ন্যাচারাল সিলেকশন বা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই পৃথিবীতে সকল প্রাণী ও জীবকূলেরা এসেছে এই সত্যটি মেনে নিলেও আপনার কি কখনও মনে হয় না যে এত বৈচিত্রের জীবেরা পৃথিবীতে আছে বা ততোধিক পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে এটা শুধুমাত্র অভিযোজনের মাধ্যমে ঘটেছে তা ভাবা একটা কষ্টকল্পনা? বিজ্ঞানকে মেনে নিয়েও আমার নিজের মাঝেমাঝে এটা ভাবতে খুব অবাক লাগে যে শুধু ইভোলিউশনের মাধ্যমেই এত কিছু ঘটেছে। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই কারণ এই মুহূর্তে আমরা সত্যিই জানি না যে এর পেছনে আর কী রহস্য থাকতে পারে।
আজ থেকে ৫৪০ মিলিয়ন বছর আগে হঠাৎ করেই পৃথিবীতে প্রাণীদের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীরা ওই সময়ের প্রচুর সংখ্যায় যেসব প্রাণীদের ফসিল পেয়েছেন সেই থেকেই তারা এই সহমতে পৌঁছেছেন। কিন্তু এটা কেন হল তা তাদের কাছে এখনও বিরাট বিস্ময়ের ব্যাপার। এই সময়ে প্রাণী প্রজাতিদের সংখ্যা হঠাৎ করে বিরাট বেড়ে যাওয়ার ঘটনাকে বলা হয়ে থাকে ‘ক্যাম্ব্রিয়ান এক্সপ্লোশন’। এই সময়ের আগে কী ছিল বিজ্ঞানীরা অনেকদিন তা জানতেন না। বেশ কয়েকবছর আগে এক ধরনের প্রাণীদের ফসিল পাওয়া গেছে, দেখা গেছে তাদের সংখ্যা অনেক অথচ তাদের কারোর দেহে কোনো শক্ত খোলসের আবরণ নেই। তারা তাই দেখে মনে করেছেন এ ছিল এমন এক সময় যখন প্রাণীদের নিজেদের মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না অর্থাৎ কোনো খাদ্য-খাদক সম্পর্ক ছিল না। সকলে পর্যাপ্ত সূর্যালোক, জল, খনিজ লবণ ও উদ্ভিদদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে নিজেদের জীবন ধারণ করত। ৬৩০ মিলিয়ন বছর আগের এই সময়কালকে বলা হয় ‘গার্ডেন অফ এডিকারা’।
এই যে প্রাণীদের মধ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই- এ ব্যাপারটা কিন্তু অভিযোজনের জন্য একদম ভালো খবর নয়। নিরন্তর বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম, অন্যকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা, নিজেকে অন্যের খাদ্য হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখা শুধুমাত্র এই মৌলিক বিষয়টার ওপরই অভিযোজনের মূল শক্তি অন্তর্নিহিত আছে। এই সংগ্রামই সকল প্রাণীদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সামনে এগোতে এগোতে অভিযোজনের একেবারে প্রথমে, খাদ্য পিরামিডের একদম চূড়ায় বসে আছি আমরা মানুষেরা। আমরাই ‘এপেক্স প্রিডেটর’। আমাদের যেহেতু ওপরে কোনো খাদক নেই তাই আমরাই আমাদের খাদক। মানুষই মানুষকে ধ্বংস করে, হত্যা করে। জানি না এটাও অভিযোজনের কোনো গোপন শলা কিনা?
অনেকেই হয়ত মনে করছেন আমি আলোচনা থেকে সরে আসছি বা ধান ভানতে শীবের গীত গাইছি। তা নয়। আমি আপনাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি যে অভিযোজনের মাধ্যমে এককোষী ব্যাকটিরিয়া থেকে আধুনিক হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্সদের এই বিবর্তন এটা দীর্ঘ সময় ধরে একটু একটু করে এসেছে। জিনগত পরিবর্তন দীর্ঘ সময় ধরে একটু একটু করে প্রাকৃতিকভাবে এসেছে। হঠাৎ একদিনে এসে যায় নি। তাই আমরা একে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ল্যাবরেটরিতে কি বদলে নিতে পারি? এর কী কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়বে না আমাদের ওপর, অন্য জীবপ্রজাতির ওপর? প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াই বা কী হবে?
