স্মৃতি নিয়ে সারা পৃথিবীতে যত সাহিত্য রচিত হয়েছে তাদের মধ্যে সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ রচনাটি মার্সেল প্রুস্তের ‘ইন সার্চ অফ লস্ট টাইম’। অনেকের মতে পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যে কয়টি উপন্যাস লেখা হয়েছে তার মধ্যে এটিই সর্বোত্তম। অনেক সমালোচক আবার এটিকে উপন্যাস বলতেই দ্বিধা বোধ করেছেন। আদ্রেঁ জিদ্ প্রথমে প্রুস্তের কাজকে তেমন গুরুত্ব দিতে চান নি। পরে তিনি স্বীকার করেছিলেন সেটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।
‘ইন সার্চ অফ লস্ট টাইম’ সাতটি খন্ডে লেখা প্রুস্তের ওপাস ম্যাগনাম। সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহদাকার উপন্যাস। প্রুস্তের এক আলোচক বলেছেন যে ইংরিজি ভাষায় সবচেয়ে দীর্ঘ বাক্যটিও নাকি প্রুস্তের লেখা। যদিচ প্রুস্ত ফরাসিতে লেখেন। পরে তা ইংরিজিতে অনুদিত হয়। (আমরা বাঙালিরা এই দীর্ঘ বাক্যের সাথে পরিচিত। আমাদের কমলকুমার বা শহীদুল জহীরের লেখায় আমরা সম্ভবত প্রুস্তের থেকেও দীর্ঘ বাক্য পেয়েছি।) ১৯০৮ সালে তিনি এটিকে লেখা শুরু করেন। পনের বছর পরে নভেম্বরে ১৯২২ সালে মাত্র ৫১ বছর বয়সে তার মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তিনি এই লেখা শেষ করেন। শেষের লেখাগুলো অগোছালো ছিল। পরে তার ভাই তাদের সংকলিত করে বই হিসেবে প্রকাশ করেন।
ছোটবেলা থেকেই প্রুস্ত অ্যাজমায় ভুগতেন। পরের দিকে এসে তা অত্যন্ত বাড়াবাড়ির দিকে চলে যায়। শেষে তিনি ডাক্তারও দেখাতেন না। পরিচারিকার কাছে কঠোর নির্দেশ ছিল কোনো পরিস্থিতিতেই যেন ডাক্তার না ডাকা হয়। মৃত্যুর দিন গুনতে গুনতে প্রুস্ত বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে পনের বছর ধরে তার মহাগ্রন্থ রচনা করে যান।
প্রুস্ত সম্পূর্ণভাবে নিজের স্মৃতির অতলে ডুব দিয়েছিলেন। খুঁজে দেখতে চেয়েছিলেন দৈনন্দিন প্রাত্যহিকতাতেও কিছু শিল্পের উপাদান লুকিয়ে থাকতে পারে কিনা। তার সমগ্র উপন্যাস জুড়েই তাই স্মৃতির অনুসন্ধান বা অনুধ্যান। এক অর্থে তিনি ধ্যানই করেছেন। তিনি যখন লিখতেন তার ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিতেন। ঘুলঘুলি কর্ক দিয়ে বন্ধ করে দিতেন। কোনোভাবেই যাতে বাইরের আলো, শব্দ তার ঘরে প্রবেশ না করে।
প্রুস্ত বিশ্বাস করতেন মানুষের জীবনের সত্য উদ্ঘাটন করতে হলে তাকে নিজের স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে হারিয়ে যাওয়া সময় ও স্থানের কাছে ফিরে না গিয়ে কোনো উপায় নেই। প্রুস্ত আরো বিশ্বাস করতেন প্রত্যেকের জীবনের সাধারণত্ব বা মিডিওক্রিটিকে সে শিল্পের মাধ্যমেই অতিক্রম করতে পারে। তার মনে হত প্রেম নয়, শিল্পই চিরকালীন। তিনি আরো বিশ্বাস করতেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ও প্রকৃতির খুব সাধারণ উপকরণের মধ্যেই শিল্পের রসদ লুকিয়ে আছে। তাই কোনো চিত্রকরকে ছবি আঁকতে গেলে কোনো সুন্দর ল্যান্ডস্কেপের কাছে ফিরে যাবার দরকার নেই। তার যা দরকার তা হল চোখ, দৃষ্টি। সেই কারণেই তার প্রিয়তম শিল্পী ছিলেন ডাচ চিত্রকর ভেরমেয়ার। যিনি দৈনন্দিন মানুষের জীবনের ছবি নিপুণ আলোছায়ার খেলায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
প্রুস্তের ওপাস আমি বেশ কিছুদিন ধরেই পড়ছি। পড়া শেষ হতে ঢের বাকি। যারা প্রুস্ত পড়েছেন তারা বলেন, এদের মধ্যে খ্যাতনামা দার্শনিক রোলা বার্থসও আছেন, প্রুস্ত পুনরায় পড়লে প্রতিবার নতুন লাগে। আমার মনে হয়েছে এটা তার লেখার স্টাইলের জন্যও কিছুটা হয়। তিনি যেহেতু তার স্মৃতির জগতে ঢুকে নিজে হারিয়ে গেছেন, এ যেন কিছুটা স্বপ্নেরও জগত, যেখানে চেতনা আংশিক অস্পষ্ট, তাই তার টেনে টেনে লেখা বাক্যগুলোর মধ্যে বহুমাত্রিকতা আছে। প্রুস্তের ওপাস তাই অন্য অর্থে যেন একটা সমগ্র কবিতা।
তিনি তার উপন্যাসের এক জায়গায় একটি বিশেষ ঘটনার কথা বলেছিলেন যেটি পরবর্তীকালে বহু আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। একদিন যখন তার মন প্রচন্ড বিষণ্ণ তখন তিনি ভেষজ চায়ের সাথে ‘প্যাটিট ম্যাডলিন’ নামে ছোট ছোট কেক যা প্যারিসে খুব জনপ্রিয় তা ডুবিয়ে খাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই সেসময় তার মন এক অভূতপূর্ব আনন্দে ভরে ওঠে। তিনি কিছুতেই এর কারণ বুঝতে পারছিলেন না। এরপর তিনি যতবারই চায়ে ভিজিয়ে সেই কেক খান না কেন সেই আনন্দ ফিরে আসে কিন্তু প্রতিবারই তার উদ্ভাস ধীরে ধীরে কমে যায়।
প্রুস্ত কিছুতেই তার কারণ বুঝতে পারছিলেন না। তিনি বিভিন্ন ম্যাডলিন ও চায়ের স্বাদ নিলেও সেই প্রাথমিক অনুভূতি আর ফিরে আসে নি। প্রুস্ত তখন অনুভব করলেন সেই আনন্দের স্মৃতি কেকের মধ্যে নয় তা লুকিয়ে আছে তার নিজের অন্তরে, লুকিয়ে আছে স্মৃতির অতলে। তার মনে পড়ল ছোটবেলায় একদিন যখন তিনি কমব্রেতে (উপন্যাসে উল্লিখিত শহরতলি) তার পিসি লিওনির ঘরে ঢোকেন তখন পিসি তাকে তার চায়ে ভিজিয়ে একবার ম্যাডলিন খাইয়ে দিয়েছিলেন। শৈশবের সেই স্বাদ ও গন্ধের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রচন্ড ভালোলাগা তার স্মৃতির মধ্যে এত বছর চাপা পড়ে ছিল। সেদিন তারা যেন কোন দৈব শক্তিতে জেগে উঠে তার বিষণ্ণ মনকে আনন্দে ভরে তুলেছিল।
সেই থেকে এই শৈশবের স্বাদ ও গন্ধের সাথে স্মৃতি ফিরে আসার এই উপলব্ধিকে অনেক মনস্তাত্বিকেরাই ‘প্রুস্তিয়ান ম্যাডলিন’ এই উপমায় চিহ্নিত করে থাকেন। আমি যা সামান্য কিছু পড়েছি তাতে আমার মনে হয়েছে প্রুস্ত তার এই স্মৃতির ভেতরে প্রবেশ করে নিজেকে খোঁজার প্রেরণা কিছুটা হলেও হিন্দু দর্শন থেকে পেয়েছিলান। তার উপন্যাসের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু দর্শন, আমাদের সমাজের বর্ণভেদের কথা আছে। আমার মনে হয়েছে ঔপনিষদিক আত্মানুসন্ধান তার অজানা ছিল না।
আধুনিক সাহিত্যে এসে দেখি হারুকি মুরাকামি তার ‘দ্য উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল’-এ সেই স্মৃতির অনুধ্যানের কথায় ফিরে এসেছেন। এই উপন্যাসের নায়ক তরু ওকাডা তার স্ত্রীর গৃহত্যাগের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এক পরিত্যক্ত কুয়োর ভেতর বসে স্মৃতির মধ্যে তলিয়ে গিয়ে জীবনের রহস্য উদ্ঘাটন করেছিলেন। সেই উপন্যাস পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে তাতে যেন প্রুস্তের ছায়া পড়েছে।
