এটিও প্রায় পঁচিশ বছর আগের ঘটনা। একটি দুর্ঘটনার রোগীদের দেখার জন্য পাশের রাজ্যে যেতে হয়েছিল। রাতের বিশেষ ট্রেনে করে সকালে একটি ছোট্ট শহরে নামলাম , আমার সঙ্গে আরও এক অস্থিশল্যচিকিৎসক ছিলেন, যিনি পদমর্যাদায় আমার অনেক উপরে। যাইহোক, স্টেশনে নামার পর, তিনি সেই যে অদৃশ্য হলেন, তার পর থেকে তার শিখার অগ্রভাগটুকুও দেখার সৌভাগ্য এই অধমের হয়নি। স্টেশন থেকে সোজা নিকটবর্তী হাসপাতালে গেলাম। দুর্ঘটনাগ্রস্থ রোগীরা এই হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন। ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি আট দশ জন আহত রোগী ভর্তি রয়েছেন। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু হাড় ভাঙ্গা বা বুকে চোট ইত্যাদি রয়েছে। সকলের জন্যই প্লাস্টার বা ব্যান্ডেজ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা গেল। একদম শেষ প্রান্তে একটি রোগী রয়েছে যাঁর বাঁ পায়ের টিবিয়া এবং ফিবুলা দুটি হাড়ই ভেঙে গেছে। ভালো করে পরীক্ষা করে দেখি তাঁর পায়ের নখের ‘ নেইল বেড রিটার্ন’ নেই , অর্থাৎ তাঁর পায়ে রক্ত চলাচল হচ্ছে না। পায়ের পাতার উপরে ‘ ডর্সালিস পেডিস ‘ এবং গোড়ালির পেছনে ‘ পোস্টেরিয়ার টিবিয়াল ‘ ধমনী হাত দিয়ে অনুভব করতে পারলাম না। অর্থাৎ তাঁর এই আঘাত গ্রস্থ পায়ে ধমনী গুলিতে রক্ত চলাচল বন্ধ। আসলে এই রোগীর পায়ের দুটি হাড় ভেঙে ভিতরে যে রক্ত বেরিয়েছে তা ঐ পায়ের ধমনীগুলির চারপাশে জমে গিয়ে চেপে ধরে ঐ ধমনীগুলির রক্ত চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। অবিলম্বে এই চাপ না সরাতে পারলে এঁর পায়ে পচন ধরবে আর ঐ পা কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, যা করার এখনই করতে হবে। তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালের সুপারের কাছে গেলাম। ভদ্রলোক আমার পূর্ব পরিচিত, চাকরি জীবনের শুরুতে একটি হাসপাতালে এক সঙ্গে কাজ করেছি। রোগীর সম্পূর্ণ অবস্থার বিবরণ দিয়ে বললাম, যে এখনই ওঁর অপারেশন করে ওই জমাট বাঁধা রক্তের চাপ কমিয়ে দিতে হবে, তা না হলে ওঁর ঐ পা বাঁচানো যাবে না । এর মধ্যেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। আরো আগেই করলে ভালো হতো। সব শুনে আঁতকে উঠে উনি বললেন, ‘ অপারেশন এই হাসপাতালে অসম্ভব, যা করার কোলকাতায় নিয়ে গিয়ে হবে ‘ । আমি বললাম ‘ কোলকাতায় নিয়ে যেতে যেতে ওঁর পা পচে যাবে ‘ । ‘ সে আমার কিছু করার নেই। এখানে অপারেশন করতে গিয়ে খারাপ কিছু হলে, তার কি হবে ? তাছাড়া এখানে কোন অ্যানাস্থেটিস্ট নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি ‘ । আমি নাছোড়বান্দা হয়ে খুব অনুনয় বিনয় করলে উনি বললেন ‘ মুখ্য চিকিৎসা নির্দেশক মহোদয় এলে ওঁকে আর্জি জানাতে ‘ । ঘন্টা খানেক অধীর অপেক্ষার পর মুখ্য চিকিৎসা নির্দেশক মহোদয় এলেন এবং ওঁকে রোগীর পায়ের এই আশঙ্কাজনক অবস্থার কথা বললাম। সব শুনে উনি আমার এই আপৎকালীন অপারেশনের প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ ,বাতিল করে দিলেন। উনি ও বললেন ‘ যা করার তা কোলকাতা