এই মুহূর্তের দুনিয়া কাঁপানো ঘটনাটার শুরুয়াৎ হয়েছিল ২০১৯- এর নিউ ইয়ার্স ইভ-এ। অর্থাৎ, দিনটা ছিল, দু হাজার উনিশ সালের ক্যালেন্ডারের শেষ দিনটি।
৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯
চিন দেশের উঁহ্হান (Wuhan) শহরের মিউনিসিপাল হেল্থ কর্পোরেশন ঘোষনা করল একটি নতুন তথ্য। ২৭ জন রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে হঠাৎ করে, যাঁরা নিউমোনিয়া জাতীয় রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এবং যাঁদের নিউমোনিয়া রোগটি, ঠিক কোন্ জীবাণুর কারণে হয়েছে, এখনো ধরা যায়নি। এঁদের মধ্যে সাতজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
তথ্যটি চমকপ্রদ। তবে তার চাইতেও চমকপ্রদ হলো, আরেকখানি লেজুড় ইনফর্মেশন। এই সাতাশ জনের প্রায় সকলেই উঁহ্হানের সী ফুড হোলসেল মার্কেটের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত। হয় তাঁরা সেখানে কাজ করেন, নাহয় তাঁরা সেই মার্কেটের খরিদ্দার, আর নয়তো এইরকম কোনো মানুষের আত্মীয় পরিজন।
এ কয়টি তথ্য, স্বাস্থ্য বিশারদদের কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। হোক না রোগীর সংখ্যা মোটে সাতাশ। কিন্তু, ১. তাঁদের রোগের জীবাণুটিকে এখনো চেনা যায়নি। ২. সক্কলেই একটি কমন লিংক/সোর্স দেখাচ্ছেন ( সী ফুড হোলসেল মার্কেট)।
পদক্ষেপ নেওয়া হলো তড়িঘড়ি। নতুন বছরের প্রথম দিনেই তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হলো মার্কেটটিতে। ‘আইসোলেশন’ অর্থাৎ জনগণের থেকে আলাদা করে দেওয়া হলো সাতাশ জনকেই। রাখা হলো হাসপাতালের স্পেশাল ওয়ার্ডে। এবং তারই সাথে জোরদার ভাবে খোঁজ শুরু হলো, এই জাতীয় আর কোনো নতুন রোগীর সন্ধান পাওয়া যায় কি না।
সন্ধান মিললো দ্রুত। পাঁচই জানুয়ারির হিসাব বলছে,– আরো বত্রিশ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। যাঁদের রোগের উপসর্গ ( কাশি, জ্বর, নিঃশ্বাসের কষ্ট) শুরু হয়েছে ১২ থেকে ২৯শে ডিসেম্বর ২০১৯ নাগাদ। অর্থাৎ, এই রোগীরা এতদিন ঘাপটি মেরে বাড়িতে বসেছিলেন।
মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৩২+২৭=৫৯
যাঁদের কারোরই রোগের জীবাণুটি ধরা যাচ্ছে না এখনও। এবং এই ছয়দিনে স্বাস্থ্যকর্মীরা মোটামুটি নিশ্চিত যে, এটি অজানা, অদেখা কোনো ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়ার কান্ড।
প্রথম জয় এলো নয় তারিখে। নাইন্থ জানুয়ারি, ২০২০। সিডিসি ( সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন ), সারা পৃথিবীর সামনে ঘোষণা করলো, ৫৯ জনের মধ্যে ১৫ জনের শরীরে পাওয়া গেছে নতুন প্রজাতির করোনা ভাইরাস। ( 2019 -nCoV )। ২০১৯ নোভেল করোনা ভাইরাস। দশই জানুয়ারি, যে ভাইরাসের ‘জিনোম সিকুয়েন্স’ তুলে ধরা হলো সমগ্র বিশ্বের সম্মুখে। আর সমস্ত স্বাস্থ্যবোদ্ধারা অবাক হয়ে দেখলেন– নতুন শত্রুর খোলনলচে।
এর ঠিক একদিনের মাথায় ঘটলো প্রথম পরাজয়। প্রথম মৃত্যু ঘটলো এই নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। তারপর ষোলই জানুয়ারি, আরো একজনের।
এবং শেষ খবর পাওয়া অব্দি, এই রোগ আর শুধু চিনদেশের উঁহ্হান শহরে সীমিত নেই। সারা পৃথিবী জুড়ে মোট এক লক্ষ দু হাজার একশো বত্তিরিশ জন আক্রান্ত হয়েছেন করোনা ভাইরাসে। ভারতবর্ষে, ৩১ জন।
বারোই জানুয়ারীতে নামকরণ করা হয়েছে যে ভাইরাসের —
SARS-CoV-2। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনা ভাইরাস ২।
কেন ২? কেন ১ নয়?
