তিলোত্তমার জন্য ন্যায়বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিক ভারতের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হবে। আদ্যন্ত রাজনৈতিক কিন্তু দলীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত এই আন্দোলন একদিকে যেমন শাসককে নড়েচড়ে উঠতে বাধ্য করেছে তেমনি বিষয়টি আজ আর শুধু একটি নারকীয় ধর্ষণ ও খুনের জন্য দায়ীদের শাস্তির দাবির মধ্যে সীমায়িত নয়। এই আন্দোলনের প্রধান চালক জুনিয়র ডাক্তাররা আরও বড় একটি সমস্যার দিকে আমাদের নজর ফেরাতে বাধ্য করেছেন। এই সমস্যাটির নাম হুমকির সংস্কৃতি। গত দু-মাসের বেশি সময় ধরে মিটিং, মিছিল, সোশাল মিডিয়া এবং সংবাদ চ্যানেলের সন্ধ্যাকালীন অনুষ্ঠানে বারবার বিভিন্ন বয়ানে পশ্চিমবঙ্গের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারগুলো উন্মোচিত হয়েছে। মেডিকেল কলেজে সুযোগ পাওয়া, পরীক্ষায় পাশ করা থেকে শুরু করে পিএইচডি-তে পেপার জমা করা, রোগীর অ্যাডমিশন, জাল ওষুধ-চক্র, শবদেহ নিয়ে কালোবাজারি— একের পর এক উন্মোচন দেখিয়ে দিচ্ছে স্বাস্থ্যব্যবস্থার অসুখ কত গভীরে। শুধু সন্দীপ ঘোষ ও তার চ্যালা-চামুন্ডারা নয়, প্রত্যেকটি মেডিকেল কলেজের প্রশাসনে আজ এইসব অন্ধকারের জীবদের বাড়বাড়ন্ত। হুমকির সংস্কৃতি আসলে এক সংগঠিত ব্যবস্থা যার অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমরা দীর্ঘ সময় ধরে কমবেশি সবাই জ্ঞাত ছিলাম, তিলোত্তমার মৃত্যু-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সেই কার্পেটে লুকোনো ঘটনাগুলোকে সামনে এনেছে মাত্র।
এই হুমকির সংস্কৃতি শুধু যে মেডিকেল কলেজগুলোতে রয়েছে, বিষয়টা এমন নয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা থেকে শুরু করে সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে, নাগরিক জীবনের প্রতিটি বাঁকে হুমকির অনিবার্য উপস্থিতি। মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থায় ডাক্তার, জুনিয়র ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে গড়ে ওঠা উচ্চকোটির বাস্তুতন্ত্রে হুমকির সংস্কৃতি আর জনজীবনের প্রান্তিক অবস্থানে থাকা মানুষেরা প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে যে হুমকির মুখোমুখি হয়ে দিন গুজরান করেন তার রূপ ভিন্ন হলেও আদতে ক্ষমতার হুকুমবরদারদের উপস্থিতি এক সর্বজনীন সত্য। সরকারি অফিসে শাসক দল বা তার পেটোয়া কর্তৃপক্ষের অনৈতিক কাজের বিরোধিতা করার কারণে মুহূর্তের মধ্যে দূরবর্তী জেলায় বদলি হওয়া বা কর্মস্থলে শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঘটনা সব আমলেই সত্য। আজ তাই দেখা যাচ্ছে আলোচনায় অহরহ উঠে আসছে বিগত সময়ে ঘটে যাওয়া হুমকি সংস্কৃতির কত অজানা কাহিনি। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের সবচেয়ে বড় পাওনা হল এই চলমান হুমকি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মানুষের কথা বলা।
আন্দোলনের গোড়ায় আমরা দেখেছিলাম তিলোত্তমার জন্য ন্যায়বিচার চাওয়ার অভিঘাতে টলিপাড়ার রূপালি জগৎ থেকে উঠে আসা নানা ঘটনার কথা যা সিনেমাজগতের হুমকি সংস্কৃতির স্বরূপ উন্মোচন করেছিল।
হুমকির সংস্কৃতি দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এক অপরিহার্য উপাদান। ক্ষমতাসীন হয়ে থাকার অন্তহীন আকাঙ্খা, যে-কোনও বিরুদ্ধতাকে দমন করার উদগ্র বাসনা আর ক্ষমতার মদমত্ততা জন্ম দেয় এক গোষ্ঠীবদ্ধ সিন্ডিকেট-রাজ। এই সিন্ডিকেটের কর্তারা স্বাভাবিকভাবেই শাসকদলের ঘনিষ্ঠ হয়। শাসক ও সিন্ডিকেটের মধ্যে এই মিথোজীবী সম্পর্কের মূল সূত্র অবশ্যই আর্থিক দুর্নীতি ও নির্বাচনী পাটিগণিত। আজ তাই মেডিকেল কলেজ হোক বা টালিগঞ্জের স্টুডিও, সবক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে মূল অভিযুক্ত হয় শাসক দলের নেতা, নয়তো শাসক দলের কোনও নেতার ঘনিষ্ঠ।
জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হল, তাঁরা এই হুমকি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শুধু মুখ খোলেননি, একই সঙ্গে সমূলে এই সংস্কৃতিকে উৎপাটন করতে চেয়েছেন। সেই কথায় ভরসা রেখে মনে হয় সময় এসেছে হুমকি সংস্কৃতির কারণ ও তা রোধ করতে কী করা যায় তা নিয়ে এক বৃহত্তর সংলাপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার। ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে যুক্ত থাকা সীমাহীন দুর্নীতির মৌরসিপাট্টা বজায় রাখার চেষ্টা অবশ্যই হুমকি সংস্কৃতির টিকে থাকার একটি কারণ কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা ও ক্ষমতা হারানোর ভয়ও এই সংস্কৃতির জন্মের একটা কারণ। মনে পড়ে যায় এক বছর আগে বামপন্থী, প্রগতিশীল সংস্কৃতির ধারক বলে পরিচিত কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র ছাত্রদের হুমকি ও র্যাগিং সংস্কৃতির আগ্রাসনে তরুণ ছাত্র স্বপ্নের অকালমৃত্যুর কথা। যেখানে কিন্তু আর্থিক দুর্নীতি কোনও বিষয় ছিল না। আজও কিন্তু স্বপ্ন হত্যার বিচারের কোনও অগ্রগতি হয়নি।
হুমকির সংস্কৃতি টিকে থাকতে পারছে কারণ গণতন্ত্রের ধারণা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে যাওয়া। এই রোগের শুরু বাম জমানার শেষদিকে যখন দলদাসত্ব গ্রাস করে নেয় প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের সমস্ত স্তরকে। পরিবর্তনের ধ্বজা তুলে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এলেও তাদের আমলেই এ-রাজ্যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছে। আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হত। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও সেখানে অন্তত নির্বাচনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়ার একটা প্রতিফলন থাকত। শুধু কলেজ কেন, পরিবর্তনের জমানায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, উচ্চ মাধ্যমিক কাউন্সিল বা স্কুলের ও কলেজের পরিচালন কমিটি— সর্বত্র নির্বাচনের বদলে মনোনয়নই একমাত্র নীতি। এর ফল হয়েছে মারাত্মক। সমস্ত ক্ষেত্রে দলীয় নেতার প্রসাদপুষ্ট অযোগ্য মানুষের ভিড়। অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে মনোনীত হওয়া এই মানুষদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই, একমাত্র মনোনয়ন যে নেতা দিয়েছেন তাঁকে সন্তুষ্ট করাই এদের একমাত্র কাজ। পশ্চিমবঙ্গের যে-কোনও কলেজে গেলে দেখা যাবে শাসক দলের বিভিন্ন নেতার অনুগত কিছু ছাত্রের নানা গ্রুপের আস্ফালন। একই দলের হলেও বেশিরভাগ সময়ে তারা সম্মুখসমরে। স্কুলের পরিচালন কমিটিতে শিক্ষায় আগ্রহী মানুষের তকমার আড়ালে শুধু ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা মানুষদের ভিড়। এই চরম অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা স্বাভাবিক নিয়মে টিকে থাকতে পারে না, তাদের প্রয়োজন হয় হুমকি সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলনের।
হুমকি সংস্কৃতির সমূলে উৎপাটন কিন্তু কিছু আমলা বা আধিকারিকের অপসারণের মধ্যে দিয়ে সম্ভব নয়। হুমকি সংস্কৃতি যে পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠে তাকে সরাতে না পারলে ক-বাবুর বদলে খ-বাবু এলেও হুমকি সংস্কৃতি বহাল তবিয়তে বর্তমান থাকবে। এমনকি আজ যাঁরা আন্দোলনের সামনের সারিতে, ক্ষমতার অংশীদারিত্ব পেলে তাঁদের কেউ কেউ হয়তো হুমকি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে উঠবেন। তাই আজ সবার আগে দরকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুশীলনে আস্থা রাখা। প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণ অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে। সেই দলতন্ত্রের কবল থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতন্ত্রীকরণ ও তাদের কাজকর্মের মধ্যে স্বচ্ছতা আনয়নের কাজটা কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন সেই সুযোগ আমাদের সামনে এনে দিয়েছে। গণতন্ত্রের প্রতি ভরসা রেখে এগোতে পারলে পরিস্থিতির বদল ঘটতে পারে। দায়টা কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের একার নয়, সমগ্র নাগরিক সমাজের।
চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এ ১৭ই নভেম্বর, ২০২৪-এ প্রকাশিত।
মূল কথাগুলো সবটাই ধরা হয়েছে লেখায়. চমৎকার