এক প্রাক্তনীর বক্তব্য
*******
একটু পড়ুন, একটু ভাবুন ওরা কেন অনশনে পুজো কাটাচ্ছে?
*********
কর্তৃপক্ষের অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের ফল আর জি করের বর্তমান অচলাবস্থা
★★★
আসুন, ১২ দিন ধরে না খেয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়াই।
আজ ১২ দিন ধরে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা অনশনে। সেখানকার অধ্যক্ষ ছাত্রদের কথায় কর্ণপাত না করে, উপরন্তু তাদের হুমকি দিয়ে, বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে, অভিভাবকদের অনশন তোলার চাপ দিয়ে, তাদের অধ্যক্ষকে ঘেরাও করার প্ররোচনা দিয়ে, শেষে রাতের অন্ধকারে অনশন-অবস্থানরত ছেলেমেয়েদের গা মারিয়ে কলেজ থেকে পলায়ন করেছেন। সে ছবি সমস্ত মিডিয়ায় প্রচারিত হওয়ায় সবাই দেখেছেন এবং অনেকেই জানতে চান আসল বিষয়টা এবং ছাত্রদের দাবীগুলো কি কি। তাই এই লেখার অবতারণা।
প্রেক্ষাপট
গত ২০১৭ সালের পর থেকে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে কোনও ছাত্র নির্বাচন হয় নি। সেই সময়কার গঠিত ছাত্র সংসদ (তখনকার প্রক্রিয়াতেও বিরোধী শূণ্য নির্বাচনে ছিল শাসকদলের একচ্ছত্র আধিপত্য) এতদিন ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করে এসেছে। এমনকি ইয়াস ঝড়ে বিধ্বস্থদের পাশেও ছাত্ররা পৌঁচেছিল এই সংসদের নেতৃত্বে। গোল বাধল কলেজে নতুন অধ্যক্ষের আগমনে।
সুত্রপাত
তিনি বারবার নোটিস জাড়ি করে ছাত্রদের গণতন্ত্রে হস্তক্ষেপ করতে লাগলেন। নির্দেশ দিলেন ছাত্র সংসদের ক্যান্টিন বাবদ আদায় করা টাকা জমা দিতে হবে (তাঁর হিসেবে তিন বছরে তা নয় লাখে পৌঁচেছে)। ছাত্রদের বক্তব্য – এই টাকা তারা সংসদের সাংস্কৃতিক এবং খেলাধূলার জন্য খরচ করেন যার সব হিসেব আছে। প্রসঙ্গত বলা দরকার সেইসময়কার নির্বাচিত ছাত্রদের শেষ ব্যাচ (তখন যারা প্রথম বর্ষ ছিল) এখন পাশ করে গিয়ে ইন্টার্ন। ২০১৯ সালে তারা দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে হিসেব তাদের কাছে আছে কিন্তু আগের খবর তারা জানে না।
এছাড়া হোস্টেলগুলির বিষয়ে অভিযোগ তোলা হয় সেখান থেকে ছাত্রদের কাছ থেকে অবৈধ টাকা তোলা হচ্ছে ও মদ, গাঁজা ইত্যাদির ঠেক বসছে। ছাত্রদের বক্তব্য – কোন কলেজে মদ চলে না। আর জি করের বর্তমান অধ্যক্ষও ঐ কলেজের একজন প্রক্তনী। তিনিও দাবী করতে পারবেন না যে তাদের সময় এসব ছিল না। আর হোস্টেল রক্ষণাবেক্ষণ যেমন খাট, আলমারি, টিভি ইত্যদি এবং পুজো অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য যে সামান্য টাকা নেওয়া হয় তার সব হিসেব রয়েছে। এর বাইরে কেউ দোষী হলে তদন্ত করে শাস্তি দেওয়া হোক কিন্তু সমস্ত হোস্টেল প্রতিনিধিদের দায়ী করা অন্যায়।
অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
ছাত্ররা এরপরে জানতে পারে ছাত্র সংসদকে অকার্যকর করা হয়েছে এবং কোভিড পরিস্থিতিতে ছাত্র নির্বাচন সম্ভব নয়। সংসদের জায়গা নেবে মনোনিত ছাত্রকাউন্সিল। অধ্যক্ষ ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা না করে কাউন্সিল গঠনের নোটিস দেন যাতে থাকবে প্রতি ক্লাস থেকে হোস্টেলাইটদের তিন জন এবং ডে স্কলারদের তিনজন প্রতিনিধি। কর্তৃপক্ষের যুক্তি ডে স্কলারদের সংখ্যা বেশী। অন্যদিকে ছাত্রদের বড় অংশের দাবী হোস্টেলের ছেলেরাই আগের ছাত্র সংসদের কাজে বেশি দায়িত্বে ছিল এবং নতুন কাউন্সিলেও তাদেরই বেশি কাজ করতে হবে (কলেজের ইতিহাসে হোস্টেলাইটরাই ছাত্রদের সব কাজে ভালভাবে পালন করে এসেছে)। কাজেই তাদের প্রতিনিধি বেশি রাখা দরকার। তাদের দাবী হলো ক্লাসপিছু হোস্টেলাইটদের ৩ জন এবং ডেস্কলারদের ১ জনকে নিতে হবে।
এছাড়া হস্টেল কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয় যাতে ছাত্রদের ভূমিকা হল আমন্ত্রিত সদস্য। যেটাও হোস্টেলের ছেলেমেয়েদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
অন্যান্য অগণতান্ত্রিকতা
আর জি করে ছাত্রসংখ্যা প্রতি ব্যাচে ১০০ করে বাড়লেও হোস্টেলের সিট সংখ্যা বাড়ে নি। ছেলেরা নিজেদের ঘরে বেশি ছাত্র ঢুকিয়ে কিছুটা কাজ চলানোর ব্যবস্থা করলেও সমস্যা দেখা যায় নতুন ছাত্রীদের নিয়ে। তাদের (এমনকি বাইরের রাজ্যের মেয়েদেরও) রাখা হত লেডিজ কমন রুমে। কোভিড দ্বিতীয় ঢেউ-এ তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের জিনিসপত্র সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং এখন তাদের স্থান এক অস্বাস্থ্যকর ডরমেটারিতে। কর্তৃপক্ষ তাদের সমস্যার আশু সমাধানে উদাসীন। ১০ বিঘা জমির উপর নতুন হস্টেলে তৈরির সরকারি পরিকল্পনা সময়সাপেক্ষ এবং মেয়েদের ক্যাম্পাসের বাইরে আবাসস্থল করার প্রস্তাবও খুবই অবিবেবনা প্রসূত যেখানে অনেক রাত পররযন্ত মেয়েদের ক্লাস বা ক্লিনিক এবং ডিউটি করতে হয়।
হাউসস্টাপ সিলেকশনের সময়ও কোনও নীতি ঠিক না করে কলেজের ছেলেদের বাদ দিয়ে বাইরের মেডিক্যাল ছেলেদের আগে নেওয়ার সিদ্ধান্তও অন্যায় এবং ছেলেদের উষ্মার কারণ।
কর্তৃপক্ষের আচরণ
গত তিনমাস ধরে বিভিন্ন সময়ে ছাত্রছাত্রীরা অধ্যক্ষের কাছে বারংবার গেছেন। কিন্তু বারবার তারা তাঁর অনড়, দাম্ভিক এবং ঔদ্ধত্বপূর্ণ ব্যবহারের সম্মুখীন হয়েছে। এমনকি বাইরের লোকের ছাত্রদের সাথে অভদ্র আচরণের দায় তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ক্যাম্পাসে তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালান এই অধ্যক্ষ। ছাত্রদের নানাভাবে হুমকি দেওয়া হতে থাকে যাতে তারা অধ্যক্ষের অন্যায় পদক্ষেপ মেনে নেয়। কর্তৃপক্ষের এই সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গী এবং পদক্ষেপই আজকের এই অচলাবস্থার কারণ।
