জানি ব্যাপারটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কারণ শ্লীল আর অশ্লীলের কাঁটাতারের বেড়াটা ভয়ংকর। কারো কাছে বেড়াটার কোনও অস্তিত্ব নেই। কিছু কিছু চ্যানেলে কমেডির নামে আদিরসাত্মক কথাবার্তার এমন ফোয়ারা ছোটে যে সবার সাথে টিভি দেখা দায় হয়ে যায়। আবার অশ্লীলতার দায়ে ব্যানড্ হয়ে যায় সমরেশ বসুর প্রজাপতি। দীর্ঘ বিচার চলে লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার নিয়ে। এমনকি একটা প্রবন্ধে পড়া গেল যে মহাকাব্য ওডিসিও নাকি আদিকালে সরকারি কোপে পড়েছিল। সুতরাং সেই সীমারেখাটি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অস্তিত্ব বদলায়।
এবার আসল গল্পে আসা যাক। গল্পটা প্রেমের হতে পারে। আবার একটা ছা-পোষা ডাক্তারের রুটি-রুজির প্রশ্নও হতে পারে। যে সব পাঠক এবং পাঠিকা অশ্লীলতা নিয়ে বেশি চিন্তান্বিত তাঁরা আর এগোবেন না। এক্সিট বাটনে ক্লিক করে অন্য লেখায় চলে যান। বিধিসম্মত সতর্কীকরণ জানানো রইলো।
গল্পটা পায়খানার রাস্তা নিয়ে। সোজা কথা পায়ুপথ নিয়ে। আরও সোজা ভাবে বলতে গেলে সেখানকার রোগ নিয়ে।
প্রথমে ছা-পোষা ডাক্তারের দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করি। সব ধরনের ডাক্তার নয়, যারা পেশায় সার্জন তাদের প্র্যাকটিসে নেমে কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। প্রথম প্রথম মনে হতো যে এটা আমার আজন্ম মাথায় তুলে বয়ে বেড়ানো কপালটারই দোষ। ফাটা কপালটায় ভালবেসে কেউ সেলাই করে দেয়নি। পরে আমারই সহপাঠী এবং রুমমেট, পরে যে আমারই মতো সার্জন হয়েছে আর একটা সাবডিভিশন হাসপাতালে রয়েছে – আমাকে আশ্বস্ত করে যে তার ক্ষেত্রেও এ ঘটনার ব্যতিক্রম নেই।
ভোরবেলায় ব্রেকফাস্ট করে চেম্বারে বসার পরপরই সবচেয়ে যে জায়গার রোগটা বেশি দেখতে হয় সেটা হলো পাছা। সমস্ত রোগীদের প্রায় তিরিশ শতাংশ পায়খানার দ্বারের রোগ নিয়ে আসে। ফলে সকাল থেকে চেম্বারে সাদা কালো রোমশ রোমবিহীন মোটা রোগা নোংরা পরিষ্কার নারী এবং পুরুষ পাছার ছড়াছড়ি। অধিকাংশই রোগগ্রস্ত এবং পূতিগন্ধময়। ব্রেকফাস্ট তো ছেলেমানুষ, অন্নপ্রাশনের ব্রেকফাস্ট পর্যন্ত ফ্যারিংক্সের কাছ পর্যন্ত উঠে দাপাদাপি করে। মাঝেমধ্যে মনে হয় মানুষের মুখ দেখলে আর চিনতে পারবো না। একদিন বাজারে এক ভদ্রলোক উবু হয়ে বসে মাছ দরাদরি করছিল। আমি রবিবার করে বাধ্যতামূলক ভাবে বাজার যাই। সেই ভদ্রলোককে গম্ভীর গলায় বললাম – “শ্যামবাবু, আপনি কিন্তু আমার কথা কিছুই মানছেন না। কতবার বলেছি যে পিঠের রোম পরিষ্কার না রাখলে আপনার আবার পায়লোনিডাল সাইনাস হবে!” ভদ্রলোক লজ্জিত। যতনা অন্তর্বাসের অধঃপতনের জন্য, তারথেকেও বেশি আমার কথা মানছেন না বলে। আমিও নিজে খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে শ্যামবাবুর মুখটা আমার মোটে চেনা লাগছে না। আপনমনে সুকুমার আওড়ালাম – “এমন গোঁফ তো রাখতো জানি শ্যামবাবুদের গয়লা।”
