই বিচারহীনতার ১২০-তম দিন। অভয়ার বাবা-মায়ের শোক হতাশা দুঃখের অংশীদার আমরা সবাই – চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বৃহত্তর সমাজের অনেকেই। আমাদের মনে হয়েছে, এই ঘটনা এক প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধ। তারপরও, এমন ঘটনার পরেও, আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকার স্বাস্থ্যব্যবস্থার সর্বব্যাপী হুমকি-সংস্কৃতি বিষয়ে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনাগ্রহী এবং পছন্দের লোকজনকে রক্ষা করতে অধিকতর আগ্রহী।
আমরা, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের সদস্যরা, এই অবিচার মেনে নিচ্ছি না। আমরা জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স, অভয়া মঞ্চ এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি এবং সুবিচারের দাবিতে লড়াইয়ে অবিচল থাকছি। আদালতের আইনি লড়াই-ই হোক বা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, সুবিচার ছিনিয়ে আনা অব্দি আমাদের এই লড়াই থামবে না।
আমাদের প্রয়াত সহকর্মীর প্রতি সম্মান জানাতে, তাঁর বাবা-মায়ের অনুমত্যানুসারে, আমরা নতুন একটি স্কলারশিপ প্রোগ্রাম চালু করতে চলেছি : “অভয়া ডব্লিউবিডিএফ স্কলারশিপ”।
এই প্রোগ্রামে আমরা প্রতি বছর দশজন ছাত্রছাত্রীকে বার্ষিক বৃত্তি প্রদান করতে চাইছি :
১. পাঁচজন মেধাবী ছাত্রছাত্রী, যারা এমবিবিএস পড়তে ঢুকছে
২. পাঁচজন মেধাবী ছাত্রছাত্রী যারা মাধ্যমিক পাস করে উচ্চশিক্ষার পথে যাত্রা শুরু করতে চলেছে
মেধা এবং আর্থ-সামাজিক অনগ্রসরতা, দুইয়ের ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের বেছে নেবেন একটি কমিটি, যেখানে ডব্লিউবিডিএফ-এর সদস্যদের সঙ্গে থাকবেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বরা। বৃত্তিপ্রদানের এই উদ্যোগ অভয়ার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে – অভয়া, যার উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ও সামাজিক দায়পালনের জেদ আচমকা থেমে গিয়েছে মর্মান্তিক এক ঘটনায়।
এই উপলক্ষে আরও জানাই, সিনিয়র রেসিডেন্ট চিকিৎসক, যাঁরা সদ্য ডাক্তারির পোস্ট-গ্রাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাঁদের কয়েকজনের উপর বড় অঙ্কের জরিমানা ধার্য করার যে নতুন সরকারি নির্দেশনামা, তা দেখে আমরা স্তম্ভিত এবং গভীরভাবে বিচলিত। এমন সিদ্ধান্ত সিনিয়র রেসিডেন্ট চিকিৎসকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করার সামিল তো বটেই, নিজেদের পারদর্শিতা ও উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানে ট্রেনিং নেবার ব্যাপারে চিকিৎসকের যে স্বাভাবিক আগ্রহ তারও পরিপন্থী। আমরা সরকারকে অনুরোধ করছি এমন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে দেখতে, কেননা এমন নির্দেশিকা চিকিৎসকদের উচ্চতর শিক্ষা ও উৎকৃষ্ট ট্রেনিং গ্রহণের ব্যাপারে অনাগ্রহী করে তুলতে পারে, যাতে আদতে সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা বেসামাল হয়ে পড়বে।
জেনারেল ডিউটি মেডিকেল অফিসার সহ স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের যেসব পদ অনেকদিন ধরেই খালি পড়ে আছে, আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করব অবিলম্বে সেসব শূন্যপদে নিয়োগ করতে। অজস্র পদ খালি পড়ে থাকায় একদিকে যেমন স্বাস্থ্যপরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে, আরেকদিকে কর্মরত চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরেও কাজের চাপ বাড়ছে – সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা তথা জনস্বাস্থ্য কর্মসূচীর যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য এই সমস্যার দ্রুত নিরসন জরুরি।
আমরা আরও ঘোষণা করতে চাইছি যে আগামী মাসে, জানুয়ারি মাসের এগারো তারিখ শনিবার, বিকেল পাঁচটা থেকে আটটা অব্দি, সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে আমরা একটি কনভেনশন-এর আয়োজন করতে চলেছি।
বিষয় : হুমকি-সংস্কৃতির শিকল ছেঁড়া : ত্রস্ত থেকে ক্ষমতায়নের পথ (Breaking the Chain of Threat Culture—From Intimidation to Empowerment)
অতি শীঘ্রই আমরা এ ব্যাপারে আরও বিশদে জানাব।
বলা বাহুল্য, স্বাস্থ্যব্যবস্থা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সর্বব্যাপী ভয় দেখানোর হুমকি সংস্কৃতি চালু রয়েছে, আমাদের এই সম্মেলন সেই সমস্যা বিষয়ে। সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, সমমনা সংগঠন এবং জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স, অভয়া মঞ্চ ও ডব্লিউবিজেডিএফ-এর মতো যাঁরা আমাদের সহযোগী, আমরা সবাইকে এই কনভেনশন-এ যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। হুমকি সন্ত্রাস বিভাজনের এই বাস্তবতা অতিক্রম করে আসুন আমরা সবাই এক সুসক্ষম সুস্থ যোগ্যতর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি। সবাই মিলে লড়লে আমরা নিশ্চয়ই পারব।
অভয়ার সুবিচারের এই লড়াই, আসুন, আমরা করে তুলি আমাদের এই পচাগলা ব্যবস্থা বদলে ফেলার লড়াই। এই লড়াই হয়ে উঠুক আমাদের বিস্মৃত মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের লড়াই।