কিন্তু প্রস্তাবটা এত লোভনীয় ও এত প্রয়োজনীয় যে আজ হোক বা কাল সেই রাস্তায় না হেঁটেও আমাদের কোনো উপায় নেই। অভিযোজনের ফলে আমরা যত উন্নত হয়েছি তত আমাদের মস্তিষ্কের উন্নতি হয়েছে। আর মস্তিষ্কের উন্নতির সাথে সাথে আমাদের শারীরিক সক্ষমতা কমেছে পাল্লা দিয়ে। আজ আমরা নখ, দাঁত, লোমহীন পাতলা চামড়ার মানুষ প্রকৃতির খেয়ালের কাছে যারা তুচ্ছ। বিশ্রাম অবস্থায় শরীরের ২০% শক্তি আমাদের মস্তিষ্ককে সচল রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। যখন আমরা কাজকর্ম করি এটা প্রায় ৩০% অবধি পৌঁছাতে পারে। এই শক্তির হিসেবটা বিরাট। এটা একদিকে যেমন আমাদের মেধা ও বুদ্ধিকে শানিত করছে তেমনি অন্যদিকে আমাদের শরীরের অন্য রক্ষাকবচগুলোকে দুর্বল করে ফেলছে। এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে চিন্তার বিষয়। আমরা সবার চেয়ে সেরা কিন্তু সময় যদি বদলায় প্রকৃতি যদি বদলায় আমরাই সবার আগে নিশ্চিহ্ন হব।
আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি এই বুড়ো পৃথিবীটাও খুব অনিশ্চিত একটা জায়গা। খুব সামান্য একটা সুবিধাজনক অবস্থায়, প্রকৃতির একটা খুব ছোট ‘ইকোলজিক্যাল নিশ’ বা প্রাকৃতিক ভারসাম্যের মধ্যে আমরা বাস করি। পৃথিবীতে এর আগে বহুবার তুষার যুগ এসেছে, তারপর আবার উষ্ণ যুগ এসেছে। শেষ তুষার যুগের পরে যে উষ্ণ যুগ আসে সেই সময়েই আমরা হোমো সেপিয়েন্সরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিলাম পূর্ব আফ্রিকার সাভানা অঞ্চল থেকে। তারপর আবার ৭৫,০০০ বছর আগে সুমাত্রার মাউন্ট টোবা আগ্নেওগিরির অগ্নুৎপাত বহুবছর ধরে পৃথিবীর জীবপ্রজাতির সংখ্যা ভীষণভাবে কমিয়ে দেয়। হাতে গোনা কয়েকটি হোমো সেপিয়েন্স যারা সেসময় বাঁচতে পেরেছিল তাদের থেকেই আজ আমরা সারা পৃথিবীর সেপিয়েন্সরা জন্ম নিয়েছি। তারাই আমাদের পূর্বপুরুষ।
তাই আজ পরিবেশ নিয়ে এত হইচই হচ্ছে- গ্রিসে দাবানল, লন্ডনের তাপমাত্রা ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আমেরিকায় দীর্ঘস্থায়ী দাবানল, আগামি ৮০ বছরের মধ্যে আমাদের মুম্বই, খিদিরপুর, সুন্দরবন সবে জলের নীচে চলে যাবার ভবিষ্যৎবাণী- এগুলো আমাদের অপরিণামদর্শিতাকে দায়ি করলেও আমরা চাই বা না চাই পৃথিবীতে আবার তুষার যুগ আসবে, সারা পৃথিবী তুষারে ঢেকে যাবে, আমাদের ব্যারাকপুরে ১০ ফুট বরফের স্তর পড়বে- এসব হবেই। একে আমরা কোনোভাবেই আটকাতে পারব না। প্রকৃতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমরা হাতে ধরে তো পৃথিবীর কৌণিক অবস্থানকে পালটে দিতে পারব না। তাই এসব হবেই।
আর এসব হলে বিপুল সংখ্যায় মানুষ মারা যাবে। অবশ্য ততদিন যদি মানবসভ্যতা আদৌ টিঁকে থাকে। তখন এই অবসবাসযোগ্য পৃথিবীতে আমাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হবে। তখন যদি মানব প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় আমাদের অন্য গ্রহে পাড়ি জমানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। সেই ভিন গ্রহে আমরা যেতে পারব কিন্তু ফিরে আসতে পারব না। তাই আমাদের সেখানেই মানব কলোনি গড়ে তুলতে হবে। তা সে মঙ্গলই হোক বা চাঁদ। আমাদের মানুষের শারীরিক যা কাঠামো তাতে সেই ধকল নেওয়া অসম্ভব। তাই এমন কিছু মানুষের প্রজাতি তৈরি করতে হবে যারা সেই ধকল নিতে পারবে। অন্য গ্রহে মানব প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। সেই বিশেষ মানুষ বা সুপার হিউম্যানদের তৈরি করতে হলে আমাদের জিন প্রযুক্তি ছাড়া উপায় নেই।
আমাদের শরীরে যেসব ক্যান্সার হয় তাদের মধ্যে অনেকেই জিন নিয়ন্ত্রিত। সেসব জিনকে আমরা বদলে দিতে পারলে ক্যান্সারের হাত থেকে আমাদের মুক্তিলাভ সম্ভব। ক্রিসপার প্রযুক্তির সাহায্যে এইচ আই ভি চিকিৎসার স্থায়ী সমাধানের খুব উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। অধিকাংশ জেনেটিক অসুখের এর মাধ্যমে স্থায়ী নিরাময় সম্ভব।