সেসবে আসছি পরে।
দুই
বিশ্বজিৎদা আমার বড্ডো প্রিয় একজন মানুষ। ডঃ বিশ্বজিৎ রায়। প্রথমত, এরকম টগবগে, চনমনে, উৎসাহী, কর্মোদ্যমী মানুষ আমি খুব একটা দেখিনি। দ্বিতীয়ত, এই ভদ্রলোকই আমাকে এক প্রকার জোর করে তুলে এনেছিলেন জলপাইগুড়ি টিবি হাসপাতালে। প্রায় তিন বছরের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের একঘেয়ে জীবন ফেলে, শহর জলপাইগুড়ির স্বাদ চাখবার সুযোগ মিলেছিল আমার।
সময়টা তখন দু হাজার দশের শেষাশেষি। এক হাড় কাঁপানো ঠান্ডার সন্ধ্যাতে সাপ্টিবাড়ি প্রাইমারি হেলথ সেন্টার সংলগ্ন কোয়ার্টারের বারান্দাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি আমি তখন। সামনের মাঠে, ঠাসা কুয়াশা। কুয়াশা আমার ওই ব্যালকনিতেও। কপাল, ঠোঁট, নাকের আগা আর হাতের আঙুল ভিজে ভিজে যাচ্ছে হিমশীতল কুয়াশা পরশে। বাদবাকি অংশ, গরম জামা কাপড়ে ঢাকা। সহসা, চরাচর ব্যাপী নিস্তব্ধতা খানখান করে বিচ্ছিরি শব্দে আর্তনাদ করে উঠল আমার নোকিয়া । চমকে উঠে, চায়ের কাপ মাটিতে নামিয়ে, পকেট থেকে ফোনটা বের করতে করতে আবিষ্কার করলাম, আমার হাতগুলো অবশ হয়ে গেছে প্রায় পুরোপুরিই। আর ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট স্ক্রিনে ব্লিংক করছে–‘ডি.টি.ও’। অর্থাৎ ডিস্ট্রিক্ট টিবি অফিসার।
পরবর্তী কথোপকথনটা হলো নিম্নরূপ–
— সব্যসাচী…
— হ্যাঁ বলুন স্যার
— তোকে ভাবছি সদরে তুলে নিয়ে আসবো। টিবি হাসপাতালে।
— স্… সদরে? জলপাইগুড়ি?
— হুম! মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবির জন্য এই হাসপাতলটা সিলেক্ট হয়েছে। নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজেই হওয়ার কথা ছিল। শিলিগুড়িতে। ওদের মুখের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি আমি। ইট উইল বি অ্যান অনার অ্যান্ড প্রাইড ফর জলপাইগুড়ি। অ্যান্ড… আই ওয়ান্ট ইউ দেয়ার। তোকে চাই আমার এখানে।
— জ্.. জলপাইগুড়ি টাউন? সো… সত্যি বলছেন? স্যার?
— হুম। সি এম ও এইচ-এর সাথে কথা হয়ে গেছে। বণিক স্যার তোকে চেনেন। খোঁজ খবর রাখি আমরা সবাই। ইউ আর দা ম্যান। চলে আয়। অর্ডার হাতে পাবি শিগগিরই।
— স্যার…
— অনেক আশা নিয়ে তুলে আনছি সব্যসাচী। আমার নাক কাটাস না। চাপ আছে। প্রচুর চাপ আছে কাজের এখানে। নতুন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা না কিন্তু! রাজি আছিস?
