প্রিয় বন্ধু
অনেকদিন পর লিখতে বসছি তোকে। যদিও তোর ঠিকানা জানা নেই, তবুও আজ আমি লিখবো। এই মাঝবয়সে এসে এটুকু অন্তত বুঝেছি মনের কথা সময়মতো বলতে না পারলেও, পরে কখনো সুযোগ পেলেই বলে ফেলতে হয়।
আজ এই বাদল মেঘে ঢাকা বর্ষার দুপুরে তোর কথা খুব মনে পড়ছে। আকাশে ভেসে থাকা জলে ভরা মেঘের সারি যেন আমায় ফিরিয়ে নিয়ে চলেছে ভারাক্রান্ত অতীতের খোঁজে।
ছোটবেলা থেকেই আমরা ছিলাম হরিহর আত্মা।
আমি পিঠে ইস্কুলের বড় ব্যাগ নিয়ে সকাল হলেই রওয়ানা হতাম কলকাতার রাজপথে। অন্যদিকে তুই ভর্তি হয়েছিলিস পাড়ার ছোট ইস্কুলে। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে পড়াশোনার পরিমন্ডলে আমি বড় হতে থাকলাম। তোর উপরে অবশ্য সেইরকম কোন চাপ ছিল না।
গুলি খেলে আর ঘুড়ি উড়িয়ে সব দুপুরগুলো কাটতো তোর। নিয়মের কড়া নিগড়ে বাঁধা আমি, জানালার গ্রীলে মুখ চেপে দেখতাম সেই ঘুড়ির উড়ে যাওয়া। এ বাড়ির ছাদ, ও বাড়ির চিলেকোঠা, সেই তাল গাছের মাথা আর ওই নারকেল বাগান ছাপিয়ে সেই অসম সাহসী ঘুড়ি, ঘুরতে ঘুরতে উঠে যেতো কোন সূদুর নীল আকাশের মাঝে…। আমি এক দৌড়ে ছাদের উপরে উঠে, দাঁড়িয়ে পড়তাম সেই রোদ ঝলমলে মধ্যাহ্নে। আর হাঁ করে দেখতাম ঘুড়ির সেই অপার্থিব উড়ান!
হায়,আমিও যদি পারতাম ওইরকম ঘুড়ি ওড়াতে!
গ্রীষ্মের কোন এক অলস দুপুরে পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়তাম বাড়ি থেকে, পাশের গলি’র বুড়ী’র বাগান থেকে পেয়ারা চুরি করতে যাবো বলে। তুই সন্তর্পণে গাছ বেয়ে উঠতিস আর আমি থাকতাম পাহারাতে। কোঁচড় পেতে দাঁড়িয়ে রইতাম ফলের অপেক্ষায়।
একটা একটা করে পেয়ারা ছুঁড়ে দিতিস তুই আমার কোলের ভিতর। আওয়াজ পেয়ে বুড়ীর চীৎকার শুরু হলেই একছুট্টে দুজনে পালিয়ে যেতাম সেই সবুজরঙা পুকুরপারে। ঝুড়িনামা বটগাছের খোঁদলে বসে একটু খানি নুন মাখিয়ে সে পেয়ারার স্বাদ আমি এখনো পাই রে!
বিকেলে রোদ্দুর একটু ঝিমিয়ে পরলেই চলে যেতাম ফুটবল খেলার মাঠে। টিম করে শুরু হতো ম্যাচ।
প্রথমে ঠিক করতে হতো দুই টিমের ক্যাপ্টেন। যারা বেছে নেবে খেলোয়াড়দের, বাকি ছেলেদের মাঝ থেকে। তুই সবার আগে সবসময় আমাকে ডাকতিস তোর টিমে। এর অন্যথা হয়নি কোনদিনও।
তারপর আরেকটু বড় হলাম আমরা। ইস্কুল পেরিয়ে কলেজের দিকে এগিয়ে গেল সময়। আমার ডাক্তারিপড়া ন্যাশনালে আর তোর আশুতোষ কলেজ। প্রথম সিগারেট, প্রথম মদের গেলাসে চুমুক। হাজরা মোড়ের কাছে সেই বারটার কথা মনে আছে তোর? আমার আজকাল পুরনো নামগুলো আর মনে পরে না রে।
প্রাইভেট বাসে ঝুলতে ঝুলতে নিউ এম্পায়ারে ৯০ পয়সার টিকিটের লাইনে গিয়ে দাঁড়াতাম দুজনে। গরমে খালি গায়ে সিঁড়িতে বসে দেখেছিলাম “দ্য টাওয়ারিং ইনফার্নো”। পল নিউম্যান আর স্টিভ ম্যাকুইন। মনে থাকার মতো সে যুগলবন্দী!
এসপ্ল্যানেডে সিনেমা দেখা আর বর্ষায় কাকভেজা ময়দানে ফুটবল ম্যাচ দেখে, ভেজা সিগারেট টানতে টানতে বাড়ি ফিরে আসা। সবই চলতে লাগলো একসাথে।
কলেজে পড়তে পড়তেই বাম রাজনীতির আবর্তে দু জনেই কখন যেন জড়িয়ে পড়েছিলাম। আশির দশক খুব সম্ভবত শেষ হচ্ছে তখন। এখনো মনে পড়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা আর দাঙ্গা বিধ্বস্ত শহর কলকাতা। ডিসেম্বরের শীত,১৯৯২ সাল। কারফিউ কবলিত শহরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাম্প্রদায়িক অশান্তির বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া আমাদের সকলের।
তোর মনে আছে, পাড়ায় প্রতিবারের দুর্গাপূজার আয়োজনের কথা? ঠাকুর আনতে যাওয়া থেকে বিসর্জন অবধি সে কি ভীষণ ব্যস্ততা আমাদের। একসাথে রাতজাগা আর বড় হয়ে ওঠার সেই দিনগুলো?