কিছু কিছু ব্যাক্টিরিয়া আছে যারা অন্ধকারে আলো বিকিরণ করে। এদের ফটোলুমিসেন্ট ব্যাক্টিরিয়া বলে। বায়ো হ্যাকাররা ক্রিসপার প্রযুক্তির সাহায্যে গেছো ব্যাংকে ফটোলুমিনেসেন্ট করে বাজারে বিক্রি করছে। বায়ো হ্যাকারদের কথা এই মুহূর্তে ছেড়ে দিন, আমার লেখার শুরুতেই যে তিনটে কথা বলেছি সেই প্রসঙ্গে ফিরে যাই। ইঁদুরের মধ্যে ক্রিসপার জিন থেরাপি ব্যবহার করে দেখা গেছে একই সাথে জন্মানো দুটি ইঁদুরের মধ্যে যেটিতে জিন থেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছিল তার বয়স অন্যটির থেকে ৩০% কম বেড়েছে। অর্থাৎ সেটি তার অন্য সিবলিং-এর তুলনায় ৩০% নবীন। তার মেরুদন্ড বেঁকে যায় নি। শরীরে প্রচুর ফুর্তি ও জোশ।
আপনারা সকলেই জানেন যে কোনো ওষুধই হোক বা ভ্যাকসিন তা মানুষের শরীরে প্রয়োগ করার আগে ইঁদুরের দেহে প্রয়োগ করা হয়। তাই এই ক্রিসপার প্রযুক্তি কোনোদিন মানুষের ওপর প্রয়োগ করলে আপনার বয়স ৩০% কমে যেতে পারে। এটা চাট্টিকানি কথা নয়। জেব্রা ফিস বলে একরকমের মাছ আছে তারা প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি। আপনি যদি তাদের ফিন বা হার্ট নষ্ট করে দেন তারা আবার তাকে নতুন করে তৈরি করে নিতে পারে। এই মাছটিকে নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালাচ্ছেন কোনোদিন যদি তাদের সেই জিন ক্রিসপারের মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেয়া যায় তবে আমরাও আমাদের নষ্ট হয়ে যাওয়া অঙ্গ নিজেরাই প্রতিস্থাপিত করতে পারব। অনেকেই মনে করেন এটা একেবারেই অসম্ভব কিছু নয়।
এ তো গেল আলোর কথা কিন্তু কালো? তারও সম্ভাবনা যে প্রচুর। আগেই বলেছি ক্রিসপারের সমস্যা তার সহজতা। তাই যে কোনো দেশ, যে কোনো সংগঠন খারাপ উদ্দেশ্যে একে ব্যবহার করবেই এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভাবুন তো কেউ যদি বিশেষভাবে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড ইঁদুর বা পঙ্গপাল আমাদের চাষের জমিতে ছড়িয়ে দেয় যারা অত্যন্ত দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে, তারা দুদিনেই আমাদের জমির ফসল খেয়ে শেষ করে দেবে। বায়ো ওয়েপন হিসেবে যদি কোনো মিউট্যান্ট ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়াকে কোনো দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয় তা কোনো বিশ্বযুদ্ধের থেকে কম কিসে?
পৃথিবীর সব দেশই তাই জার্ম সেলস বা জননকোষের ওপর এই পরীক্ষা এখনও বন্ধ রেখেছে। তবে সত্যিই যদি কোনোদিন ট্রান্সজেনিক মানুষ তৈরি হয় সে না হয় সুপারম্যান হবে কিন্তু তার চেতনার কী হবে? আমরা কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারব যে সে সুপারম্যানের মতই ভালোর পক্ষে থাকবে? সে যে মেরী শেলীর ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা আছে?
চেতনা একটা ঘোরেল জিনিস। তা কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় আমরা তার কিছুই প্রায় জানি না। তাই জিনের পরিবর্তনের ফলে তার প্রভাব চেতনায় কিভাবে পড়বে আমরা জানি না। আরেকটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার প্রকৃতি এই ব্যাপারটাকে কিভাবে নেবে? অভিযোজনের গতিপথ কি হবে, আমরা তাই নিয়েও কিছু জানি না। লক্ষ লক্ষ বছরের অভিযোজন এক বছরে হলে তার ফল কি হবে? ভালো কিছু হবে বলে তো মনে হয় না। সব নিয়ন্ত্রিত হলে মঙ্গলের কিন্তু আগেই বলেছি একে নিয়ন্ত্রণ করা দ্রুত মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে যাবে।
আবার বলছি আমরা সকলে খুব ছোট্ট একটা ইকোলজিক্যাল নিশের মধ্যে বসবাস করি। ভারসাম্যই যার মূল কথা। এটা আমাদের ভুললে চলবে না। আরেকটা কথাও আমাদের ভুললে চলবে না যে আমরা শত চেষ্টা করি না কেন এই পৃথিবীতে চিরদিন আমাদের নিজেদের প্রজাতিকে টিঁকিয়ে রাখতে পারব না। বাস্তবে আমরা যেমন অমর নই আমাদের প্রজাতিও অমর অক্ষয় নয়। তার অবলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী।