একজন মানুষকে তখনই সুস্থ বলা যাবে যখন তিনি শারীরিক ও মানসিক দুইদিক দিয়েই সুস্থ হবেন। শারীরিক অসুস্থতা সম্বন্ধে আমরা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল হলেও মানসিক অসুস্থতাগুলির ব্যাপারে আমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। আবার আমরা নিজেদের বাইপাস সার্জারীর কথা বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করলেও মানসিক অসুস্থতা সম্বন্ধে পরিবার -পরিজনের বাইরে অন্যান্য লোকজনের সাথে আলোচনার ব্যাপারে কুণ্ঠাবোধ করি। আমরা সামান্য সর্দি হলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেও অনেক সময় দীর্ঘদিনের মানসিক সমস্যার জন্য মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেবার বিষয়ে অবহেলা করি।
পরিসংখ্যান বলছে ভারতবর্ষে প্রতি একশ জনের মধ্যে ১৩.৭ জন মানুষ জীবনের কোন না কোন সময় মানসিক রোগের শিকার হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২০ সালে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার (মন খারাপের সমস্যা) বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অসুখ এবং ২০৩০ সালে বিশ্বের বৃহত্তম অসুখ হিসাবে দেখা দেবে।
দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক ভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে (ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, শ্বাসের সমস্যা ইত্যাদি) যেমন ডিপ্রেশনের মত মানসিক সমস্যা খুব বেশি দেখা যায়, তেমনি আবার ডিপ্রেশন ও অন্যান্য মানসিক রোগাক্রান্তদের মধ্যে হৃদযন্ত্রের নানান রোগ, সুগারের সমস্যা ইত্যাদি হবার সম্ভাবনা বেশি হয়। বর্তমানে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও হ্রাস পায় এবং সহজেই বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতার শিকার হন। অর্থাৎ মানসিক অসুস্থতা যুক্ত হলে শারীরিক ভাবে অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা আরো দীর্ঘায়িত, কষ্টকর ও ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে।
মানসিক সমস্যাগুলির সাথে সাথে অনেক সময় পারিবারিক ভাঙ্গন, দারিদ্র্য, কর্মক্ষেত্র থেকে ছাঁটাই, অসমাজিক কাজ কর্মে জড়িয়ে পড়া, নেশা করার প্রবণতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়।
তাই একথা বলাই যায় যে মানসিক অসুস্থতাগুলির প্রতি যত্নশীল না হলে প্রকারান্তরে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবনমনও ঘটে।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা শারীরিক ও মানসিক রোগের কারণ সম্বন্ধে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন তথ্য লাভ করেছি ও করে চলেছি। এক সময় যেমন দূষিত বাতাসকে ম্যালেরিয়ার কারণ হিসেবে ভেবেছি, তেমনি মানসিক রোগগুলিকে ভেবেছি ভূত-প্রেতের প্রভাব, মনের দুর্বলতা, চরিত্রের ত্রুটি ইত্যাদি হিসাবে। আর হয়তো এই ভুল ধারণাগুলির কারণেই মানসিক রোগীরা সমাজে অপাংক্তেয় হয়ে থেকেছেন এবং রোগীর পরিবার লজ্জায় তাঁদেরকে সমাজ থেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন ও করছেন। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে বর্তমানে আমরা জানতে পেরেছি যে মানসিক রোগগুলিও শারীরিক রোগগুলির মতোই রোগ এবং মস্তিষ্কের মধ্যে কিছু রাসায়নিকের (নিউরোট্রান্সমিটার) পরিমাণের তারতম্যের কারণে মানসিক রোগের সৃষ্টি হয়।