— হ্যাঁ.. হ্যাঁ স্যার
— গুড। চেপে রাখ খবরটা। কেউ কাঠি করতে পারে। রাখছি। বাই।
এর ঠিক দেড় মাসের মাথায় জলপাইগুড়ির রাণী অশ্রুমতী টি বি হাসপাতালের দায়িত্ব নিই আমি। একা। সিঙ্গল হ্যান্ডেড। পশ্চিমবঙ্গে তখন সদ্য শুরু হয়েছে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবির চিকিৎসা। দক্ষিণে, যাদবপুর কে এস রয় হাসপাতালে। আর উত্তরে, এই আমার এখানে। নির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন তৈরি হয়নি তখনও এম.ডি.আর টিবির চিকিৎসার। যেটুকু যা আছে, সবটাই ফ্লেক্সিবেল। নমনীয়। পরিস্থিতি বুঝে পরিবর্তন ঘটানোর সুযোগ আছে চিকিৎসা পদ্ধতির। পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, সমগ্র ভারতবর্ষ তখনো শিখছে এ রোগের চিকিৎসা। শিখছে, আর আবারও নতুন করে শিখছে, দৈনিক নিত্য নতুন ‘কেস স্টাডি’ করে। সেই যুদ্ধের প্রথম দফা থেকে যোগদান করলাম আমিও।
*****
যেহেতু, তখন জাস্ট শুরুয়াৎ, সেইহেতু বিবিধ প্রশ্ন আর বহুবিধ অজানা ভয় কাজ করত আমাদের মনে। বিশেষত, রোগটি যখন প্রাণঘাতী। বিশেষত, রোগটি যখন সংক্রামক। ছড়িয়ে যায় একজনের থেকে অন্যজনের মধ্যে।
আর ঠিক এইরকম একটা সময়েই ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন (WHO) আর ইউনাইটেড স্টেটস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ( USFDA)-এর যৌথ উদ্যোগে, একটা ভিজিট কাম ট্রেনিং হলো আমার হাসপাতালে।
যাঁরা এসেছিলেন, এবং যাঁরা ট্রেনিং দিয়েছিলেন, সকলেই ‘এয়ারবোর্ন ইনফেকশন কন্ট্রোল’/ ‘বাতাসে ছড়িয়ে পড়া অর্থাৎ বায়ুবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ’ দপ্তরের আন্তর্জাতিক দিকপাল।
প্রথম ট্রেনিংটা পেলাম হাসপাতালেই।
আর দ্বিতীয়টার জন্য যেতে হলো কোলকাতা। সেইবারেই প্রথম ফাইভ স্টার হোটেলে থাকবার সুযোগ পাই আমি। বদান্যতায়, ওই WHO এবং USFDA।
যা শিখেছিলাম, ঠিক তাই তাই দরকার এই করোনা ভাইরাস আটকাতে হলেও। বস্তুত, যেকোনো রোগ, যা হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ছড়ায়, সে রোগ টিবি হোক বা করোনা, নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি একই।
আমরা সেসব মেনে চলি না।
আমরা… সেসবেরই মূল্য চোকাচ্ছি।
তিন
ট্রেনিং-এর মূল বক্তব্য ছিল খুব সিম্পল। ভালো করে, মন দিয়ে পড়বেন। এই কয়টি মেনে চললেই আপনাদের ‘অধুনা আতঙ্ক’ করোনা ভাইরাস তো নিয়ন্ত্রিত হবেই, সাথে সাথে থেমে যাবে টিবি রোগও।
জানেন কি যে, করোনা ভাইরাসে এ যাবৎ সব মিলিয়ে মারা গেছেন ৩৪৮৮ জন? আর টিবি রোগে প্রতিদিন, প্রত্যেকটি দিন মারা যান প্রায় ৪৩২০ জন?