ছাত্রদের দাবী
ছাত্রছাত্রীদের নির্দিষ্ট দাবী
১) স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীর বেশিরভাগের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় ছাত্র কাউন্সিল তৈরি।
২) হোস্টেল কমিটিতে ছাত্রছাত্রীদের উপযুক্ত এবং দায়িত্বশীল প্রতিনিধিত্ব মেনে কমিটি তৈরি।
৩) ছাত্রীদের কলেজের মধ্যেই হোস্টেলে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার দ্রুত ব্যবস্থা করা।
৪) স্বচ্ছ এবং নীতিনিষ্ট হাউস্টাফ নির্বাচন প্রক্রিয়া ঘোষণা করা।
অনশন
আলোচনা প্রক্রিয়ার শেষ দিকে ২ অক্টোবর অধ্যক্ষ এবং হাসপাতাল রোগী কল্যাণ সমিতির প্রধান ডা. সুদীপ্ত রায়ের উপস্থিতিতে ছাত্রদের নাম করে এবং নিদ্দিষ্ট করে ভয় এবং হুমকি দেওয়া হতে থাকে। তারই প্রতিবাদে এবং দাবি আদায়ের জন্য অনোন্য উপায় ছাত্রছাত্রীরা ৩ অক্টোবর রাত্রিতে অনশনে বসে। অধ্যক্ষ তাদের প্রতি সদয় না হয়ে ৭ তারিখ অনেক ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে পুলিশ পাঠায় এবং অনশন তুলে নিতে পুলিশি চাপ দেওয়ান। ছাত্ররা ক্ষেপে গিয়ে অধ্যক্ষকে অপসারণের দাবীকে জোতদার করে ঘেরাও করেন এবং ইন্টার্নরা কর্মবিরতি শুরু করে (স্বাস্থ্যকাঠামোর নিয়ম অনুযায়ী ইন্টার্নরা শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য হয়)। বাকি কথা আগেই বলা হয়েছে।
কেন আপনি অনশনরত ছাত্রদের পাশে থাকবেন?
আজকের ডাক্তারি ছাত্র-ইন্টার্নরাই ভবিষ্যৎ চিকিৎসক। এমনিতেই কোভিড-১৯ অন্যান্য শিক্ষাক্ষেত্রের মতো আর জি করের ছাত্রদের পড়াশুনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বিশেষ করে অ্যানাটমি থেকে ক্লিনিক যা মেডিকেল শিক্ষার মেরুদণ্ড তাতেই সবচেয়ে ছেদ পড়ছে। তার সমধান এবং কতটা ক্ষতি সামলানো যায় সেদিকে নজর না দিয়ে কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের সাধারণ কলেজ ও হোস্টেল জীবনে নানা অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নামিয়ে দিয়ে তাদের পড়াশুনা এবং সেইসঙ্গে ভবিষ্যৎ চিকিৎসক তৈরির প্রক্রিয়াকেই ক্ষতিগ্রস্থ করছে। অথচ একটু নমণীয়, ছাত্রসুলভ মনোভাব এবং যুক্তিসঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গী নিলেই স্বাস্থ্য বিভাগ এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ সমস্যার সমাধান করতে পারে।
***
আসুন, একটু যুক্তিগ্রাহ্যভাবে ভেবে দেখি এবং এই উৎসবের সময়েও ১২ দিন ধরে না খেয়ে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়াই।
আর জি করের বর্তমান অধ্যক্ষও ঐ কলেজের একজন প্রক্তনী। সুতরাং ডাক্তাররাই ডাক্তারদের ক্ষতিসাধন করছেন।