নিয়ে গিয়েই হবে , এতে পায়ে পচন ধরলেও কিছু করার নেই ‘ । এই কথা বলে, উনি ওই হাসপাতালের সুপার ভদ্রলোকটির সঙ্গে, ‘ বস্তু পিন্ড সূক্ষ্ম হতে স্থুলেতে, অর্থাৎ কিনা লাগছে ঠেলা পঞ্চভূতের মূলেতে ‘ জাতীয় আলোচনায় গভীর ভাবে মগ্ন হয়ে পড়লেন। আমি আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে পড়লাম। বুঝলাম প্রশাসনিক কোন সাহায্য বা সমর্থন আমি পাবো না। সোজা অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে ও.টি মেট্রনকে বললাম , ‘ আপনার অপারেশনের যন্ত্রপাতি কিছু আছে ? উনি একটু কিন্তু কিন্তু করে, আমায় স্টোরে নিয়ে দেখালেন। দেখি একটি আলমারির মাথায় বিছানার চাদর দিয়ে একটি মস্ত বড় পোঁটলা বাঁধা আছে। এক কর্মচারীর সাহায্যে ধূলিধুসর সেই পোঁটলা নামিয়ে সেটি খোলা হলো। দেখলাম তার মধ্যে অনেক যন্ত্রপাতিই রয়েছে , অনেকগুলিই মরিচা লাঞ্ছিত। ওর মধ্যে থেকে আমার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিগুলি মোটামুটি বেছে নিলাম। তাদের জীবাণুমুক্ত করতে দেওয়া হলো। ওয়ার্ড থেকে রোগীকে এনে ওনাকে সব কিছু খুলে বললাম। বললাম যে অনেক দেরী হয়ে গেছে, তবুও ওঁর পা বাঁচাতে একটা মরিয়া চেষ্টা আমি করতে পারি, যদি উনি সম্মতি দেন। উনি সম্মতি দিলে ওনাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হলো। প্রথমেই ওঁকে একটি বেদনা নাশক এবং একটি ঘুমের ইনজেকশন দিলাম। কোন অ্যানাস্থেটিস্ট নেই, কোনো সহকারীও নেই। ও.টিতে এক জন সিস্টার ও এক জন কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত হয়ে এলে, আমি ওঁকে সায়াটিক, ফিমোরাল ও অবটুরেটর তিনটি স্নায়ু অবশ করার জন্য তিনটি লোকাল ব্লক দিলাম। তারপর হাত ধুয়ে নেমে পড়লাম। অ্যানাস্থেটিস্ট না থাকা অবস্থায় আগেও অপারেশন করেছি, কিন্তু বিনা সহকারীতে এই প্রথম, তাও অচেনা পরিবেশে! আমি চামড়ার যে অংশ কাটবো সেখানেও লোকাল অ্যানাস্থেটিক ইনজেক্ট করে দিলাম। অপারেশন পর্ব মোটামুটি ঠিক ঠাকই হলো, জমাট বাঁধা রক্ত যথা সম্ভব পরিষ্কার করে দিলাম, তার পর ক্ষতস্থান সেলাই না করেই পাটি নিজের কাঁধে তুলে (সহকারী না থাকায়) ড্রেসিং করে দিলাম। ‘নেইল বেড রিটার্ন ‘ একবার পরীক্ষা করলাম, মনে হলো সামান্য রং ফিরছে। রোগীকে ওয়ার্ডে ফেরত পাঠালাম। ঘন্টা খানেক বাদে আবার দেখলাম। নেইল বেড রিটার্ন হচ্ছে, ডর্সালিস পেডিস ধমনী অনুভব করলাম, সামান্য অশ্বখুর ধ্বনি অনুভব করলাম মনে হলো। তারপর সমস্ত রোগীদের সঙ্গে নিয়ে রাতের বিশেষ ট্রেনে যাত্রা করলাম, কোলকাতার ঊদ্দেশে । সমস্ত রাত্রি ওই রোগীদের পরিচর্যায় কাটলো। কারো স্যালাইন শেষ হলে নতুন বোতল লাগানো, কারো খুব যন্ত্রণায় বেদনানাশক ইনজেকশন, কাউকে একটু পাশ ফিরিয়ে দেওয়া, এসব আমার দুই কর্মচারীদের নিয়ে সমাধা করলাম। সকালে ট্রেন অন্তিম স্টেশনে পৌঁছলো। আমার ওই অপারেশনের রোগীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওঁর পরিজনেরা অ্যাম্বুলেন্স এনেছেন । বিদায় জানানোর আগে শেষ বারের মত ওঁর পায়ের ধমনীগুলির স্পন্দন অনুভব করলাম। ধমনীর দপদপের সাথে আমার বুকের ধকধক মিলে গেল। আমার