আসুন, নিয়মগুলি বলি।
১. হাঁচি বা কাশির সময়,
তালু নয়,
বাহু ঢেকে হাঁচুন/ কাশুন (নিচে ছবি দ্রষ্টব্যঃ ), দৈনন্দিন কাজের সময় করতল বারবার ব্যবহার হয়, তাতে সংক্রমণ ছড়ায়।
২. হ্যান্ডশেক পরিত্যাগ করে, মেক ইন ইন্ডিয়া এবং সত্যজিৎ খ্যাত, “কেমন আছেন নমস্কার” করুন।
৩. যেখানে সেখানে কফ থুথু ফ্যালা বন্ধ করুন।
৪. কথায় কথায়, নাকে মুখে কিংবা চোখে হাত দেওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন। এতে ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
৫. খামোখা সিঁড়ির হাতল ধরে ওঠা নামা করবেন না।
৬. সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক পরে লাভ নেই খুব একটা। এমনকি N 95 জাতীয় মাস্ক পরেও নয়। কারণ, যদি সঠিক পদ্ধতিতে আপনি N 95 পরেন, অর্থাৎ টেনে ব্যান্ড বেঁধে এবং নাকের ব্রিজ চেপে, তবে এই মাস্ক পরে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। দম আটকে আসে। দ্বিতীয়ত, এই মাস্ক পরলেও সংক্রমণ আটকানোর সম্ভাবনা 95%। টিবি কিংবা করোনা ‘ড্রপলেট’ এর মাধ্যমে ছড়ায়। সেই ড্রপলেট আটকাতে হলে বরং উল্টে, যারা হাঁচি বা কাশিতে ভুগছেন, মাস্ক পরা উচিত তাঁদেরই। সেটা, সাধারণ সার্জিকাল মাস্ক হলেও চলবে।
৭. চেষ্টা করুন খোলা মেলা আবহাওয়ায় থাকতে। বিশেষত, যাঁরা স্বাস্থ্যকর্মী। যাঁদের প্রতিনিয়ত দেখতে হয় হাঁচি কাশিওয়ালা রোগীদের।
এয়ার কন্ডিশন্ড চেম্বার এড়িয়ে চলুন। দরজা জানালা হোক খোলামেলা। বাতাস যেন চলাচল করতে পারে এপাশ থেকে ওপাশে।
তথ্য বলছে, কোনো ঘরের বাতাস যদি প্রতি ঘন্টায় দশ থেকে পনেরো বার ফ্রেশ হাওয়া দিয়ে রিপ্লেসড হয়, তবে সেই ঘরে বাতাস বাহিত রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। আর তার জন্য চাই খোলামেলা আবহাওয়া। এই একই নিয়ম মেনে চলুন যাঁরা বদ্ধ কামরায় কাজ করেন। আপনার রুমটিতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিন। এখনই। আজ্ঞে হ্যাঁ। এই ক্ষণেই। দেখুন, আলমারি বা কোনো চেয়ার টেবিল জানালা ব্লক করছে কিনা। করলে, সেগুলো সরিয়ে অন্যত্র রাখুন।
দুর্ভাগ্য বশত, আমরা যত আধুনিক হচ্ছি, ততই আমাদের ‘এ.সি’ প্রীতি বাড়ছে।
যদি সম্ভব হয়, সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করে এ.সি হঠিয়ে জানালা দরজা খুলে রাখার চেষ্টা করুন। এতে গরম লাগবে। ঠান্ডাও। তবে, প্রাণে বেঁচে যাবেন। করোনা ভাইরাস তো নস্যি বিষয় দাদা। টিবিতে মরে যাবেন নয়তো।
৮. খাওয়ার আগে হাত ধুয়ে নিন সাবান দিয়ে কচলে কচলে। অন্তত কুড়ি সেকেন্ড ঘড়ি ধরে। যদি সাবান না থাকে ‘ হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ ব্যবহার করতে পারেন। তবে দেখে নেবেন তাতে যেন মিনিমাম 60% অ্যালকোহল থাকে।
৯. মোটামুটি ৪০ বছরের পর থেকে, বছরে একবার করে সুগার টেস্ট করান। সুগার নরমাল হলে কেয়াব্বাত! চলুন ফাটিয়ে মস্তি করি। কিন্তু সুগার/ডায়াবেটিস ধরা পড়ে যদি, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ডায়াবেটিস নিঃশব্দ ঘাতক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে বেশ দেরিতে। এবং, ডায়াবেটিস রোগীদের শুধু করোনা কেন, যেকোনো সংক্রামক রোগ হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি।