তো আমার একদম প্রথম দিকের এক রোগিণী আমাকে এক নার্সিংহোমে দেখাতে এসেছিলেন। পায়খানা দিয়ে রক্ত পড়ে। অল্পবয়সী এবং অপূর্ব সুন্দরী। সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর হবু বর। সেও উচ্চশিক্ষিত এবং বড় পদে কর্মরত। পেশেন্টের আব্দার, দেখতে হবে কিন্তু দেখা চলবেনা। কি অশান্তি! আমাদের সার্জারির সবথেকে চালু বই হল ‘বেলী অ্যান্ড লাভ’স শর্ট টেক্সটবুক অফ সার্জারি।’ সুমো রেসলারের মতো চেহারার বইটার নামে কি করে ‘শর্ট’ কথাটা আটকে থাকে সেটা গবেষণার বিষয়। সে যাকগে, সেই বইয়ে একটা বিখ্যাত লাইন আছে -‘If you don’t put your finger in, you might put your foot in it’ মানে তুমি যদি পায়খানার রাস্তায় আঙুল দিয়ে পরীক্ষা না করো তাহলে বড়ো বিপদে পড়ে যেতে পারো।
ছেলেটি বুঝলো, কিন্তু মেয়েটিকে বোঝাতে কালঘাম ছুটে গেল। প্রায় ঘন্টাখানেক লড়াইয়ের পর মেয়েটি রাজি হলো। ওটি টেবিলে বেশ কয়েকজন সিস্টারের উপস্থিতিতে পরীক্ষা করতে গিয়ে আমার চুল খাড়া। বেশ সন্দেহজনক একটা জিনিস আঙুলে ঠেকছে। তড়িঘড়ি ছেলেটাকে গিয়ে জানালাম। একটা টুকরো বায়োপসি নেওয়া প্রয়োজন। এবার ছেলেটি আমার সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বেশ সন্দিহান হয়ে পড়লো। নাহ্ মশাই, আপনাকে আর বায়োপসি নিতে হবে না। আমরা আমাদের মতো চলবো।
তারা চলে যাবার কয়েক সপ্তাহ বাদে মেয়েটির বাবা পরিচয় দিয়ে একজন এসে আমাকে একটা রিপোর্ট দেখালেন। বড়ো জায়গা থেকে তাঁরা পরীক্ষাটা করিয়েছেন এবং ক্যান্সারই বেরিয়েছে। খুব খারাপ লাগলো মেয়েটির জন্য।
তার বছরখানেক বাদে আরও একটা নিষ্ঠুর ব্যাপার ঘটলো। সেই ছেলেটি তার বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে এলো। তাকে আর তার প্রাক্তনের কথা জিজ্ঞেস করলাম না। বেশ বিরক্তির সাথে কার্ডটা রেখে দিলাম। বিয়ের দিনটার কথা ভুলেও গেলাম।
একদিন একটা গাড়ি এসে আমার কোয়ার্টারে হাজির। পাত্র স্বয়ং গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। যেতেই হবে। তখন প্র্যাকটিসও খুব একটা জমেনি। ফলে ফাঁকাই ছিলাম। তার ওপর যে ভদ্রলোক আমাকে নিতে এসেছেন তিনি আমার পূর্বপরিচিত। মুখের ওপর “যাবো না” বলতে পারলাম না।
বিয়ে বাড়িতে পৌঁছাতে হইহই করে কয়েকজন আমাকে ঘিরে ধরলো। পাত্রী নাকি আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। সে কি তার বরের পুরনো সম্পর্কের কথা জানে? কি বলবো তাকে গিয়ে?
দ্বিধা নিয়ে পাত্রী যে ঘরে তৈরি হচ্ছে সে ঘরে গেলাম। গিয়েই চমকে উঠলাম। আরে পাত্রী তো সেই মেয়েটিই। তাহলে কি ডায়াগনোসিস ভুল ছিল?
পাত্রী সাজের আড়াল থেকে পেটে আটকানো কোলোস্টমির ব্যাগ দেখায়। ডায়াগনোসিস হওয়ার পর তারা বাইরে চলে গিয়েছিল। ওখানে তড়িঘড়ি অপারেশন হয়। ওখানকার ডাক্তাররা নাকি আমাকে কুর্নিশ জানিয়েছে।
আমি তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বেরিয়ে আসি। বরমশাই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বসেছিল। সাজগোজ ঘেঁটে দিয়ে সপাটে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি।
সেদিন জানলাম পায়খানার রাস্তার রোগীরা আমাকে ফ্যারিংক্স নিয়ে খুব জ্বালাবে। না, সেদিন অন্নপ্রাশনের খাবার গলায় উঠে আসেনি – ভালো লাগার কান্নায় গলা দিয়ে কিছুতেই বিয়েবাড়ির খাবার পেটে নামাতে পারিনি।
Ato sabolil lekha je lekhok keo kurnish janate hoy.
অনেক ধন্যবাদ শতাব্দী 💐💐💐
খুব ভালো হয়েছে।
দাদা 💐❤️