তখন ছোট্ট ক্লাবঘরের বেঞ্চি বাজিয়ে কিশোরকুমারের হিন্দি গান কি ভালো গাইতিস তুই গলা ছেড়ে!
মনে পড়ছে, প্রথম প্রেমে ঝাড় খেয়ে তোর সাইকেলের পিছনে বসে ই দুজনে পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই পুকুর পাড়ের বুড়ো বটের কোলে! আমাদের শৈশবে। পুকুরে ঢিল ছুঁড়ে জলে তার অনুরণন দেখতে দেখতে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এই প্রেমট্রেম আর কখনও নয়। ভাবলে হাসি পায় এখন। সেই আমি আবার প্রেমে পড়লাম। আবার তোকেই বলেছিলাম সেকথা।
তারপর আরও কতদিন চলে গেল। যেমনি করে নদী বয়ে যায়, হিসাব পাওয়া যায় না সময়ের। তোর রাজনৈতিক জীবন আর আমার পেশাদারি দায়িত্বের চাপে ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়তে থাকলো আমাদের সম্পর্কের।
কিন্তু দেখাসাক্ষাৎ কমে গেলেও বুঝতে পারতাম তুই আমার পাশে আছিস সবসময়। আমিও দূর থেকেই শুনতাম কতরকম সামাজিক এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে গেছিস তুই। দলের সাধারণ কর্মী থেকে ধীরে ধীরে এলাকার সর্বসাধারণের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিস। সর্বস্তরের মানুষের সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে দিচ্ছিস হাত। বুক ভরে যেত শুনে।
এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো।
কিন্তু আচমকাই নির্বাচনে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটলো আমাদের রাজ্যে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ব্রাত্য হয়ে গেলি তুই সমাজের কাছে। ক্রমশ জনপ্রিয়তার বৃত্তটা ছোট হয়ে আসতে লাগলো তোর।
বুঝতাম এই একা হয়ে যাওয়ার মানসিক যন্ত্রণা। তবুও এগিয়ে যেতে পারিনি তোর কাছে, পেশাদার জগতের চাপ আর সামাজিক বাধ্যবাধকতা ছেড়ে।
সারা জীবনের সাথী তোর মা, তোকে ছেড়ে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। আপন বলে আর বিশেষ কেউ ছিল না তখন। ভাইরাও ছিলেন নিজেদের কাজে ব্যস্ত।
হঠাৎই একদিন হাসপাতালে অপারেশন করতে করতে সংবাদটা পেলাম আমি। তোর ঘুমের মধ্যে চলে যাওয়ার খবরটা পেয়ে আমার হাতের স্ক্যালপেলটা থমকে গিয়েছিল সেদিন। মনের গভীরে এসে ভীড় করছিল স্মৃতির দল। কিন্তু আমরা পেশাদার কাঠিন্যে শিক্ষিত। তাই কাজ শেষ করে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম থিয়েটার থেকে। হয়তো তোরই জন্য।
সেদিন বাড়ির বারান্দায় শুয়ে ছিলিস তুই। কতদিন পরে যেন তোর বাড়ি এলাম আমি! চারিদিকে থৈ থৈ ভীড়।চারিদিকে আলোচনা হচ্ছে খালি তোরই কথা।
তোর ঘরের কোন, বিছানার চাদর এমনকি টেবলের উপর রাখা চারমিনার স্পেশালের প্যাকেটটা পর্যন্ত একই রকম ভাবে যেন তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। এখনো যেন বুঝতে পারছে না মানুষটার চলে যাওয়ার কথা।
তারা যেন অভিমান করে আমায় বলছে, “এতদিনে তোমার আসার সময় হলো বন্ধুর কাছে?”
আমার কুয়াশাজড়ানো চোখে শুধু ভাসছিল সেই চৌরঙ্গী ঘুড়িটার উড়ান, সেই সবুজরঙা পুকুরপার, সেই মা গঙ্গায় দুর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জন আর সেই কাদা মাঠে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে খালি গায়ে ফুটবল। সাইকেলের পিছনে বসে একসাথে মেয়েদের ইস্কুলে সরস্বতী ঠাকুর দেখতে যাওয়া।রাস্তার মিছিলে পায়ে পা মেলানো।
আমার শৈশব কৈশোরের সঙ্গীটি নয়, দেখে যেন মনে হচ্ছে আমিই শুয়ে রয়েছি ওই সাদা চাদরের উপরে। নিস্পন্দ।
আর এই প্রথমবার ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে গিয়ে অনেকবার ভুল হলো আমার। আসলে এটা যে আমাকে লিখতে হবে কোনদিন, সেটা ভাবা ছিল না যে!
সেটাই আমার সাথে তোর শেষ মোলাকাত। ওপার বলে কিছু আছে কি না জানা নেই। যদি থাকে হয়তো আবার দেখা হবে তোর সাথে।
সেইদিন কি আমার সুযোগ হবে বন্ধুর প্রয়োজনে তার পাশে না দাঁড়ানোর অপরাধের ক্ষমা চাইবার?
যখন তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরার কথা তখন তার কাছ থেকে দূরে সরে থাকার জন্য তুই করবি কি আমায় মাফ?
জানি না এ চিঠি তোর হাতে পৌঁছবে কিনা! তবুও লেখা। অনেক অনেক ভালোবাসা দিয়ে এই চিঠি ভরে দিলাম মেঘপিওনের খামে।
ছোটবেলার ঘুড়ি হয়ে উড়ে যাক সে সব সীমানা ছাড়িয়ে তোর কাছে।
ভালো থাকিস।
ইতি