১০. ( এটা ট্রেনিং-এ ছিল না। আমি জুড়েছি। বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে)
এইটি, সম্ভবত বর্তমান দুনিয়াতে, সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের একটা। তাই শেষ পাতে দিলাম। নলেন গুড়ের টাটকা মিষ্টি, লাস্টেই দেওয়া নিয়ম।
হোয়াটসঅ্যাপে বা মেসেঞ্জারে অনেক মেসেজ পাবেন। করোনা বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে। সেইটে চারপাশে ‘ ফরোয়ার্ড’ করে দেওয়ার আগে একটু খতিয়ে দেখুন। জেনে নিন, বিষয়টা গুজব কিনা। ঠিক যেমন গুজব ছড়ায় দাঙ্গা নিয়ে। কিংবা UNICEF/ ইউনিসেফ-এর নামে যেসব গুজব ছড়াচ্ছে করোনা ভাইরাস ঘটিত।
© ডঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত
চার
দু হাজার দুই-তিন সালে ঠিক এইরকমই একটি ঘটনা ঘটেছিল। সেটিরও শুরুয়াৎ চিনদেশে। অনেকেই তাকে চেনেন সার্স নামে। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম। SARS ।
মজার বিষয় একটাই। প্রায় সকল সাধারণ জনতাই ভুলে মেরে দিয়েছেন যে, এই সার্স রোগটিও হয়েছিল করোনা ভাইরাসের কারণেই। তবে সেই ভাইরাসের ‘জিনোম’-এর গঠন ( খোল নলচে) ছিল কিছুটা আলাদা।
এই ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল বাদুড়ের মাধ্যমে। বাদুড় থেকে রোগ ছড়ায় ভাম জাতীয় বিড়ালে। তারপর সেখান থেকে অন্যান্য জীব জন্তুতে। যেমন ব্যিভার বা রেকুন। চিনদেশে ব্যিভার এবং রেকুন নামের প্রাণীরা খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সেখান থেকেই ছড়িয়ে যায় মানুষের মধ্যে। ছড়ায়, এই সব প্রাণীদের কাটাকুটি করতেন যাঁরা, সেইসব কসাইদের মাধ্যমে। মাংসের মাধ্যমে নয়। হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ছড়াতো এই রোগ। এই করোনা ভাইরাসের নাম দেওয়া হয়েছিল SARS-CoV-1।
এ যাত্রায় তাই নাম দেওয়া হলো SARS-CoV-2। কারণ এই করোনা ভাইরাসের গঠন, পূর্বতন ভাইরাসের থেকে পৃথক।
দয়া করে চিন দেশকে গালি দিতে বসবেন না। চিৎকার শুরু করবেন না—” শালারা যা খুশি খায়”।
মাথায় রাখবেন আপনাদের প্রিয় গরু/ গাউমাতা-র শরীরেও টিবি ব্যাকটেরিয়া ( অ্যাটিপিক্যাল) বসবাস করে।
পাঁচ
কতকগুলি প্রশ্নোত্তর সেরে নেওয়া যাক শেষপাতে।
প্রঃ কী ভাবে এই রোগ ছড়ায়? মানুষ থেকে মানুষে?
উঃ যে যা খুশী বক্কা মারুক, এ রোগের মোড অফ ট্রান্সমিশন ( ছড়ানোর পদ্ধতি) সঠিক ভাবে জানা যায়নি এখনো। যথেষ্ট তথ্য নেই। তবে, এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্য থেকে অনুমান করা হচ্ছে, এই রোগটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে।আর তাই, উপরিউক্ত নিয়মগুলি মেনে চলুন।
প্রঃ এ রোগে মরে যাওয়ার সম্ভাবনা কতখানি?
উঃ সে বিষয়ে মন্তব্য করার মত যথেষ্ট তথ্যও এখনো হাতে আসেনি। এটা বিজ্ঞান। এটা স্ট্যাটিসটিক্স। যা খুশি একটা বকে দিলেই হলো না হোয়াটসঅ্যাপে।
প্রঃ তাহলে কি এ রোগে লোক মরে না?