এগুলো যেহেতু সবই আমার মত নভিসের অনুমানমাত্র। তবু এই যে এক সাহিত্যের আরেক সাহিত্যের ওপর প্রবল ও আংশিক প্রভাব বা কখনো কখনো যা প্ল্যাজিয়ারিজমের মত অভিযোগের জায়গায় চলে যায়, তা কেন হয় তাই নিয়ে পরের পর্বেই আমরা আলোচনায় আসছি।
সাহিত্য ছেড়ে এবার শিল্পের দিকে চোখ ফেরানো যাক। আরেকজনের গল্প বলা যাক। তার কথা ড্যানিয়েল স্ক্যাটার তার ‘সার্চিং ফর মেমরি’ এই বইতে বলেছেন। ফ্রাঙ্কো ম্যাগনানি ১৯৩৪ সালে পন্টিটো নামে ইতালির এক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সাল অবধি তিনি সেখানে ছিলেন। তারপর বিশ্বভ্রমণ করবেন বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। ৭ বছর পর তিনি সান ফ্রান্সিস্কো শহরে আসেন এবং সেখানে এসে এক খারাপ জ্বরের কবলে পড়েন। অনেকদিন তার কোনো চেতনা ফেরে নি। সারাদিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ভুল বকতেন।
জ্বরের পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে ম্যাগনানির জীবনে। রাতের বেলা বা দিনের বেলা হঠাৎ করে তার চোখের সামনে ছেলেবেলার পন্টিটো হ্যালুসিনেশনের মত অবিকল ভেসে উঠত। ম্যাগনানি কখনও ছবি আঁকেন নি। কিন্তু তখন থেকে তিনি তার সেই গ্রামের ছবি আঁকতে শুরু করেন। তার হ্যালুসিনেশন হঠাৎ হঠাৎ আসত, আবার চলেও যেত। তিনি তাতে এতটাই নিয়োজিত হয়ে পড়েছিলেন যে কোনো পাবে বিয়ার খেতে খেতে সেই দৃশ্য সামনে এলে তিনি ছুটে বাড়ি গিয়ে ক্যানভাস নিয়ে বসে পড়ে ছবি আঁকতে শুরু করতেন।
সুসান সোয়ার্জেনবার্গ নামে একজন সাংবাদিক ম্যাগনানির পন্টিটো গ্রামে যান এবং তার ছবির সাথে মিল রেখে সেসব জায়গার ছবি তুলে আনেন। ম্যাগনানি একবার চলে আসার পর আর কোনোদিন তার গ্রামে যান নি। কিন্তু সুসানের ছবিতে দেখা যায় ক্যানভাস ও ফটোগ্রাফের মধ্যে আশ্চর্য মিল।
১৯৮৮ সালে সানফ্রান্সিস্কো সায়েন্স মিউজিয়াম ম্যাগনানির ছবি আর সুসানের ফটোগ্রাফ পাশাপাশি রেখে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সকলে ছবি আর বাস্তবের মিল দেখে হতবাক হয়ে যান। একটা কথা মনে রাখতে হবে ম্যাগনানি যে ছবি এঁকেছিলেন তা দেখে আমাদের পন্টিটোকে চিনতে কোনো অসুবিধে হয় না কিন্তু তার সব ছবিই তার কল্পনার রঙে আঁকা। ছবি দেখে করা ছবির নকল নয়।
ম্যাগনানির স্মৃতিতে অবচেতনায় তার গ্রামের যেসব ছবি বেঁচেছিল তিনি নিজেই তা কোনোদিন জানতেন না। সেই অবচেতন মনের ছবি অবিকল উঠে এসেছে তার ক্যানভাসে। এ থেকেই মনে হয় স্মৃতি কখনও হারায় না। অথচ তারা যে মনের অতলে বেঁচে আছে তাও আমরা ভুলে যাই। তা সচেতন মনের প্রয়াসে বা অলৌকিক ঘটনায় কখনও এভাবে উঠে আসতে পারে।
ইয়ুং ফ্রয়েডরই সূত্র ধরে বলেছিলেন যে অবচেতন মন সবকিছুই গচ্ছিত রাখে। এমনকি সেসবও রাখে যাদের আমরা সারাদিনে লক্ষ্য না করে অবহেলা করে গেছি। আমাদের মস্তিষ্কে যে ১২০ বিলিয়ন স্নায়ু আছে তাদের কোথাও না কোথাও তারা ঠিক জমা আছে। তারা কখনো কখনো উঠে আসে আমাদের স্বপ্নে। আর কখনো কখনো তারা আমাদের স্বভাব, ইগো বা অদ্ভুত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
(চলবে)