মানসিক রোগগুলিকে মোটামুটি ভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়-সাইকোসিস (যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার ইত্যাদি)ও নিউরোসিস (যেমন উদ্বিগ্নতার সমস্যা,মন খারাপের সমস্যা ইত্যাদি)। সাইকোসিসের ক্ষেত্রে রোগী নিজে বুঝতে পারেন না যে তিনি অসুস্থ এবং তাঁর বাস্তবজ্ঞান নষ্ট হয়ে যায়। নিউরোসিসের ক্ষেত্রে কিন্তু রোগী তার নিজের সমস্যা বুঝতে পারেন এবং তাঁর বাস্তবজ্ঞান বজায় থাকে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সাইকোসিস গোত্রের রোগ হলে রোগীর পারিবারিক ও সামাজিক জীবন অনেক বেশি প্রভাবিত হয়। নিউরোসিস গোত্রীয় মানসিক রোগীরা সাধারণত স্বল্পমেয়াদি চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে সাধারণ মানুষের এই ব্যাপারে তেমন কোন ধারণা নেই এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা ভাবি সমস্ত মানসিক রোগই এক এবং এদের কোন চিকিৎসা নেই।
মানসিক রোগের চিকিৎসা সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে নানান ভুল ধারণা আছে।
- সমস্ত ধরনের মানসিক রোগেরই কার্যকরী চিকিৎসা সম্ভব।
- মানসিক রোগের ওষুধ মানেই ঘুমের ওষুধ -এই ধারণা ভুল। এমন অনেক ওষুধ আছে যেগুলি খেলে ঘুমের সমস্যা হয় না এবং রোগীর দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যহত হয় না।
- যত তাড়াতাড়ি রোগীকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে আনা হবে, রোগীর ঠিক হবার সম্ভাবনা ততটাই বাড়বে।
- রোগের উপসর্গ বেড়ে গেলে আবার অনেক সময় ইলেক্ট্রো কনভালসিভ থেরাপি (শক থেরাপি) ব্যবহারের দরকার পড়ে। বর্তমানে আনাস্থেসিয়া দিয়ে (অজ্ঞান করে) ইলেক্ট্রো কনভালসিভ থেরাপি দেওয়া হয়। এতে রোগী কোনরকম ব্যথা অনুভব করেন না। ইলেক্ট্রো কনভালসিভ থেরাপি সম্বন্ধে সিনেমায় যে ভয়ঙ্কর বিবরণ দেখানো হয় সেগুলো আদতে সত্যি নয়।
- রোগী অনেক সময় ঠিকমত ওষুধ খান না।আত্মীয়-স্বজনদের এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে এবং রোগীকে ঠিক সময়ে, ঠিক পরিমাণে ওষুধ খাওয়াতে হবে ও ফলো আপ সাক্ষাৎকারগুলিতে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
- চিকিৎসকের সাথে কথা না বলে ওষুধ বন্ধ করা উচিত নয়।
- এই ওষুধগুলির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অন্য শারীরিক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলির তুলনায় বেশী কিছু নয়। বর্তমানে ব্যবহৃত ওষুধগুলির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আরো কম এবং অন্যান্য শারীরিক রোগের ওষুধের সাথে সাথে মানসিক রোগের ওষুধ খাওয়ার তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই।
মানসিক রোগের বিষয়ে দেশ জুড়ে সচেতনতা কর্মসূচি ও জনমত গড়ে তোলা দরকার। স্কুল পর্যায় থেকেই সচেতনতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন আলোচনা সভা, গণমাধ্যমগুলির মাধ্যমে মানসিক রোগ সম্বন্ধে কুসংস্কার বিরোধী বৈজ্ঞানিক প্রচার এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
মানসিক রোগের কারণ যে মস্তিষ্কের মধ্যে রাসায়নিকের পরিমাণের তারতম্য, সমস্ত মানসিক রোগ যে এক নয়, মানসিক ও শারীরিক রোগ যে পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, যে কোন ব্যক্তিই যে মানসিক রোগের শিকার হতে পারেন, মানসিক রোগের যে কার্যকরী চিকিৎসা সম্ভব -এই সমস্ত ধারণা জনমানসে প্রসারিত হলে মানসিক রোগের চিকিৎসা ক্ষেত্রে তো উন্নতি সাধন হবেই,সাথে সাথে দেশের সমগ্র চিকিৎসাব্যবস্থাও এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।