উঃ অবশ্যই মরে। তবে এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে যে, এটি ২০০৩ এর করোনা ভাইরাসের থেকে কম ক্ষতিকর। এই করোনা ভাইরাসে মরে সাধারণত বুড়ো বুড়িরাই। মরে প্রধানত তারাই, যাদের ইমিউনিটি কম। এগারোই জানুয়ারি যিনি মারা গিছলেন তাঁর বয়স ছিল একষট্টি বছর। ভদ্রলোকের ক্যানসারও ছিল। ষোলই জানুয়ারি যিনি মারা গিছলেন, তাঁর বয়স ছিল ঊনষাট বছর। এই ভদ্রলোকের সম্ভবত টিবিও ছিল।
প্রঃ কতদিন সময় লাগে এই রোগটি হতে?/ ইনকিউবেশন পিরিয়ড কত?
উঃ এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দুই থেকে চৌদ্দ দিন।
প্রঃ তেরোই ফেব্রুয়ারী এবং তার পর থেকে হঠাৎ করে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেল কেন? তার মানে কি আমরা হেরে যাচ্ছি?
উঃ আজ্ঞে না। একথা সত্যি যে তেরই ফেব্রুয়ারীতে ১৫১৪১ জনের নতুন সন্ধান পাওয়া গেছে। যেটা আশ্চর্যই বটে। তবে তাইতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এর আগে স্রেফ ল্যাবরেটারিতে যাঁদের নমুনাতে করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে, তাঁদেরই রোগী ধরা হতো। তেরই জানুয়ারি থেকে যেকোনো নিউমোনিয়া রোগীকেই সম্ভাব্য করোনা ধরা হচ্ছে চিন দেশে। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘চেঞ্জ অফ কেস ডেফিনেশন’। এই ‘কেস ডেফিনেশন’-এর আরো একবার পরিবর্তন হয় ২০শে ফেব্রুয়ারি। ফলত, সেইদিন রোগীর সংখ্যা কমে যায় ফট করে। এসব মেডিক্যাল কচকচি। এসবের উপর ভিত্তি করে সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত/ উল্লসিত হওয়া অনেকটা ফ্লাইটে বসে ” প্লেনটা খুব জোরে উড়ছে মনে হচ্ছে” বলার মতো। অর্থাৎ, বালখিল্য। বাল তুল্য।
প্রঃ এই রোগ আটকে দেওয়ার কি কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে?
উঃ জি নেহি হুজুর। আজ্ঞে না সাহিবাঁ। ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে আপনি অনেক গুজবই পাবেন। যথা– গরুর পেচ্ছাপ খেলে/আয়ুষ বা হোমিওপ্যাথি আবিষ্কৃত বড়ি খেলে , করোনা ভাইরাসের মূ্র্তি বানিয়ে পূজা করলে ( কার্টেসি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ) , তেলাপিয়া মাছ বা মুরগি না খেলে, চায়নার আবীর না মাখলে করোনা হবে না।
এগুলো সবই… আই রিপিট সবই… ঢপের চপ।
প্রঃ মাংস খাওয়া কি এ সময়ে বিপজ্জনক?
উঃ না। যদি রান্না করে মাংস খান, কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই। চাইলে আমাকে নেমন্তন্নও করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, রান্না সুসিদ্ধ, সুপক্ক হওয়া চাই। আধাখ্যাঁচড়া রান্না হওয়া মাংস যাঁরা খান সাহেবি কেতাতে, তাঁদের শুধু এখনই নয়, ভবিষ্যতেও বহুবিধ রোগ হতে পারে।
এ মুহূর্তে পাওয়া তথ্য মোতাবেক, কাঁচা মাংস নিয়ে নাড়াঘাঁটা, যেমন ম্যারিনেশন/ নুন হলুদ মাখিয়ে রাখা অথবা মাংস ধোয়া, এসবে করোনা ছড়াচ্ছে কিনা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে এটুকু নিশ্চিত তথ্য যে, কাঁচা মাংস নাড়া ঘাঁটার পর যদি ভালো করে সাবান জল দিয়ে হাত ধুয়ে নেন, তবে আজ আপনার করোনাও হবে না, ভবিষ্যতেও অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাবেন।
মোটমাট কথা, শুধু আজকের জন্য নয়, সারা জীবনের জন্য এগুলো মেনে চলুন। এগুলো ‘সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি’।
প্রঃ দশ সেকেন্ড নিঃশ্বাস ( পড়ুন প্রশ্বাস) আটকে রাখতে পারেন না যাঁরা, তাঁরাই কি এ রোগে আক্রান্ত?