অন্যান্য রোগীদের জন্য অন্য চিকিৎসকরাও এসে গেছেন, সবাইকে বিদায় জানিয়ে কামরার বাইরে পা রাখলাম। দীর্ঘ দগ্ধ দিন আর সমস্ত রাত্রির পরিশ্রমে শরীর আর বইছিল না। আমার অবস্থা দেখে একজন কর্মচারী একটি ছোট জলের বোতল আমায় এগিয়ে দিলেন। এক ঢোঁক জল খেলাম। হঠাৎই দেখি এক বিশিষ্ট আমলা প্রমত্ত দাদুরীর মত উল্ল্মফনরত, তাঁর নিষ্ঠীবন প্রক্ষিপ্ত গর্জনে যা বুঝলাম যে ওই মহার্ঘ জল কেবলমাত্র রোগীদের জন্য , কোন ঘৃণ্য চিকিৎসকের প্রাপ্য নয়। এঁদের করুণা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনা। আমার থলিটি পিঠে তুলে বাড়ির দিকে ক্লান্ত পা বাড়িয়ে দিলাম। মনের মধ্যে গুনগুন করলো প্রাণের ঠাকুরের সেই গান, ‘ যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা, যদি ঝড়বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে, তবে বজ্রানলে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে, একলা জ্বলো রে ‘ ।
একা সঞ্জয় নয়, একাধিক অপরাধী
24Hrs TV-এ ২০শে জানুয়ারী, ২০২৪ প্রচারিত।
অসাধারণ কাজ
দাদা, এটা অতি সামান্য কাজ। অসাধারণ কিছু নেই।
দাদা, কাজটা আসলে খুবই সাধারণ। শুধুমাত্র সবার মতের বিপক্ষে গিয়ে করেছি এই মাত্র।
অসামান্য হীরকদ্যুতিতে উজ্জ্বল লেখা!
অনেক আদর, অনি!
দাদা, আমি আপ্লুত। প্রণাম নেবেন।
এমন অনেক পুরোনো ব্যথা জমা নিয়েই ফেরার ট্রেন একলাই ধরতে হবে আমাদের ।
সব কথা লিখতেও পারব না ।
অভিনন্দন — হৃদয় নিংড়ে এই লেখার জন্য । কারণ লেখক মনীষীরা বলেছেন — “যা লেখা হয় নি তা ঘটেনি । “
সেতো ঠিক, সব কথা বলা হয়ে ওঠে না। অজস্র ধন্যবাদ।
ম্যাডাম, যখন কাঁধের ওপর রোগীর পা রেখে ব্যান্ডেজ করি অপারেশনের শেষে, পাটা ভীষণ ভারি লাগে, হয়ত হাত suture এর জায়গা অবধি ঠিক মতো পৌঁছয় না, গজ গড়িয়ে পড়ে, আবার নতুন গজ দিয়ে গ্যামজি জড়াই, আর ভারী ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে।
অসাধারণ।
আসলে মানবিক মূল্যবোধ মানুষকে মহৎ করে তোলে।
খুব ভালো লাগলো।
তোমার পাখীদের খবর কী?
ভালো থেকো,
খুব ভালো লিখছিস! আরও লিখে যা।
??
খুব ভালো লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ।
Asadharan.
Apnar moto manus rupe mahamanob rai erokom kaaj korte paren sir. Barbar apnar sathe kaaj korte ichhe kore.oi somoy ta amar ekhaner swarnojug.?
এরকম বলবেন না, এরপর আর পা মাটিতে পড়বে না, আমার ও খেদ রয়ে গেল আপনার সাথে বেশি দিন কাজ করা হলো না। ভালো থাকবেন।
লিখে চলুন। অামরা সেই লেখা পড়ে মানুষ হতে চেষ্টা করে চলবো।
আমি অতি নগন্য এক স্বাস্থ্যকর্মী মাত্র, আমার কি আর সেই সাধ্য আছে। ভালো থাকবেন।
অতি নগণ্য ভাবে নিজের ধর্ম ( কাজ তো আমাদের ধর্মই) পালন করার মধ্যে যে অহঙ্কার ত যেন চিরকাল তোকে ঘিরে থাকে!
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
কি সব কাজ করেছ!
সব লিখে যাও।
অনেক ধন্যবাদ, ভাই।
এই সমস্ত কাজ সব ডাক্তারের, বিশেষ করে ছোটদের জানা উচিত
অনেক ধন্যবাদ স্যার।
এই সমস্ত কাজের ইতিহাস সবাই জানুক।
অজস্র ধন্যবাদ স্যার, খুব ভালো থাকবেন।