পৃথিবীর তাবড় তাবড় রাজা মহারাজারা বহু তর্কবিতর্কের পর প্রায় সবাই একমত হয়েছেন যে গাধাকে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিলে সে ঘোড়ার মতোই ছুটতে পারবে। ঘোড়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে তাদের আস্তাবলে রাখা হবে এবং ঘোড়ার খাদ্য ও পরিচর্যা যেভাবে করা হয় গাধার বেলায়ও সেইভাবে করা হবে। আজ এই মাহেন্দ্রক্ষণে গাধার সেই পরীক্ষা নেওয়া হবে।
সুসজ্জিত ক্রীড়ামঞ্চ। বিশ্ব স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভর্তি। উত্তেজনায় সবাই থরথর করে কাঁপছে। প্রায় সারা পৃথিবীর রাজা-মহারাজারা হাজির হয়েছেন। একটু পরেই পরীক্ষা শুরু হবে। একে একে রাজা-মহারাজারা বেরিয়ে আসছেন আস্তাবল থেকে তবে ঘোড়ায় নয়, গাধার পিঠে চেপে। তাদের দেখে দর্শকেরা আরও একবার করতালিতে ফেটে পড়লেন। এদের সবার মুখেই মাস্ক লাগানো। কী একটা রোগের কারণে তারা মুখে মাস্ক লাগিয়েছেন। অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্য কথা প্রচার হয়েছে, মুখের দুর্গন্ধ ঢাকতে নাকি এই ব্যবস্থা। বিশেষত একজনের মুখের গন্ধ যদি অন্যর মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটায়, তাই নাকি মাস্কের বন্দোবস্ত হয়েছে। সেটা আবার ভাইরালও হয়ে গেছে।
এরকম একটা অনুষ্ঠানে মিডিয়া তার সুযোগ নেবে না তা তো হতে পারে না। আবার রাজা-মহারাজারাও বিনা আলোর ঝলকানিতে এই কসরতে নামতে চাইবেন কেন? শেষমেশ রফা হয়েছে মুখ ঢাকা থাকলেও তারা আবক্ষ উন্মোচিত হয়ে আসরে নামবেন। মুখ দেখা না গেলেও বুক তো দেখা যাবে। এতদিন রাজারা মুকুট, শিরস্ত্রাণ ইত্যাদির আকার, আয়তন, রঙ ইত্যাদি নিয়ে নিজেদের সাজাতে অভ্যস্ত ছিলেন। এবার ক্যামেরার সামনে তারা বুকের সৌন্দর্য কী করে তুলে ধরবেন তা নিয়ে শুরুতে ধন্ধে পড়েছিলেন অনেকেই, তবে ইতিমধ্যে কার ছাতি কত চওড়া তা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে উঠেছে। কেউ আবার বুকে গোবর লেপেছেন, কেউবা উল্কি কেটেছেন, কারওর বুকের রঙ সাদা কিন্তু লোমশ, কারওর বা একটু কালচে, কারওর বুক চাঁছাছোলা, সেসব হুবহু তুলে ধরতে ক্যামেরাম্যানরা বিভিন্ন কোণ থেকে ঘনঘন ছবি তুলে যাচ্ছেন। খেলা শুরু হতে কয়েক মিনিট বাকি। এদিকে মহারাজা সারাক্ষণই হম্বিতম্বি করে যাচ্ছেন। একে তাকে বকছেন, চেঁচামেচিতে তার মুখের মাস্ক বারে বারে খুলে যাচ্ছে, তা নিয়ে তিনি ফের ধমক দিলেন। সেটা মাস্কের উদ্দেশে না অন্য কারওকে লক্ষ্য করে সেটা বোঝা গেল না। এদিকে দর্শকেরা অস্থির হয়ে উঠেছেন। এই খেলা শুরুর আগে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এই দৌড়টা পাঁচশ না পাঁচ হাজার মিটারের হবে তা নিয়ে। দৌড়ের রাস্তার চারপাশে গাছপালা সব কেটে ফেলা হয়েছে, আশেপাশের বাড়িঘর সব গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চারদিক বেশ পরিষ্কার-সাফসুতরো — যদিও তারও ফাঁকে দুচারটে মানুষের কংকাল এবং হাড়গোড় এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। কি আর করা যাবে, শেষ মুহূর্তে কন্ট্রাক্টর টাকা ঝেঁপে দিয়ে পালিয়ে গেছে, পুরো কাজটা করে নি। কিছু মিডিয়া তা নিয়ে সরব হলেও রাজা-মহারাজাদের তাতে কিচ্ছুটি আসে যায় না। সামনে এখন এক ভীষণ পরীক্ষা। গাধারাও যে ঘোড়ার সমান ছুটতে পারে সেটা তারা প্রমাণ করে ছাড়বেনই, এমনই এদের ধনুকভাঙা পণ। শয়ে শয়ে গণিত বিশারদ ও সংখ্যা তত্ত্ববিদরা হাজির রয়েছেন, গাধার দৌড়ের পুংখ্যানুপুংখ মাপজোখ এবং সেই সব পরিসংখ্যানের আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণের কাজে। এবার বাঁশি বেজে উঠল। রাজা মহারাজাদের পাশে যে সব জ্ঞানীগুণীরা দাঁড়িয়েছিলেন কলমটা মুষ্টিবদ্ধ করে অনেকটা তির ছোড়ার ভঙ্গিমায় মাথার উপর তুলে হাঁক দিলেন, “হেইল— ” বাকিটা শোনা গেল না। দর্শকেরা চরম উত্তেজনায় ফুটছে এবং তাদের চিৎকারে কোনো কথাই আর শোনা যাচ্ছে না। রাজা মহারাজাদের সোনার চাবুক গাধার পিঠে ঘন ঘন আছড়ে পড়ছে, ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ লাইট যেন থামতেই চায় না। অন্যদিকে রাজা-মহারাজাদের বুকের লোম খাড়া হয়ে উঠছে রাগে। ঘামে বুকে লেপা গোবর উঠে যাচ্ছে, তবু গাধাদের গতি কিছুতেই বাড়ানো যাচ্ছে না। যথারীতি একের পর এক, শেষমেশ সব গাধাই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। দর্শকেরা হতাশ এবং বিচলিত। এবার রাজাধিরাজ ধূলি শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দর্শকদের দিকে স্বভাবসিদ্ধ যুদ্ধ জয় করার ভঙ্গিতে গলা উঁচু করে বললেন পরীক্ষা হয়েছে, সেটাই বড় কথা— ক্যামেরা আবার ঝলসে উঠল। রাজা মহারাজারা কি কখনও হারতে পারেন? এ তো গাধার পরাজয়, রাজা মহারাজারা এর বেশি আর কিইবা করতে পারেন?
বি দূ ষ ক উ বা চ
গাধাকে পিটিয়ে ঘোড়া বানানো যায় না। এক মাস কেন ছ-মাস লক ডাউন করলেও যে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে দেশে দেশে স্বাস্থ্য কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, তা কোনো মহামারীর ‘প্রতিঘাত’ আটকাতে পারে না। পারা সম্ভবও নয়। কোভিড-১৯ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও আমরা দেখি না। নাকি দেখতে চাইছি না— সেটাই প্রশ্ন। এসব রাজা-মহারাজাদের দেশে রোগীর জীবন রক্ষা করা তো বহু দূরের কথা, সামান্য মাস্ক আর ভেন্টিলেটর-ই জোগান দিতে পারে না।
বি ধি স ম্ম ত স ত র্কী ক র ণ
উপরিউক্ত চিত্রকল্পে যে সব চরিত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সে সবই কাল্পনিক। এর সঙ্গে বাস্তবের কোনো চরিত্রের কোনো মিল নেই। কেউ সেরকম মিল খুঁজে পেলে সেটা নেহাতই নিজের চোখের দোষ হিসেবে মান্য করবেন এবং প্রয়োজনে উপযুক্ত চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন। আর এর থেকে কেউ যদি কোনো রাজনৈতিক গন্ধ পেয়ে থাকেন তাহলে তাকে অনুরোধ করব, দ্রুত নিকটবর্তী কোনো কোভিড-১৯ পরীক্ষা কেন্দ্রে হাজির হতে (কিছু কিছু কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির ঘ্রাণের সমস্যা লক্ষণ হিসেবে থেকে থাকে)।
একটু অন্য রকম ভাবে তির্যক ভঙ্গি তে খুব সুন্দর লেখা হয়েছে স্যার।
নিদারুণ। ?