উঃ দাদারা/ দিদিরা, হাসাবেন না। হাসাতে হলে কমেডি সার্কাস দেখুন।
প্রঃ হাঁচি বা কাশি হলে কি ভয়ের ব্যাপার?
উঃ না। ভারতবর্ষে করোনা এখনো সেভাবে হয়নি কিছুই। মহামারী/ এপিডেমিক তো দূরের কথা! তবে হ্যাঁ! হাঁচি, কাশি, জ্বর হলে ডাক্তারের কাছে যান। বাকিটা উনিই বুঝে নেবেন।
প্রয়োজনে 01123978046 নাম্বারে ফোন করবেন। এটা ন্যাশানাল করোনা হেল্পলাইন নাম্বার।
© ডঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত
ছয়
সেবার ওই কোলকাতার পাঁচাতারা হোটেলের ‘এয়ার বোর্ন ইনফেকশন কন্ট্রোল’ সেমিনার থেকে ফিরে আসা ইস্তক আমি আমূল বদলে গেছি। আমি সেই ২০১১ থেকেই মুখ ঢেকে হাঁচি কাশি। অন্যদের শেখাই। রাস্তায় কেউ থুতু ফেললে খিস্তাই। কর্মক্ষেত্রের দরজা জানালা খোলামেলা রাখি। ইনফ্যাক্ট SARS-CoV-2 পয়দা হওয়ার ঢের ঢের আগে থেকেই আমি এ বিষয়ে নাগাড়ে লিখে যাচ্ছি।
একটা গোপন কথা বলে যাই। আমার হাসপাতালেরর প্রতিটি দরজা জানালা খুলিয়ে রাখি আমি দিনরাত। প্রতিদিন বুঝিয়ে বুঝিয়ে এইটেই এখন জলপাইগুড়ি টিবি হাসপাতালের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাই, আমি আর ওই বিশ্বজিৎ দা ( তৎকালীন ডি টি ও) মিলে ষড় করে, সরকারকে দিয়ে গরম মোজা আর মাঙ্কিটুপি কিনিয়েছিলাম। শীতের রাতের খোলা জানালায় পেশেন্টরা কষ্ট পাবে বলে।
এ হাসপাতাল বাদেও অন্যত্র মাঝে মাঝে এমার্জেন্সি ডিউটি করতে হয় আমায়। আমি ভারী আশ্চর্য হয়ে দেখি, সেসব জায়গাতে রাতের বেলা সব জানালা দরজা বন্ধ করে রোগীরা এবং সিস্টাররা বসে থাকে। আতঙ্কিত হয়ে শুধিয়েওছি আমি সিস্টার বা সে হাসপাতালের ডাক্তারদের বহুবার। সবাই মাছি নাড়ার মত হাত করে বলেছে–” ধুর… এরা বললে শোনে না।” তো, সারা দুনিয়া বদলানো আমার সম্ভব নয়। তবে অন্য কোনো হাসপাতালের ওয়ার্ডে গেলেই আমি আগে জানালা খোলাই। রোগীরা গড়িমসি করলে, খিস্তি মারি টেনে।
এসব, আমার রক্তে মিশে গেছে।
সাত
লেখাটা এবার শেষ করবো। ভালোই হলো। সাতটা চ্যাপ্টার হলো। পোয়েটিক জাস্টিস। কাব্যিক সুবিচার। কারণ, এই করোনা ভাইরাসটি এ যাবৎ পাওয়া সাত নম্বর করোনা ভাইরাস, যেটি মানুষকে আক্রমণ করেছে।
যাক সে কথা। এ লেখা লিখতে লিখতেই ফোন করেছিলাম এক WHO উপদেষ্টাকে। অনিকেত চৌধুরী। তো হাসছিলাম আমি ফোনে–” অনিকেত, এতদিন ধরে আমরা বলে আসছি। কেউ শুনছে না। ভাগ্যিস করোনা এলো। তাই লোকে হাঁচি কাশিতে মুখ ঢাকার কথা শুনছে। অন্তত কিছুদিন হলেও টিবি ইনফেকশন কম ছড়াবে। বলো? জয় করোনা মাইয়া কি।”
অনিকেতও হাসলো। বললো–” প্রিসাইজলি! মাই পয়েন্ট..”
প্রতি কুড়ি সেকেন্ডে একজন টিবি রোগী মারা যায় এ পৃথিবীতে। সারাদিনে, প্রায় সাড়ে চার হাজার। ভারতবর্ষের তিনভাগের এক ভাগ মানুষের শরীরে টিবির জীবাণু আছে। সে জীবাণু অপেক্ষা করছে ঘাপটি মেরে। ইমিউনিটি এতটুকু কমলেই, সুগার বা ক্যানসার হলেই তেড়েফুঁড়ে উঠবে। তবুও কারো হেলদোল নেই। সব্বাই সেই একই বুলি আউড়ে যাচ্ছে—” ধোর শালা! টিবি হয় রিকশাওয়ালাদের। ” আর টিবি বেড়ে চলেছে। এমন ভাবে বাড়ছে যে, যদি এই রেট বজায় থাকে, তবে আপনাদের সব্বার নাতি নাতনির টিবি হবে।
হাতজোড় করে বলছি, তিন নম্বর চ্যাপ্টারে বর্ণিত সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন সারা জীবন। শেখান সব্বাইকে ঘাড় ধরে। প্রয়োজনে ঝগড়া করুন। যে মানুষ প্রতিদিন দরজায় তালা দিয়ে বাইরে যায়, তার চোরের ভয় নেই। আর আপনারা যেটা করছেন সেটা হলো কতকটা এইরকম– পাড়ায় নতুন চোর এসেছে! এবার তাইলে ক’টা দিন দরজায় তালা দিই।
ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।
———————————————–
08/03/2020
© ডঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত
পুঃ ডেট অর্থাৎ তারিখটা দিলাম একটাই কারণে। যা লিখেছি, সব আজ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের হিসাব। যেইহেতু এটা বিজ্ঞান, তাই কাল এটা নতুন তথ্যের উপর নির্ভর করে পাল্টে যেতে পারে।
আবারও পুনশ্চঃ
প্লিজ কমেন্টে লিখবেন না যে–” অনুমতি দিন। শেয়ার করবো।” অনুমতি আমি দিয়ে দিলাম। এরপরেও লিখলে বুঝে নেব, আপনি একটি ফাল্তু লোক। কিছুই পড়েননি।
ট্রিপল পুনশ্চঃ
হোয়াটসঅ্যাপেও অনেকে কপি পেস্ট করবেন জানি। তাঁদের কাছে আমার দুটো আদেশ। ইয়েস ডিয়ার! অনুরোধ নয়। আদেশ। উইথ ভুরু কুঁচকানো হুমকি। — লেখাটার অংশ বিশেষ কপিপেস্ট করবেন না। সবটাই জরুরি। না হলে লিখতাম না।
আর আদেশ নাম্বার দুই, সঙ্গে নীচের ছবিটাও দেবেন। নয়তো সবটাই বেকার হয়ে যাবে।
************
সব্যসাচী সেনগুপ্ত
তথ্য ঋণ– WHO ( ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন)
[ একাধিকবার নিজের নাম উল্লেখ করেছি আমি। যেটা এর আগে কখনো করিনি। আজ করলাম। একটাই কারণ। এ লেখার সমস্ত দায়ভার আমার ]
দারুন লেখা।খুব ভালো এবং উপকারী পোষ্ট।
ভালো লিখেছেন ?
অনেক অজানা তথ্য জেনে গেলাম ।
টিবি ভাইরাস সম্পর্কে পরবর্তী আর্টিকেল টা লিখেন । ধন্যবাদ এবং বেস্ট উইশ আপনার জন্য ।
খুবই সময় – উপযোগী এবং সচেতনতামূলক লেখা।
কিন্তু আশ্চর্য এই আতঙ্কে শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব বাতিল হল সরকারি ভাবে ! আর মায়াপুরের দোল উৎসবে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ মাস্ক পরেই রেহাই পেলেন !!!
Ami jokon class 8 e portam tokon amr chest TB dhora pore. Seta 2007 sal.ami dr. Manish pradhan r under e treatment korai 1.2years. Amr ki bhobissot e multi drug resistant TB howar possibility ache ?
খুব দরকারি লেখা। অনেক ধন্যবাদ লেখককে।